আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যার পর নাই কৃতজ্ঞতা: মাসুদা ভাট্টি, রেজওয়ান পরিবার, সুমন চৌধুরী, ধূসর গোধুলী এবং অবশ্যই সামহোয়্যারের প্রতি

যে ঘড়ি তৈয়ার করে - সে - লুকায় ঘড়ির ভিতরে

ইউরোপিয়ান সোসাইটি ফর প্রিসিশন ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ন্যানোটেকনোলজি বা সংেেপ ইউএসপেন এর কনফারেন্সের সুবাদে ইউরোপ ঘুরে যাওয়া হলো এবার। ইউনিভার্সিটি থেকে একটা বড় খরচ এবং কনফারেন্স কমিটি থেকে স্কলারশিপ না পেলে আমার মতো গরীবের জন্য নিজ খরচে এরকম ইউরোপ ঘোরা কল্পনারও অতীত ছিলো। বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা সুযোগ পাওয়ার জন্য। যখন কনফারেন্সে পেপার পাবলিশ হওয়ার অনুমোদন মিললো তখন ভাবছিলাম এই সুযোগে প্রায় দু'বছর ধরে জমানো স্কলারশিপের টাকা দিয়ে ইউরোপের আরো কয়েকটা দেশ ঘুরে দেখলে মন্দ হয় না (যদিও জানি এটা বিশাল একটা রিস্ক হয়ে যাচ্ছে, কারন খুব বেশি টাকা ছিলো না। তারপরেও মিস্টিকদের টাকার কথা ভাবতে হয় না, তাই ভাবি নাই)।

সিংগাপুরে থাকার সুবাদে এশিয়ার মানুষ এবং সংস্কৃতির সাথে পরিচিতি ঘটলেও পশ্চিমা দুনিয়াটা অজানাই রয়ে গিয়েছিলো। তাই এটা একটা বড় সুযোগ ছিলো পশ্চিমকে দেখার, আধুনিক সভ্যতার অন্যতম তীর্থস্থান ইউরোপ এবং তার মানুষকে দেখার। এই পোস্টের উদ্দেশ্য আমার ভ্রমন নয়, বরং সামহোয়্যারের মাধ্যমে পরিচয় হওয়া অনেকগুলো মানুষের কাছ থেকে যে অপ্রত্যাশিত সাহায্য, স্নেহ এবং ভালোবাসা পেয়েছি তার একনলেজ করা এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। মানুষের প্রতি প্রথমে কৃতজ্ঞ হও, তইে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া যায় - আমার ধর্ম আমাকে সেটাই শিখিয়েছে। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই এই পোস্ট।

প্রথমে আসি মাসুদা ভাট্রির কথায়। লিভারপুল স্টেশন, লন্ডন। এয়ারপোর্ট থেকে সেখানে পৌছে পরিচিত একজনের মাধ্যমে পাওয়া মাসুদা ভাট্রির টেলিফোন নম্বরে ডায়াল করছিলাম বুথ থেকে। ব্যর্থ হলাম অনেকবার। অবশেষে একজন পথচারী দেশি ভাইয়ের সাহায্যে মোবাইল থেকে ডায়াল করে পাওয়া গেলো মাসুদা ভাট্রিকে।

আমার অবস্থান জানাতে জানালো ওখানে ম্যাকডোনালডে বসতে। উনি আসছেন। ফোনেই গলায় আন্তরিকতা উষ্ণতা টের পেয়েছিলাম। অনেকক্ষন বসতে হবে মনে করলেও খুব দ্রুতই মাসুদা এসে হাজির। চেহারায় শার্প একটা বুদ্ধিমত্তার ছাপ, আটপৌরে পোশাক, হাতে অফিসের কাগজপত্র।

জানালেন তার অফিস খুব একটা দুরে নয়। সেদিন তার কাজ শেষ হতে দেরী হয়েছে। তারপরেও সেই ক্লান্ত শরীরেই আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করেই আমার একটা ভারী ব্যাগ এক হাতে টেনে নিয়ে চললেন আমার জন্য হোটেল বা হোস্টেল খুজতে। প্রথম জায়গা ব্যর্থ হলাম আমরা। কোন রুম খালি নেই।

আমার কাছে কিছু ঠিকানা ছিলো, সেটা দেখাতে আবার আমার ভারী ব্যগ টেনে উনি হনহন করে চললেন আমাকে বাস স্টপে। কোন বাসে এবং কোন ট্রেনে উঠলে যেতে পারবো খুব সতর্কভাবে বুঝিয়ে দিলেন। মাসুদার চোখে মুখে অফিস ফেরত ক্লান্তি দেখে আমি ওনাকে আর আটকাতে চাইনি। ওনার বাস চলে আসতেই বিদায় জানালাম। খুব অল্প সময়েই কথা হয়েছে ওনার সাথে।

কিন্তু সেই অল্প সময়ের ভিতরেই মাসুদার ভিতরে একটা সাহায্য করার জন্য ব্যতিব্যস্ত একটা সত্তাকে দেখেছি আমি, অনুভব করেছি সহজে অপরিচিতকে আন্তরিক করার সংকল্প, নি:সংকোচ মনোভাব এবং সবচেয়ে বড় কথা হৃদয়ের উষ্ণতা। লন্ডনে খুব অল্প সময়ের জন্য ছিলাম, ইউকেতে আমার মূল গন্তব্য ছিলো ম্যানচেস্টার। তাই মাসুদার সাথে সেই শেষ দেখা, শেষ কথা। হয়তো সেদিন ঠিক মত ধন্যবাদ জানাতে পারিনি আপনাকে, এই সুযোগে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনার প্রতি। আমার এই ইউরোপ সফরের পুরোটা সময়ে (প্রায় 21 দিন) সবচেয়ে আরামে ছিলাম আমি যেখানে সেটা হলো বার্লিন, জার্মানীতে; রেজওয়ান পরিবারে।

রেজওয়ান ভাইরের সাথে পরিচয় সামহোয়্যারের আগেই, ওনার ইংরেজী ব্ল্লগের মাধ্যমে। বাংলাদেশী ব্ল্লগারদের ভিতরে আনর্্তজাতিক পরিমন্ডলে সবচেয়ে পরিচিত নাম হলো রেজওয়ান। উনি গ্লোবাল ভয়েস থেকে শুরু করে অনেকগুলো উঁচুমাপের ব্লগ পরিমন্ডলে যুক্ত এবং নিজের সুখ্যাত ইংরেজী ব্লগ (থার্ড ওয়ার্ল্ড ভিউ, http://rezwanul.blogspot.com) এর মাধ্যমে ভেটেরেন ব্ল্লগার বলা যায়। ঢাকা থেকে কয়েকমাস আগে বার্লিনে আসা রেজওয়ান ভাই যখনই শুনেছেন আমি জামর্ানী যাচ্ছি তখনই জানিয়েছিলেন তার বাসায় ওঠার জন্য। প্রায় অনেকগুলো দিন একটানা ইউরোপে একা একা কাটিয়ে আমি যখন একাকীত্বে কান্ত তখন বার্লিনের শোয়েনফিল্ড এয়ারপোর্টে নেমে রেজওয়ান ভাইয়ের রিসিভ করতে আসা আমার জন্য ছিলো বিরাট পাওয়া।

বেচারা নতুন কেনা গাড়িতে, নতুন আসা অপরিচিত শহরে অনেক বেশ কষ্ট স্বীকার করেই চলে এসেছিলেন আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে। আরেকটা বড় পাওয়া ছিলো তার অসম্ভব সুন্দর পরিবার এবং বাড়িতে প্রায় তিনদিন সময় কাটানো। ওনার পিচ্চি রিয়ান্নাটা যে সুইট বলার মতো না। বয়স এখনো দুই হয় নি। আংকেলের (আমি) সাথে তার বেজায় খাতির হতে কয়েকঘন্টা সময় লেগেছিলো মাত্র।

দূদর্ান্ত গাইডের মতো আড়াইদিন আমরা ঘুরে বেরিয়েছি বার্লিনের মূল জায়গাগুলোতে, খোলা আকাশের নিচে মেগাপর্দায় হাজার মানুষের ভিড়ে বিশ্বকাপ দেখতে গিয়েছি। আর অনেকগুলো দিন একটানা চাছাছোলা ইউথ হোস্টেলগুলোতে দিনযাপন করে রেজওয়ান ভাইয়ের আলিসান বাসায় থাকাটা ছিলো যেন আমার মতো গরীবের রাজপ্রাসাদে বসবাস। রেজওয়ান ভাই অনেক কষ্ট করে পথে পথে ঘুরেছেন আমাকে নিয়ে, অনেকগুলো সময় দিয়েছেন তার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। সব ভালো যার শেষ ভালো তার। ইউরোপ ভ্রমন শেষ হওয়ার ঠিক আগে ফ্রাঙ্কফুট থেকে সিংগাপুরের প্লেনে ওঠার আগে কাসেল ছিলো আমার শেষ গন্তব্য।

আইসিং অন দি কেক এর মতো দারুনভাবে শেষ হলো আমার ইউরো ট্রিপ, থ্যাংকস টু সুমন চৌধুরী (এবং ধুসর গোধুলী)। সুমন ভাইয়ের ল্যাটকা খিচুড়ির লোভেই বলা যায় কাসেল গমন। বন, ফ্রাঙ্কফুট, কোলনসহ জামর্ানীর অনেক নাম করা শহরেই আমি যেতে পারতাম। কিন্তু সামহোয়্যারের পরিচিত মানুষ বলে কথা। তাই কাসেলই সই।

সুমন তার কাজের ব্যস্ততা, ইউনিভার্সিটির ঝামেলা ইত্যাদি সব পেছনে রেখে সময় দিয়েছেন আমাকে যেটা ছিলো পুরো অপ্রত্যাশিত। ইচ্ছে করলেই আমাকে শহর চিনিয়ে দিয়ে তিনি নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতে পারতেন। তা না করে, শরীর খারাপ থাকা সত্ত্বে (চোখে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে, প্রেসার থেকে) আলো না ওঠা ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত আমার সাথে হেটে বেরিয়েছেন কাসেল এবং এর চারপাশে। ওনার সাথে গল্প করে বেশ মজা পেয়েছি। ব্ল্লগের বিভিন্ন চরিত্র থেকে শুরু করে, সোস্যালজির কঠিন তত্ত্ব, জামাতী কেচ্ছা, প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য জোকস, মডার্নিজম এবং পোস্ট মডার্নিজমের মধ্যে পার্থক্য, জার্মানীতে ছাত্রদের পড়াশুনা, বাঙ্গালীদের কান্ডাকারখানা, চাকুরীর অবস্থা এমনিক ল্যাটকা খিচুড়ির মেনু হ্যান বিষয় নাই যা নিয়া আলাপ হয় না।

জার্মানীতে এসে পৌছানোর পরেই ধূসর গোধুলী যোগাযোগ করেছিলো টেলিফোনে। আলাপ হলো সদাহাস্য গোধুলীর সাথে। ও থাকে কাসেল থেকে বেশ দূরে এবং একই সাথে উইক ডেইজ হওয়ায় আগে আসতে পারে নি। একেবারে আমি যেদিন ফ্লাই করবো সেইদিন 1 ঘন্টা আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে এসে হাজির বেচারা। অত:পর সুমন, আমি এবং ঝড়ো হাওয়ার কফি খেতে খেতে আড্ডা।

তার আগে কয়েক চক্কর পুরো এয়ারপোর্টে ফুড কোর্ট খুঁজে বেড়ানো। ঠিক যখন আড্ডা জমে উঠছিলো এবং সুমন ও ঝড়ো হাওয়া বেড়ানোর বিভিন্ন প্ল্যান প্রায় করে আসছিলো তখনই ঘড়ির দিকে চোখ পড়লো। যেতে হবে ডিপারচার গেটের দিকে। অবশেষে কোলাকুলি এবং বিদায় জানানোর পালা। কৃতজ্ঞতা সুমন ও ঝড়ো হাওয়া।

কাজ ফেলে, কষ্টের উপার্জনের পয়সা খরচ করে এতদূর এসে এই যে দেখে যাওয়া, এই যে সময় দেওয়া এ সবের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে আর ছোট করছি না। সবশেষে ধন্যবাদ সামহোয়্যারকে, অনেক অনেক। কারন সামহোয়্যার না থাকলে হয়তো কখনোই পরিচয় হতো না সিংগাপুরে থাকা সাদিক এবং জামার্নীর কাসেলের সুমন অথবা বনের ঝড়োর সাথে। হতো না মাসুদা ভাট্রি অথবা রেজওয়ান ভাইয়ের সাথে। অনেক কৃতজ্ঞতা এই দুনিয়া ব্যাপী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করার জন্য।

থ্রি চিয়ার্স ফর সামহোয়্যার, হিপ! হিপ! হুররে !!! লিখছি দোহা, কাতার এয়ারপোর্ট থেকে। অপেক্ষায় আছি পরবতর্ী কানেক্টিং ফাইটের জন্য। সময় রাত 8:33। লোকাল দোহা সময়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।