"কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরিয়া গেছে.। " কার্তিকের বিকেল। দিনের সূর্য অস্তাচল ছুঁই ছুঁই। মুকুন্দপুর গ্রামের বিস্তীর্ন মাঠে আধা পাকা ধান ক্ষেতের মাথায় নতুন কুয়াশার হালকা রেখাপাত। পারুল তার প্রিয় ডিম পাড়া হাঁসি দুটো তাড়িয়ে ঘরে ফেরার সময় দেখে তার মা উঠোনের কোনে সজনে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে কার সাথে কথা বলছে।
পারুলের সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নাই।
গফুর মিয়া ঘন্টাধিকালের নিরন্তর চেষ্ঠায় পারুলের মাকে রাজি করাতে সক্ষম হয়। গফুর মিয়া চৌধূরীদের গ্রামের জমি জিরোত দেখা শুনা করেন। চৌধূরীর বড় ছেলে ডাক্তার বউ ও এক ছেলে নিয়ে ঢাকার নতুন বাড়িতে উঠিছে। সেখানে একজন কাজের মেয়ে দরকার।
আর যোগাড় করে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তেছে গফুর মিয়ার উপর।
গফুর মিয়া এর আগেও দুদিন এসেছিল পারুলের মায়ের কাছে ।
কিন্তু দশ বছরের ছোট্ট মেয়েটাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে পাঠাতে মাতৃমন কিছুতেই সায় দেয়নি। কিন্তু আজ যখন গফুর মিয়া বল্ল, " আমেনা তোর মেয়েটা ঐখানে গেলে শুধু ভাল ভাল খাতি পারবে তা না কয়টা ট্যাকা কামাইতিও পারবে দু'চার কলম লিখা পড়াও শিখতে পারবে। বড় সাহেবের বউ ডাক্তার মানুষ।
ম্যালা টাকা তাগো। তোর মাইয়্যাটারে ইস্কুলে ভর্তি করাইয়া দিবে" তখনই তার মন নরম হয় এবং সে গফুর মিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
পারুল পড়া লিখা খুব ভালবাসে। এই কথা মা আমেনা বেগম ভাল করেই জানে। কিন্তু জানলে কি হবে মেয়েকে পড়ালিখা করানোর মত সামর্থ্য তার নাই।
পারুল কে পেটে রেখেই আমেনার ঘর জামাই নিরুদ্দেশ। তখন থেকে তিন মেয়ে নিয়ে দরিদ্র সংসারের গ্লানি টেনে আসছে সে। নিজের জমি জিরোত বলতে কিছু নেই। সম্বল বলতে বাপের রেখে যাওয়া ভিটা আর ছোট্ট কুড়েঁঘর। মা-মেয়ে মিলে এই বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে দু'মুঠো ভাতের সংস্থান হয়।
বড় দুই মেয়ে দিন দিন ডাঙর হয়ে উঠছে। বিয়ে থা দিতে হবে। এসব চিন্তায় আমেনার ঘুম হারিয়ে যায় বহু রাত। অন্য দিকে গ্রামের মানুষ বলে " গরিবের মেয়ে,পড়া লিখা করে লাভ কি তার চেয়ে কাম কাজ শিখাও, দু'পয়সা কামালে কাজ দেবে"। সাধ ও সাধ্যের নির্মম সমীকরণে অসহায় আমেনা বেগম গ্রামের মানুষের কথাই অবনত মস্তকে মেনে নেয়।
তবুও পারুল সুযোগ পেলেই ছুটে যায় মুকুন্দপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাসে একবার, দুবার কিংবা তিনবার। পড়া লিখা করার অদম্য বাসনা তাকে সবসময় দোছালা টিনের ঘরটার দিকে প্রবল বেগে টানে। কিন্তু প্রবল দারিদ্রতার কাছে সেই টান হার মানে আর পারুলের কোমল হৃদয়ে জন্ম নেয় সুতীব্র হাহাকার। সেই হাহাকারের শব্দ নিত্য শুনতে পান মা আমেনা বেগম।
আর তাই আজ সে তার মাতৃহৃদয় কে ভৎসনা করে গফুর মিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকা ধানমন্ডিতে এনায়েত হোসেন চৌধূরীর সুবিশাল বাড়ি। এই বাড়িতে পারুলের নতুন ঠিকানা। চৌধুরী সাহেব পেশায় প্রকৌশলী আর মিসেস চৌধুরী ডাক্তার। দুজনেই সচেতন সমাজকর্মী।
অভিজাত দম্পতির একমাত্র সন্তান নাহিয়ান । ইংরেজী মাধ্যমে পড়ে ঢাকার নামী স্কুলে । দিনের পুরোটাই পরিবারের সবাই বাহিরে থাকে। ঘরের সব কাজ ছোট্ট হাতে পারুল একাই সামলায়। রাত হলে সবাই খাওয়ার পর পাতিলের তলানীতে যেটুকু সালুন থাকে তা দিয়ে পেট পুরে খেয়ে কিচেনের মেঝেতে হোগলার মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়ে।
এভাবে দিন যায়, মাস পেরোয়। কিন্তু পারুলের পড়ালিখার কোন খবর নাই। ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠে পারুল । একদিন চৌধুরী বধু কে জিঙ্গেস করে বসে, " খালাম্মা আমারে ভাইজানের মত ইস্কুলো ভর্তি করাইবেন না? গফুর মিয়া যে কইলো আমারে ইস্কুলে পড়াইবেন"
হতদরিদ্র এক গ্রাম্য কাজের মেয়ের এমন প্রশ্নে ডাক্তার সুরাইয়া খানমের আভিজাত্যের দেয়ালে প্রচন্ড কাঁপন ধরে। গরীবের ফুটানি তার কাছে অসহ্যা অপাঙক্তেয় লাগে।
নিজের চোখ দুটো যথিচ্ছা লাল করে হুংকার ছাড়েন তিনি-
- যা ভাগ বেয়াদপ।
ভয়াদ্র আমেনা দৌঁড়ে কিচেনের এক কোণায় গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বুক বাসায়। গফুর মিয়ার কথা মত গাদা গাদা কাজ আর তিন বেলা খাবার জুটলেও যে অপার্থিব লোভে সে এখানে ছুটে এসেছিল, যে চাওয়াটা কে সব মানুষের মৌলিক অধিকার বলে চিৎকার করতে করতে সমাজকর্তারা গায়ের ঘাম চুটিয়ে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থিতু হয়ে ঝিমায়, সেই পড়ালিখার অধিকার সুযোগ হয়ে ধরা দিলনা পারুলের কাছে। সমাজ হীত কামনায় সদা সজাগ চৌধুরী দম্পতি হত দরিদ্র এক কাজের মেয়ের হাতে বই তুলে দিয়ে নিজেদের মহা মূল্যবান আভিজাত্য বিসর্জন দেওয়ার মত উদার হতে পারলেন না !
পাখির জীবন পারুলের। সকালে সবাই বের হয়ে যায় বাহিরের দরজায় তালা দিয়ে।
বদ্ধ ঘরে আমেনা একা একা কাঁপড় কাঁচে, বাসন মাজে, ঘর মুছে আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে বেলকনির গ্রীলে মুখ চেপে শোন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এই অচেনা শহরে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ি গুলোর দিকে। তার চোখে হয়ত তখন ভাসে একজোড়া ডিম পাড়া হাঁসি, একটা ছাগল ছানা, পূবপাড়ার প্রকান্ড তেঁতুল গাছ কিংবা মুকন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোচালা টিনের ঘর।
মাঝে মাঝে আরো একটা কাজ করে পারুল। নাহিয়ানের পড়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে ভিতরে তাকিয়ে থাকে। এই ঘরটা তার কাছে স্বর্গের মত।
তার ইচ্ছে করে ভিতরে ঢুকে বই গুলো ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু পারেনা। কারণ খোকনের বই খাতায় তার হাত দেওয়া মানা। শুধু স্বর্গের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রান্তি বিলাসে বার বার হোঁচট খায় বিধাতার নির্মম খেয়ালের স্বীকার এক কোমল হৃদয়।
কিন্তু আর কত ? দিনের পর দিন অন্ধ লাটিমের মত নিজের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া পারুলের ইচ্ছেরা একদিন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে।
আজ ভয় কে জয় করে পারুল ঢুকে পড়ে নিষিদ্ধ স্বর্গে। টেবিলের উপর থরে থরে সাজানো কত বই, রঙীন মলাটের খাতা, স্কেল, রংপেন্সিল আরো কত কি? চোখ ধাঁধিয়ে যায় পারুলের। সে একটা বই ছুঁয়ে দেখে তো আরেকটা বই নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেয়। রং-পেন্সিল গুলো নেড়ে ছেড়ে দেখে। চেয়ার টেনে টেবিলে বসে হাতে তুলে নেয় রংপেন্সিল আর নাহিয়ানের হোমওয়ার্কের খাতা।
তারপর নিজের মত করে কাঁচা হাতে জোড়া হাঁস, কুঁড়েঘর, তার মায়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই হয়না। নিজের ব্যার্থতায় খিল খিল করে হেসে উঠে পারুল। সভ্যতার নামহীন কারাগারে দীর্ঘ পাঁচ মাসের বন্দী জীবনে এই প্রথম গ্রাম্য দূরন্তপনার সহজাত রূপে শব্দ করে হাসল সে। কিন্তু সে হাসির শব্দ ঘরের দেয়ালে ধ্বনিত প্রতিধ্বনীত হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই প্রধান দরজার কপাট খুলে যায়।
ভীতসন্ত্রস্ত পারুল দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। ঘটনার ত্রস্ততায় খোকার সবগুলো রংপেন্সিল মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু পালিয়ে পারুল যাবে কোথায়? যে পাখি খাঁচায় বন্ধী হয়ে সভ্য মানুষের বিনোদন জোগায় তার কি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে ? এই চার দেয়ালের কারাগারে গৃহকত্রীর একচ্ছত্র মালিকানাধীন ছোট্ট কিচেন ঘর ছাড়া পারুলের তো আর কোন ঠিকানা জানা নেই। অগত্য কিচেনের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। কিন্তু চোখের পলকে সেখানে এসে হাজির হন ডাক্তার সুরাইয়া খানম।
তিনি প্রচন্ড ক্রোধে বাম হাতে পারুলের চুল ধরে অন্য হাতে তুলে নেন খুন্তি।
- হারামজাদি ! ছোটলোকের বাচ্চা ! তোর এত বড় সাহস, তুই খোকনের টেবিলে বসেছিস, তোকে আজ মেরেই ফেলবো।
বলতে বলতে খুন্তি গরম করে পৈশাচিক উম্মাদনায় বসিয়ে দেন পারুলের পিঠে। একবার, দুবার, বহুবার। যতবারই নির্মম গরম খন্তি পারুলের পিঠ স্পর্শ করেছি ততবারই নারকীয় যন্ত্রনায় সে মাগো মাগো করে চিৎকার করে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে।
তার সে আর্তনাদ শহরের অলি গলি আর উচু উঁচু দালানকোঠার বাঁধা পেরিয়ে তার মায়ের কাছে পৌঁছার আগেই প্রচন্ড খিচুনি দিয়ে জ্বর এসে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
বেলা দ্বি-প্রহর । মুকুন্দপুরের চাষীরা ক্ষেতে নিবিষ্ট। আমেনা বেগম মুন্সী বাড়ীর ধান সিদ্ধ কাজে ব্যাস্ত। একটা সাদা রংয়ের গাড়ি এসে থেমেছে আমেনার খাঁ খাঁ উঠোনে।
খবর পেয়ে ছুটে আসে আমেনা। ঢাকা থেকে বুঝি তার মেয়ে এল। হ্যাঁ পারুল ফিরে এসেছে। তবে পড়ালিখা করার অদম্য স্বপ্ন কে সাথে নিয়ে পাঁচ মাস আগে গফুর মিয়ার পিছু পিছু গুটি গুটি পা ফেলে যে পারুল মায়ের কোল শূন্য করে ঢাকা গিয়েছিল সে পারুল ফিরে আসেনি। ফিরে এসেছে সাদা কাফনে মোড়া নিথর নিস্তব্ধ স্বপ্নহীন পারুল।
মুহুর্তেই ন্যাপথালিনের উৎকট গন্ধ আর সন্তান হারা জননীর আর্ত-বিলাপে ভারি হয়ে উঠে মুকুন্দপুরের বাতাস। লাশ গাড়ীর সাথে আসা ছোট চৌধুরী সবাইকে জানিয়ে দিলেন কাল নিজের ভূলে খেলতে গিয়ে বিদ্যুতের তারে পিষ্ট হয়ে পারুল মারা গিয়েছে।
পারুলের অকাল মৃত্যু খবর গ্রামে রাষ্ট্র হতে শুরু করেছে। গ্রামের কতক নারী পুরুষ আপসোস আর সান্তনার বাণী নিয়ে আমেনার উঠোনে জমা হয়েছে। কতগুলো কালো দাঁড়কাক কর্কশ স্বরে ডেকে ডেকে মুকুন্দপুরের আকাশ প্রদক্ষিন করছে।
এই গ্রামে এত কাক এর আগে কোনদিন দেখা যায়নি। পাঠশালায় ঢং ঢং ঘন্টা বাজছে। মাষ্টার মশাই পাঠ শুরু করেছেন। আগামী দিনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে ছোট ছোট বাচ্চারা সুর করে পড়ছে " অ'তে- অজগর আসছে তেড়ে......." ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।