আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হায়, বিটিভি

সুন্দরী বালিকাদের যত্ন করে কামড়াই

মালেনা দেখেছেন অনেকেই। যুদ্ধে গিয়ে মালেনার স্বামী আর ফিরে আসে না, বাতাসে গুঞ্জরিত হয় তার মৃতু্যসংবাদ, সুতন্বী মালেনাকে নিয়ে ভেবে ভেবে বিনিদ্র স্বপ্নময় রাত কাটায় এক কিশোর, আর তার চোখের সামনে গোটা নগরের পুরুষরা হামলে পড়ে একা, অরক্ষিত মালেনার ওপর, তাকে সমাজচু্যত করা হয় অক্লেশে, সে সংসাররীতির বাইরে পা বাড়ায় মামলায় উকিলের প্রাপ্য দেহ দিয়ে শোধ করতে, এক পর্যায়ে দিনের খাবারটুকুও তাকে কিনতে হয় চোরাচালানির কাছে নিজেকে মেলে ধরে। সেই কিশোরের চোখের সামনে দিয়ে এক সময় মালেনা পরিণত হয় বেশ্যায়, শহরে যখন জার্মান সৈন্যরা পা রাখে, তাদের অফিসারদের কণ্ঠলগ্নাদের মধ্যে মালেনাও ছিলো এক সুন্দরী। সেই কিশোরের কাছে তবু মালেনার রূপ নষ্ট হয় না, সে তবুও ভেবে যায় নিজের মতো করে, তার কল্পনায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে সঙ্গ দেয় মালেনা। বিটিভির প্রসঙ্গ উঠলে আমারও মনে হয় মালেনার কথা।

বিটিভি আমার শৈশবের প্রেম। সেই রাত ন'টায় নাইট রাইডার, ফল গাই, দ্য এ টীম, ম্যাক গাইভার, রাতের খবরের পর থর্ন বার্ডস, অল দ্য রিভারস রান, টুইন পীকস ... সন্ধ্যাবেলা টেলস অব দ্য গোল্ডেন মাংকি, শুক্রবার দুপুরে থান্ডারক্যাটস। আকৈশোর আমার ভালোবাসা ছিলো বিটিভি। তখন নাটক আরো সীমিত, আরো পরিমিত ছিলো, হুমায়ূন আহমেদের নাটক তখন ছিলো প্রতিশ্রুত আনন্দের সমার্থক। আখতার ফেরদৌস রানাও বিটিভির জন্য চমৎকার কিছু নাটক লিখেছিলেন, কয়েকটার টুকরো টুকরো সংলাপ মনে আছে এখনও।

বিটিভির এই আকর্ষণের পাশাপাশি কালো দিকটাও ছিলো। খবর মানে এরশাদ সাহেবের ঘোড়ার মতো চেহারা, আর তার চেলাচামুন্ডাদের ভগরভগর। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর শুধু নাম পাল্টালো, খালেদা জিয়াই বিটিভির প্রিয়দর্শিনী হয়ে দাঁড়ালেন। তখন খবর দেখতাম না, বিটিভি ছিলো ম্যাকগাইভারখানা। এগুলো বাদ দিলেও বিটিভিতে হঠাৎ হঠাৎ চমৎকার সব প্রামাণ্য অনুষ্ঠান দেখানো হতো, বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাঁকে দেখানো হতো টুকরো টুকরো চলচ্চিত্র, আরো অনেক কিছু।

আমার ইংরেজি শেখার একটা সহায়ক মাধ্যম ছিলো বিটিভির সিরিয়ালগুলো। বৃহস্পতিবার মুভি অব দ্য উইকে দেখেছি খুব ভালো বাছাই করা কিছু মুভি, নির্বাচক কে বা কারা ছিলেন জানি না, আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। বিটিভিও মালেনার মতোই চোখের সামনে ক্ষমতাসীনের রক্ষিতায় পরিণত হয়েছে। বেশ্যার শরীরে যেমন কামুক আর মাতালেরা চিহ্ন রেখে যায়, বিটিভির শরীরেও এখন সেরকম ক্ষত। ইংরেজি সিরিয়ালগুলো বাংলায় কুৎসিত ডাব করে দেখানো হয়, অনুষ্ঠানের মান আগের তুলনায় অনেক খারাপ হয়েছে, বেসরকারী টেলিভিশনগুলোর বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশনের অনুকরণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয় চরম অদক্ষ ক্রু নিয়ে, যেখানে রিপোর্টার বা সংবাদ পরিবেশকেরা জড়িয়ে জড়িয়ে ভুল বাংলায় কথাবার্তা বলেন, আর প্রায় সারাটা সময় দেশে যে কী দারুণ উন্নয়নের মড়ক লেগেছে সেটা প্রমাণের গাজোয়ারী চেষ্টা।

প্রথমে বিএনপি, পরে আওয়ামী লীগ, তারপর এখন জোট সরকারের রক্ষিতাগিরি করে চলছে প্রৌঢ়া বিটিভি। আমি নিজের প্রাককৈশোর আর কৈশোরকে স্মরণ করে মাঝে মাঝে বিটিভি ধরে দেখি, মনে হয় কোন নাৎসির কোলে ছেনালিতে রত এক বেশ্যাকে চুরি করে দেখছি। আজকে যাদের নাগালে আর কোন টেলিভিশন নেই, তাদের ইংরেজি চর্চার উপায়টা পর্যন্ত রাখেনি সদাশয় কর্মকর্তাগণ। সব চলচ্চিত্র আর সিরিয়াল আড়ষ্ট বাংলায় ডাব করা, সেটার রসাস্বাদন করা কোন সুস্থ পাকস্থলীর মানুষের পক্ষে বোধহয় সম্ভব নয়। সোর্ড অব টিপু সুলতান আর আলিফ লায়লা গোছের নিম্নমানের ভারতীয় অনুষ্ঠানের বাংলা সংস্করণের ঔপনিবেশিকতা শুরু হয়েছিলো আমার কৈশোরেই, আজো তার নখদাঁত থেকে বিটিভি মুক্তি পায়নি।

শিশুদের অনুষ্ঠানে দেখি দেশের সবচেয়ে দাগী মাস্তানগুলোকে নিয়ে আসা হয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে, যারা গুছিয়ে নিজের শিশুকাল নিয়ে একটা সত্য কথাও বলতে পারেন না। বিটিভির উদ্দেশ্য কী? সুস্থ, শিক্ষামূলক বিনোদনের মাধ্যমে দেশের অপেক্ষাকৃত স্বল্পবিত্ত মানুষের রুচির কাঠামো নির্দেশনা? নাকি সরকারের ঢোল বাজানোর ফাঁকে ফাঁকে জঘন্য বমনউদ্রেককারী সব "অনুষ্ঠান" দেখিয়ে লোকজনকে চ্যানেল পাল্টাতে উৎসাহ দেয়া? যাঁরা ষড়যন্ত্রতাত্তি্বক, তাঁরা হয়তো বিটিভির এই পতনের পেছনে বেসরকারী টেলিভিশনের ভূমিকাও আবিষ্কার করে বসবেন। যাঁরা মালেনা দেখেছেন, শেষটাও হয়তো দেখেছেন। মালেনার পঙ্গু স্বামী ফিরে আসে, মালেনাকে খুঁজে বার করে, তার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একদিন বাজারে আসে, যে ঈর্ষাণি্বতা মহিলারা মালেনাকে পিটিয়ে আঁচড়ে খামচে উলঙ্গ করে বার করে দিয়েছিলো শহর থেকে, তাদেরই একজন সুপ্রভাত জানায় এই দম্পতিকে। সব কিছু প্রায় আবার আগের মতোই যেন হয়ে আসতে চায়।

বিটিভিকে কেউ উদ্ধার করবে এই অপমানের হাত থেকে? এই গ্লানি থেকে? আবারও কি কখনো বিটিভি দেখে চমকে উঠে নিজের শৈশবকে স্মরণ করতে পারবো? কেউ কি আছেন ত্রাণের জন্য?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।