জন্মোপার থেকে পৃথিবী হয়ে অনন্তে >>> ©www.fazleelahi.com
পৃথিবীতে আমাদের জীবন স্বল্পকালের, এই স্বল্পতা নিয়ে যেমন চলে যাওয়ার কষ্টে মানুষ প্রকৃত আনন্দ অনুভব করতে পারে না, তেমনি পারে না জীবনে কোনরূপ স্থিরতা আনতে। কারণ, প্রতিটি মানুষের জন্যই এই স্বল্পতার সীমা কতদূর, সে তার অজানা। এর শেষ হতে পারে মুহূর্তকাল পরে, হতে পারে একদিন, এক মাস কিংবা অনেকগুলো বছরেরও পরে। দাবী তো ছিল যে, প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের কাটবে এক নির্মোহ শঙ্কায়, মরণের অপেক্ষায়, যেদিকে মুহূর্ত মুহূর্ত করে এগিয়ে যাচ্ছি, যাঁর সাক্ষাতের লক্ষ্যে জীবনের এই সার্বিক আয়োজন; আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত তো তাঁর স্মরণেই অতিবাহিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পার্থিবতাকে এত সুন্দর আর মোহময় করে স্রষ্টা সৃষ্টি করলেন যে, একান্ত চিন্তাশীল বিশ্বাসী এবং আত্মসমালোচক সফলতাকামী ব্যক্তি ছাড়া সাধারণের জন্য এ পর্যায়ে থাকাটা এতটা সহজ নয়।
আর তাই আমরা ভুলে থাকি, অধিকাংশ সময়ই ভুলে থাকতে চেষ্টা করি এই চলে যাওয়াকে। আমাদের জীবনের আনন্দ আর হাসিগুলো মূলতঃ এই ভুলে থাকারই ফলাফল মাত্র।
যে অদৃশ্য জগতের হাতছানিতে আমাদের জীবনের এগিয়ে চলা, সেই জগত সম্পর্কে যে মহান সংবাদবাহক শিক্ষক আমাদেরকে সংবাদ জানালেন, শিক্ষা দিলেন, সেই প্রিয় রাসূলের সাহাবী বারা বিন আযেব রাদিয়াল্লাহু 'আনহু বলেন ঃ [গাঢ়]'আমরা একদিন আনসার গোষ্ঠীর জনৈক ব্যক্তির জানাযার সালাত আদায় করতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বের হই, যখন কবরস্থানে পেঁৗছাই তখনো কবর খননের কাজ শেষ হয়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসলেন এবং আমরাও তার পাশে বসলাম। মুহূর্তটি এমনি থমথমে ছিল যেন আমাদের মাথার উপরে পাখি বসে আছে।
রাসূলের হাতে উদ গাছের একটি ডাল ছিল যা দ্বারা তিনি মাটি খুঁড়ছিলেন। [/গাঢ়]
[গাঢ়]কিছুক্ষণ পর মাথা উঠিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন ঃ তোমরা আল্লাহ্র নিকট কবরের আযাব হতে আশ্রয় চাও। একথা তিনি দু'বার অথবা তিনবার বললেন। অতঃপর বলেন ঃ মুমিন বান্দা যখন দুনিয়া ত্যাগ করে আখেরাতে পাড়ি জমানোর প্রাক্কালে উপনীত হয় তখন সূর্যের ন্যায় আলোকিত চেহারাবিশিষ্ট একদল ফিরিশ্তা আকাশ থেকে অবতীর্ণ হন। যাদের হাতে জান্নাতী কাফন ও জান্নাতী সুগন্ধী থাকে।
অতঃপর তারা এসে ঐ ব্যক্তির দৃষ্টি সীমার মধ্যে উপবিষ্ট হন, এমতাবস্থায় মালাকুল মউত এসে যান এবং বলেন ঃ এসো হে পবিত্র আত্মা, আল্লাহ্র পক্ষ হতে ক্ষমা ও সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এসো। তারপর রূহ্ বেরিয়ে আসে; যেমন কলসী থেকে পানি সহজেই বেরিয়ে আসে। অতঃপর তা পলকের ভেতরই (অপেক্ষমান ফিরিশ্তারা) উক্ত জান্নাতী কাফনের মধ্যে জড়িয়ে নেন। যা পৃথিবীর সেরা সুগন্ধীর চাইতে উত্তম সুগন্ধীযুক্ত হয়। ফিরিশ্তাগণ উক্ত রূহকে নিয়ে সপ্তম আসমানে উঠে যেতে থাকেন।
রাস্তায় প্রতিটি আসমানের ফিরিশ্তাগণ জিজ্ঞাসা করলে দুনিয়ায় উচ্চারিত সর্বাধিক সম্মানসূচক নামসমূহের চাইতে অধিক সম্মানসূচক নামে অমুকের পুত্র অমুক বলে তার পরিচয় দেয়া হয়। [/গাঢ়]
[গাঢ়]এভাবে সপ্তম আসমানে পেঁৗছে গেলে আল্লাহ্ বলেন ঃ আমার বান্দার আমলনামা 'ইল্লীঈনে' (সর্বোচ্চ ও সপ্তম আসমানে অবস্থিত মুমিনদের রূহসমূহের অবস্থান স্থল) রেখে দাও। অতঃপর রূহকে পৃথিবীতে তার দেহে ফেরৎ নিয়ে যাও। তখন তার রূহ তার দেহে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর মুনকির ও নাকীর নামক (মিশমিশে কৃষ্ণকায় পীত চক্ষুবিশিষ্ট) দু'জন ফিরিশ্তা কবরে এসে মৃত মুমিন ব্যক্তিকে উঠিয়ে বসিয়ে দেন।
অতঃপর তারা প্রশ্ন করেন ঃ তোমার প্রভু কে? তিনি বলেন ঃ আমার প্রভু আল্লাহ্। দ্বিতীয় প্রশ্ন করেন ঃ তোমার দ্বীন কি? তিনি বলেন ঃ আমার দ্বীন হলো ইসলাম। তৃতীয় প্রশ্ন করেন ঃ এই ব্যক্তিটি কে? যাকে তোমাদের মাঝে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বলেন ঃ আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর রাসূল। ফিরিশ্তাদ্বয় বলবেন ঃ কিভাবে তুমি এটা জানলে? তিনি বলবেন ঃ আমি আল্লাহ্র কিতাব পড়েছি এবং তার উপর ঈমান এনেছি ও সত্য বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছি। [/গাঢ়]
[গাঢ়]এই সময় আসমান থেকে একজন আহ্বানকারী আওয়াজ দিবেন ঃ আমার বান্দা সঠিক কথা বলেছে, তাকে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও, তাকে জান্নাতের পোষাক পরিয়ে দাও, তার জন্য জান্নাতমুখী একটি দরজা খুলে দাও।
অতঃপর জান্নাতের সুবাতাস ও সুগন্ধী তার নিকট আসতে থাকবে এবং তার দৃষ্টি সীমা পর্যন্ত তার কবরের বিছানা প্রসারিত করা হবে। এমন সময় একজন সুন্দর চেহারাবান ব্যক্তি সুগন্ধীযুক্ত ও সুন্দর পোষাক পরিধান করে সেখানে উপস্থিত হবে ও তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলবে ঃ আজকের দিনের জন্য আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। যে দিনটির জন্য আপনাকে ওয়াদা করা হয়েছিল। কবরস্থ মুমিন ব্যক্তি তখন বলবে ঃ কে তুমি? সে বলবে ঃ আমি আপনার ভাল কাজ। তখন মুমিন ব্যক্তি আনন্দের সাথে বলে উঠবে ঃ হে প্রভু, কেয়ামত দিন! হে প্রভু, কেয়ামত দিন! আমি আমার পরিবার ও সম্পদের কাছে ফিরে যাব।
[/গাঢ়]
[গাঢ়]কিন্তু যদি মৃত ব্যক্তি কাফের হয়, তাহলে তার রূহ কবজ করার পর্যবেক্ষণে কালো চেহারাবিশিষ্ট ফিরিশ্তার আগমন ঘটবে। যাদের হাতে (চট জাতীয়) মোটা কাপড় থাকবে। তারা এসে ঐ ব্যক্তির দৃষ্টিসীমার মধ্যে উপবিষ্ট হবেন, এরপর মালাকুল মউত এসে তার মাথার কাছে বসে বলবেন ঃ হে অপবিত্র আত্মা, তোমার প্রভুর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধের দিকে বেরিয়ে এসো। অতঃপর তিনি তার রূহ্ টেনে বের করবেন এমনভাবে যেমন বাঁকা ধারবিশিষ্ট লোহার শিককাঠি পশমের মধ্য থেকে টেনে-ছিঁড়ে বের করে আনা হয়। তারপর সেটাকে ফিরিশ্তাগণ উক্ত মোটা কাপড়ের মধ্যে মুড়ে নেবেন।
যা থেকে পৃথিবীর সর্বাধিক দুর্গন্ধযুক্ত পঁচা লাশের গন্ধ বেরুতে থাকবে। এটাকে নিয়ে ফিরিশ্তাগণ ঊধর্্ব আসমানের দিকে উঠে যেতে থাকবেন। রাস্তায় অন্য ফিরিশ্তাগণের প্রশ্নের জবাবে তারা দুনিয়ায় তার নামে উচ্চারিত সর্বনিকৃষ্ট নামে অমুকের পুত্র অমুক বলে পরিচয় করিয়ে দেবেন। এভাবে তারা দুনিয়ার আসমানে অর্থাৎ, প্রথম আসমানে পেঁৗছে পরবর্তী আসমানের দরজা খোলার অনুমতি চাইলে তা আর খোলা হবে না। এ সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা আল-আ'রাফের 40 নং আয়াতটি পাঠ করেন।
যার অর্থ, "তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হবে না। তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে না। এটা তাদের জন্য এমনই অসম্ভব, যেমন অসম্ভব সূচের সংকীর্ণ ছিদ্রপথে উটের প্রবেশ করা। "[/গাঢ়]
[গাঢ়]অতঃপর আল্লাহ্ বলবেন ঃ তার আমলনামা যমীনের সর্বনিম্নে 'সিজ্জীনে' (জাহান্নামীদের রূহসমূহের অবস্থানস্থল) রেখে দাও। তারপর তার রূহ ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হবে, যা তার দেহে ফিরে যাবে।
এসময় আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা আল-হাজ্জের 31 নং আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। যার অর্থ, "যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সাথে শরীক করলো, সে যেন আসমান থেকে ছিটকে পড়লো। আর মাংসভোজী পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে দূরবর্তী কোন স্থানে নিক্ষেপ করলো। " ঐ ব্যক্তির রূহ্ তার দেহে ফিরে যাবার পর মুনকার ও নাকীর ফিরিশ্তাদ্বয় এসে তাকে উঠিয়ে বসাবেন ও পূর্বের তিনটি প্রশ্ন করবেন।
তোমার রব কে? সে বলবে ঃ হায়! হায়! আমি জানি না! তারা জিজ্ঞাসা করবেন ঃ তোমার দ্বীন কি? সে বলবে ঃ হায়! হায়! আমি জানি না! তারপর তারা জিজ্ঞাসা করবেন ঃ তোমাদের মাঝে যে লোকটিকে প্রেরণ করা হয়েছিল সে কে? সে বলবে ঃ হায়! হায়! আমি জানি না![/গাঢ়]
[গাঢ়]এ সময় আসমান থেকে একজন আহ্বানকারী আওয়াজ দিয়ে বলবেন ঃ সে মিথ্যা বলেছে, তাকে জাহান্নামের বিছা্না বিছিয়ে দাও! তার জন্য জাহান্নামমুখী একটি দরজা খুলে দাও! অতঃপর জাহান্নামের উত্তাপ ও বিষাক্ত বাতাস তাকে স্পর্শ করবে। তার কবর এমন সংকীর্ণ হয়ে যাবে যে, দেহের পাঁজর এপাশ থেকে ওপাশে চলে যাবে। এমন সময় কুৎসিত চেহারার দুর্গন্ধযুক্ত একজন লোক তার নিকট এসে বলবে ঃ তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর আজকের দিনের, যা তোমাকে মলিন করেছে। যে দিনের ওয়াদা তোমাকে আগেই দেয়া হয়েছিল। সে জিজ্ঞাসা করবে ঃ তুমি কে? তোমার চেহারায় অমঙ্গলের ছাপ রয়েছে? সে বলবে ঃ আমি তোমার খারাপ কাজ।
তখন লোকটি বলবে ঃ হে প্রভু! কেয়ামত দিবেন না। ' [আহমাদ, আবু দাউদ, হাকেম। ইমাম হাকেম বলেন ঃ ইমাম বুখারী ও মুসলিম হাদীস গ্রহণ করার যেসব শর্ত আরোপ করেছেন, এ হাদীসটি তার অন্তভর্ুক্ত। ] [/গাঢ়]
[গাঢ়]প্রতিটি মানুষই মৃতু্যর স্বাদ গ্রহণ করবে। [/গাঢ়] [সূরা আলে-ইমরান ঃ 185] সুতরাং আমাদের কি ভেবে দেখার সময় আসেনি যে, কেমন হবে সে দিনটি; যেদিন আমাকে চলে যেতে হবে, যেদিন আমাকে নিয়ে যেতে আসবে কেউ।
আমার সাথে কেমন হবে তাদের আচরণ, তারপর কি হবে, কোথায় যাবো আমি, সেখানে কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য; এমন প্রশ্নমালা মনে জাগরিত করার কি সময় আসেনি আমাদের? মূল কথা তো এই যে, জানা আর অজানা মাঝে পার্থক্য সীমাহীন, যে জানে সে অবহেলার কারণে আজ মানতে না পারলেও কোন একদিন ভাল কাজ করার তৌফিক সে পেতে পারে; সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যে আদতেই জানে না, তার জন্য তো সে সম্ভাবনাটুকুও রইলো না। তাই আমাদের উচিত যেদিকে সময়ের ধাপ ধাপ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, সে অজানা ভুবনটি সম্পর্কে জানা। তাহলেই মাত্র সম্ভব অনাগত দিনের জন্য কিছু সঞ্চয় করার, জীবনকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে নেয়ার এবং পরবর্তী জীবনেও সাফল্য ও অনন্ত সুখ লাভ করার। আল্লাহ্ আমাদের তৌফিক দান করুন।
আমীন। । ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।