খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।
স্কুলের মাঠের ঐ পাশে স্কুলের দারোয়ান রহিম আলি আর তার বৌ এর ছোট্ট দোকান। সে বড় গামলা ভর্তি করে চানা ভুনা করে রাখে পেঁয়াজি বানিয়ে রাখে আর চানা ভাজা, মটর ভাজা বাদাম ভাজা তো আছেই । স্কুলের সব ছেলে মেয়েরা লাইন দিয়ে সেই খাবার কিনে খায়।
ছোট্ট ছোট্ট টিনের বওল এ করে রহিম আলির বউ চানা ভুনা দেয় । আমি ঐ চানা ভুনা খেতে খুব ভালবাসি কিন্তু আব্বাকে বললেই কি আব্বা শুনছে ? আব্বা বলে, বাইরের ঐ খাবারে শরীর খারাপ হয় । নানা রকম অসুখ হয়, ওগুলো খেও না । বাড়ি এসে খেয়ে যেও ! আম্মা বকুনি দেয়, সুযোগ পেলেই দুদ্দাড় পিঠে বসিয়ে দেয় কিন্তু তবুও ধানাই পানাইগুলো আম্মার কাছেই চলে কিন্তু আব্বা তো ব্যাস বলেই খালাস! আর কোন কথা বলার কিংবা আপত্তি জানানোর সুযোগটুকুও দেবে না । আব্বা কখনো জোরে কথা বলে না, বকুনি তো একদমই দেয় না ।
আসলে আব্বা এত ভালোবেসে আর এত মিষ্টি করে বলে যে আমি আব্বার কথা না শুনে পারি না । আমাকে তাই আসতেই হয় ।
ক্কুল ইয়া আইউহাল ক্কাফিরুন ।
লা আ'বুদু মা তা'বুদুন ।
ওয়ালা আনতুম আবিদু না মা আ'বুদ ।
ওয়ালা আনা আ'বিদুম মা আ'বাদতুম ।
লাকুম দী নুকুম ওয়ালিয়া দীন। (সূরা কাফিরুন)।
আব্বাকে ভীষণ ভালবাসি আমি । আব্বা আমায় নানা কাহিনী শোনায় ।
হজরত খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তি (র এলেন আজমেড়ের আন্না সাগরে। তখন আজমেড় পৃথবীরাজের অধীনে । তার কানে গেল হজরতের আসার কথা । তিনি তার সেনানিদের নির্দেশ দিলেন হজরত ও তার সাগরেদদের জল সরোবরাহ যেন বন্ধ করে দেওয়া হয় । হজরত তার এক সাগরেদকে পাঠালেন আন্না সাগর থেকে এক লোটা পানি নিয়ে আসার জন্যে।
তাজ্জব ব্যাপার একলোটা পানি তুলতেই সাগর শুকিয়ে খটখটে। তারপর শুরু হল যুদ্ধ । সেই অসম যুদ্ধে জিতে গেলেন হজরত খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তি (র । তার মৃত্যুর পর সেখানে তৈরী হয়েছে দরগাহ । আব্বা আমাকে বোঝান এই ভাবে দরগাহে তার কাছে মানত করা হারাম ।
কোন পীর কিংবা ফকিরের দরগায় গিয়ে মানত করলে শিরক্ক করা হয় । এই ভাবে শিরক্ক ( আল্লহের সাথে কাউকে শরিক করা ) করা তো আমাদের এইখানেও হয় । ইলিয়াস কাকার কথা মনে পড়ে আমার । তিনি তো যান সেই দরগাহে । আরো দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসে এই দরগায় ।
তাদের কত রকমের মানত থাকে । কেউ এসে মানত করে যায় আবার কেউ আসে মানত পুরো করতে। যারা দূর থেকে আসে তারা আশে পাশের কোন আত্মীয়ের বাড়িতে এসে ওঠে আর তারপর সারাদিন এসে এই দরগায় কাটায় । কেউ খাসি তো কেউ গরু জবাই করে আখনি রান্না করিয়ে এখানকার সব ভিখিরিদের খাওয়ায়। এই দরগায় প্রচুর ভিখিরি ও থাকে ।
খাবার তাদের ঠিক জুটে যায়। মাজারে লোকের আনাগোনা লেগেই আছে । ইলিয়াস কাকা এইরকমই একজন । ইলিয়াস কাকার কোন ছেলে মেয়ে নেই । ইলিয়াস কাকা থাকে শয়েস্তাগঞ্জে, রাতের ট্রেন ধরে সে খুব ভোরবেলায় এসে পৌছায় আমাদের বাড়ি ।
স্নান নাশতা সেরেই চলে যায় দরগায় । সারদিন সেখানেই থাকে । কাকিমাও থাকে সাথে। প্রতিবারই দুটো করে খাসি জবাই করে ইলিয়াস কাকা, কোনবার রান্না হয় আখনি তো কোনবার গোশতের ভুনা আর ডাল ভাত। ইলিয়াস কাকা নিজের হাতে খাবার বেড়ে খাওয়ায় সবাইকে।
ককিমা কাছেই কোথাও একটা মোড়ায় চুপ করে বসে থাকে। আব্বা পছন্দও করে না ইলিয়াস কাকাকে,আমি প্রতিবারই ইলিয়াস কাকার সঙ্গী হই সারাদিনের জন্যে । সেই দিন আমি স্কুলে যাই না। সারাদিন থাকি দরগায় । ইলিয়াস কাকা ডেগেও টাকা দেয় ।
ফকিরের ক্কবরে গিয়ে ক্কবর জিয়ারত করে আসে। আমি আর কাকিমা তখন মাছেদের মাছ খাওয়াই । শুনেছি এই মাছগুলো নাকি কোন একসময় মানুষ ছিল । সেই ফকিরের জমানায় । এখানে যার ক্কবর।
যাকে ঘিরে এই দরগাহ। এরা আসলে একটি উপজাতি ছিল । ফকির শাহ্জালাল যখন এখানে ধর্মপ্রচারে এসে ঝর্নার পারের ঐ জায়গাতে বসতি স্থাপন করেন ঐ মানুষগুলো তখন সেই জায়গায় থাকত । তাদের নিজস্ব ধর্ম ছিল, দেবতা ছিল যার তারা পুজো করত। তাদের নিজেদের নিয়ম কানুনই তারা মানতো ।
ফকির যখন ঐ জায়গায় এসে বসতি স্থাপন করেন ও একেশ্বরবাদের প্রচার করেন তারা সব চাইতে বেশি বিরোধিতা করেছিল । এরা ফকিরকে যত প্রকারে সম্ভব অত্যাচার করেছে , এমনকি প্রাণে মারারও চেষ্টা করেছে । ফকির বহু চেষ্টা করেও তাদেরকে কথা শোনাতে পারেননি । শেষে নিরূপায় হয়ে তাদেরকে নাকি অভিসম্পাত করেছিলেন যার ফলে রাতারাতি একটি গোটা উপজাতি মানুষ থেকে মাছে রূপান্তরিত হয় । ফকির তখন নিকটবর্তী পুকুরে ঐ মাছেদের ছেড়ে দেন ।
এই মাছেদের এক একটা সত্তর-আশি বছর বাঁচে। কোন মাছ মরে গেলে তাকে তুলে এনে গোসল দিয়ে তার দাফন-ক্কাফন ও তাকে ক্কবর দেওয়া হয় ।
তাব্বাতিয়াদা আবি লাহাবিওঁ ওয়াতাব্ব।
মা আগনা আনহু মা লুহু ওয়ামা ক্কাসাব্ব।
সাইয়াসলা নারান যাতা লাহাবিউঁ (সুরা লাহাব ।
আয়াত 1,2,3)
আমি ভয় পেয়েছিলাম । জাহানারা আপা ক্লাসে ছিলেন, ইসলামিয়াত পড়াচ্ছিলেন । জাহানারা আপাকে মেয়েরা কেউ ভয় করতো না । তিনি ক্লাসে আসতেন সবাইকে মাথায় কাপড় দিয়ে বই খুলে সামনে রাখতে বলতেন আর নিজে পড়ানো শুরু করতেন। কলেমা পড়াতেন আর তার অর্থ বলে দিতেন ।
পৃথিবী কি করে সৃষ্টি হল, মানুষ কবে দুনিয়াতে এলো, মৃত্যুর পরে কি হবে এই সব পড়াতেন। নিজেই জোরে জোরে পড়ে যেতেন। কে শুনছে কে শুনছে না তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না । আমি সেই সময়টায় রাম শ্যাম যদু মধু খেলার কাগজ টুকরো করে রাখতাম । কখনো পরের ক্লাশের পড়া একটু দেখে নিতাম ।
ইসলামিয়াত ক্লাসের পরেই ইতিহাসের ক্লাস আর ইতিহাসের আঙ্গুরী আপা ক্লাসে ঢুকেই সবার আগে পড়া ধরতেন । সেই ইসলামিয়াত ক্লাসে একদিন রিনি বলল, এদিকে তাকা, তোকে একটা জিনিস দেখাই কিন্তু খবরদার কাওকে বলবি না । মিশু পাশেই ছিল, সে বলল আমিও দেখেছি আর কাওকে বলিনি তুই ও বলিস না কাওকে । বই আড়াল করে রিনি তার বুক দেখাল । আমি চমকে উঠেছিলাম সেদিন ।
রিনি আমাকে শরীর চিনিয়ে দিয়ে গিয়েছিল । মেয়েদের শরীর । রিনি বোধ হয় আমার থেকে বছর তিন চারের বড় ছিল । স্কুলে দেরিতে ভর্তি হওয়া আর তারপরে এক ক্লাসে দুবছর পড়ার দরুন রিনি আমার ক্লাসে ছিল । রিনির শরীরে বড় হওয়ার লক্ষণ আসছিল, ওর বুকে কুঁড়ি একটু একটু করে পাপড়ি মেলছিল ।
ক্লাসে বসেই বই আড়াল করে রিনি তার বুক খুলে দেখিয়েছিল প্রথমবার । রিনি আরও বলল তুই এখনও অনেক ছোট আর কিছুদিন পরে তোরও হবে এরকম । আর তারপর আরেকটু বড় হওয়ার কথা বলল । কি করে মেয়েরা বড় হয় তার বিস্তারিত বিবরন দিয়ে । আমার ইতিহাসের পড়া মাথায় উঠলো ।
আমার খুব ভয় করছিল । আমার শরীর থেকে রক্ত বেরোবে? আর তা কয়েক দিন ধরে বেরুতেই থাকবে? আর সেটাই নাকি স্বাভাবিক । রিনি আমাকে বারবার করে বারণ করে দিল কাওকে যেন না বলি । বাড়ি ফিরে সেদিন আর খেলাতে মন লাগলো না । সন্ধ্যেবেলায় না খেয়েই শুয়ে পড়লাম ।
রাতে আধোঘুম আধো জাগরণের মধ্যে পাশে শুয়ে থাকা ছোটফুফুকে সব বলে দিলাম । আর তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম । সকালে কেউ আমাকে কিছু বললো না, আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম । স্কুল থেকে ফেরার পর সেদিন ছোটফুফু আমাকে নিয়ে বাগানে গেল। জিজ্ঞেস করলো আজ কি হয়েছে ? আমি বললাম আজ তো ইসলামিয়াত ক্লাস ছিলো না ! তখন ছোটফুফু আমার শরীরের কিছু বিশেষ বিশেষ অংশ দেখিয়ে আমাকে বললো, এগুলো তোমার একান্তই নিজের।
এ কাওকে দেখানোর জন্যে নয়। কাওকে হাত দিতে দেবে না কক্ষণো। অন্য কেউ নিজেরটা দেখাতে চাইলে দেখবে না সে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক । কিছু জানতে চাইলে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, আম্মু কে জিজ্ঞেস করবে স্কুলের বন্ধুদের নয়। আমি সেদিন জানলাম বড় হওয়া মানে শুধু মাথায় লম্বা হওয়া নয়।
আমি তখন অব্দি বাড়িতে শুধু প্যান্টি আর সেমিজ পরে ঘুরে বেড়াতাম কিন্তু সেদিনের পরে আর কোনদিন সেমিজ পরে ঘুরে বেড়াইনি ।
এলাটিং বেলাটিং সই লো ।
কি খবর আইলো?
রাজায় একটা মাইয়া চাইলো ।
কোন মাইয়া চাইলো?
আমি বড় হচ্ছি বুঝতে পারি, একে একে এটা মানা ওটা মানা, সব নিষেধ শুরু হয়ে যায়। একা একা মাজারে যাওয়া মানা ।
কিন্তু আমার ভীষণ ভালো লাগে জায়গাটা । আব্বার কাছে ততদিনে শুনে ফেলেছি এই দরগাহের কথা । শাহজালাল ছিলেন হজরত খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তির ভাগ্নে । হজরতের কাছে আদেশ পেয়ে দিল্লি থেকে হাজির হলেন শ্রীহট্টে। সংগে কেবল দুটো সুর্মা রঙা কবুতর ।
শ্রীহট্টে তখন হিন্দু রাজাদের শাসন । রাজা গৌর গোবিন্দের অত্যাচারে মুসলমানেরা কোনঠাসা । শাহজালাল আসার খবর পেয়ে রাজা করলেন কি সুর্মা নদী থেকে সমস্ত নৌকো তুলে নিলেন, যারা রাজী হল না তাদের নৌকো ছ্যাঁদা করে দিতে নির্দেশ দিলেন। শাহ্জালাল নদীর পারে এসে দেখলেন কোনো নৌকো নেই । কথিত আছে তিনি জায়নামাজটা প্রথমে নদীর ওপর পাতলেন, তার ওপর ভেলার মত চেপে নদী পার হয়ে গেলেন।
এই দৈবি ক্ষমতা প্রকাশ পেতেই রাজার শক্তি অর্ধেক হয়ে গেল। যুদ্ধ হল বটে কিন্তু প্রতিরোধ টিকলও না । শাহ্জালাল সেখানেই থেকে গেলেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে, দুটো সূর্মা পায়রা ক্রমশ হাজার হাজার হয়ে ছেয়ে ফেলল সারা সিলেট, ততদিনে শ্রীহট্ট হয়ছে সিলেট আর শাহজালালের মৃত্যুর পর সেখানেই তৈরী হয়েছে মাজার। লোকে সেই মাজারে মানত চড়াতে লাগলো। আমি অবশ্য এমনিই যাই।
ভালো লাগে। তবে আজকাল একা যাওয়ার যো নেই। কাকা-কাকিমার সাথে আসি।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।