বাবা এখন প্রায়ই গর্ব করে বলেন, ভাগ্যিস ওই নেমকহারামটাকে শেষ করা গিয়েছিল নইলে ওর বংশধরদের হাতে আমাদেরই মরতে হতো। অবশ্য আজকের বাংলাদেশ নিয়ে বাবার হতাশার অনত্দ নেই। বলেন, বাংলাদেশের যে এই অবস্থা হবে তাতো আগে থেকেই জানতাম। আমরা বলেওছিলাম, এই জাতি স্বাধীনতার যোগ্য নয়। আরও পঞ্চাশ বছর লাগবে বাঙালিকে স্বাধীনতা ভোগের উপযোগী করে তুলতে।
আরে বাবা, যে জাতি নিজের ধর্ম পরিচয় জানে না, বলে তারা নাকি বাঙালি, আরে মুসলমানের আবার অন্য কোনও জাত পরিচয় কি? সবার আগে ও সবার পরে, সবখানেতেই সে মুসলমান। অথচ একাত্তরে এই জাতিকে এটা আমরা বোঝাতে পারলাম না, নয় মাস তারা ভারতে গিয়ে, ভারতের সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ করলো। পাকিসত্দানী সেনারা এই বর্ষা আর জল-কাঁদার দেশে কি করে পারবে ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করে? তাছাড়া ঠিকমতো রসদও তো পায়নি পাকিসত্দানী সেনা বাহিনী। ওই অতোটা পথ ঘুরে শ্রীলঙ্কার উপর দিয়ে উড়ে এসে কি এরকম একটা দেশ টিকিয়ে রাখা যায়, যেখানে প্রতি দশজনে নয়জনই গাদ্দার, নেমকহারাম আর হিন্দুর দালাল!!!
বাবার কথা মাঝে মাঝে ভাবি, ভাবি একাত্তরে পাকিসত্দানী সেনা বাহিনীর কতোই না অসুবিধে হয়েছে বাংলাদেশে যুদ্ধ করতে। আর বেজন্মা বাঙালি ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাকিসত্দানী সেনা বাহিনীর সঙ্গে লড়েছে।
এই জন্য আলস্নাহ্ তাদের কোনও দিনই ৰমা করবে না। করা উচিত নয়। আরে তোরাতো পাকিসত্দানী জাতির বিরম্নদ্ধেই শুধু অস্ত্র ধরিসনি, অস্ত্র ধরেছিস ইসলামের বিরম্নদ্ধেও। এই জাতির কপালে দুঃখ থাকবে না তো আর কার কপালে থাকবে, বলুন? সুখের কথা হলো, আমাদের দিন ফিরে আসছে, বাংলাদেশও পাকিসত্দানের মতো একটি ধর্মরাষ্ট্র হতে আর বেশি দেরি নেই। মাত্র পয়ত্রিশ বছরের মাথায় এসেই আমার বাবাদের স্বপ্ন পুরণ হতে চলেছে।
কিন্তু সে জন্য বাবাদের ত্যাগও কম করতে হয়নি। এখন সেই সব ত্যাগের কথাই বলবো আমি।
একাত্তরের শেষ দিকে যখন বোঝা যাচ্ছিলো যে, ভারত যে কোনও মুহূর্তে পাকিসত্দান আক্রমণ করবে আর সে কারণে পাকিসত্দানের পৰে জয়লাভ করা কখনওই সম্ভব হবে না তখন আমার বাবারা গোপন ও জরম্নরী এক বৈঠকে বসেন ঢাকায়। সেই বৈঠকের নেতৃত্ব দেন গোলাম আজম। বৈঠকের আগে গোলাম আজম সাহেব বাবার সঙ্গে নাকি দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন, তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে।
বিশেষ করে তারা আসন্ন পরাজয়কে সাময়িক ও ভবিষ্যত বিজয়ের পথে প্রথম ধাপ হিসেবে মনে করতেন। সেই বৈঠকেই নির্ধারিত হয় যে, বাবাদের দলের নেতারা যে যেভাবে পারেন দেশের ভেতরে কিংবা দেশের বাইরে আত্মগোপন করবেন। প্রয়োজনে প্রথমে পাকিসত্দানে চলে যেতে হবে এবং সেখান থেকে বিভিন্ন দেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হবে। এ জন্য বিশেষত ব্রিটেনকেই টার্গেট করা হয়েছিল। তবে সৌদি সরকার আমাদের বাবাদের কথা দিয়েছিল যে, তারা সবাইকেই আশ্রয় দিতে প্রস্তুত।
সেই সিদ্ধানত্দ অনুযায়ী দশই ডিসেম্বর বাবাদের দলের অনেক বড় বড় নেতাই পাকিসত্দান চলে যান। বাবাও মাকে সঙ্গে নিয়ে পাকিসত্দানে আসেন। তবে তার আগে পাকিসত্দান সেনা বাহিনীর অন্যতম প্রধান রাও ফরমান আলীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন বাবারা এবং রাও ফরমান আলীর হাতে একটি বিশেষ লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয় সেদিন। এই লিস্টে যারা পাকিসত্দান ও ইসলামের শত্রম্ন, তাদের নাম ও ঠিকানা লিখা ছিল। রাও ফরমান আলী বাবাদের সেদিন কথা দেন যে, চৌদ্দই ডিসেম্বর এই লিস্টের সকল ব্যক্তিকে এলিমিনেট করা হবে।
পরে বাবা প্রায়ই কথায় কথায় বলতেন, "ভাগ্যিস সেদিন এই লিস্টটি ফরমান সাহেবের হাতে তুলে দিতে পেরেছিলাম। বাঙালিকে মেধাশূন্য করেছিলাম বলেই আমরা আমাদের বিজয়ের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছি নতুন প্রজন্মকে এবং সেই অনুযায়ী কাজও শুরম্ন করা গিয়েছে, লিস্টের ওরা বেঁচে থাকলে আমাদের পৰে এতো তাড়াতাড়ি এই সাফল্য আসতো না কখনওই। "
ঃ লিস্টে ক'জনের নাম ছিল বাবা? _ আমি প্রশ্ন করি।
ঃ এখন মনে করতে পারি না মা, তবে হঁ্যা কমপৰে তিন হাজার ব্যক্তির নাম ছিল ওই লিস্টে। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰক, কেউ লেখক, কেউ কবি, কেউ বা ছবি অাঁকে, কেউ গায়ক এবং অনেক আওয়ামী লীগ নেতা।
ঃ মাত্র তিন হাজার? _ আমার আশ্চর্য লাগে বাবাদের বোকামিতে।
ঃ আরে তিন হাজারের লিস্টতো মাত্র আমিই দিয়েছি, আমার মতো আরও প্রায় কয়েকশ ব্যক্তি এরকম লিস্ট তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ধর, প্রতি জনে যদি গড়ে তিন হাজার জনের লিস্টি দেয়, তাহলে সংখ্যাটা কতো হয়?
ঃ নাহ্ বাবা, তোমরা আমাদের মতো আধুনিক নও, আমরা হলে কিন্তু একজনকেও ছাড়তাম না, প্রয়োজনে ম্যাসিভ অ্যাটাক হতো, বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সব শেষ করে ফেলতাম।
ঃ সেটা সত্যি কথা, তোমাদের মতো আমরা আধুনিক নই। তখন এরকম আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও ছিল না।
কিন্তু আমরা যা করেছি তার মূল্যও কম নয়, আমাদের কারণেই আজ তোমরা একটি দেশের অসত্দিত্বে বিশ্বাস না করেও সেই দেশের রাষ্ট্র ৰমতার স্বাদ পাচ্ছো। এটা ভুলে যেও না।
ঃ সেটা অবশ্য খুবই সত্যি কথা। তারপরও আমার মনে হয়, তখন যদি তোমরা আরও শক্ত হতে পারতে তাহলে পাকিসত্দানও ভাঙতো না আর আজকে আমাদের এরকম নতুন করে বোমা বিস্ফোরণও ঘটাতে হতো না।
ঃ ইসলাম জিন্দা হোতে হ্যায় হর্ কারবালে কে বাদ - এই কথাটা জানো তো, এটা মনে রেখো, তাহলেই চলবে।
বাবার সঙ্গে আমার যখনই এসব নিয়ে কথা হয়, বাবা তখনই এই কথাটা আমাকে শোনান। একাত্তরে পাকিসত্দানে বসেই বাবা তার লিস্টে দেওয়া নামগুলির চিহ্ন মিটিয়ে দেওয়ার কাজটি করেন চৌদ্দই ডিসেম্বর। বাবার সহযোগী ও বন্ধু চৌধুরী মঈনুদ্দিন চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰকদের বহন করার জন্য যে ক'টি গাড়ি ছিল তার রৰণাবেৰণ ও মাঝে মাঝে শিৰকদের আনা-নেওয়ার কাজও করতেন। তিনি চৌদ্দই ডিসেম্বর বাবার দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী শিৰকদের বহন করে নিয়ে যান রায়েরবাজারে, সেখানেই পাকিসত্দানী সেনা বাহিনী এইসব গাদ্দারদের শেষ করে আজকে আমাদের জিহাদের পথকে পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে _যাজাকুলস্নাহ্ খাইর।
পাকিসত্দানে গিয়ে বাবা প্রথমে একটি স্কুলে শিৰকতা শুরম্ন করেন।
এরই মধ্যে খবর পান তথাকথিত স্বাধীন বাংলাদেশে বাবার সহযোগীদের বিরম্নদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তাদেরকে শাসত্দি দেওয়ার জন্য দালাল আইনও করা হয়েছে। পাকিসত্দানের করাচী শহরে বাবারা আবার একটি বৈঠকে বসেন এবং এই বৈঠকে সিদ্ধানত্দ নেওয়া হয় যে, বিদেশের বিশেষ করে সুপার পাওয়ারকে দিয়ে শেখ মুজিবের ওপর চাপ দেওয়া হবে যাতে দালাল আইনে যাদের ধরা হয়েছে তাদেরকে যেনো যুদ্ধবন্দীর মর্যাদা দেওয়া হয়। কারণ তারাতো পাকিসত্দানী সেনা বাহিনীর মতো পাকিসত্দানের জন্যই যুদ্ধ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। এই বৈঠকে পাকিসত্দানী উর্দ্ধতন কতর্ৃপৰ ও সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তিনিই মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।
তখন অবশ্য এই সদ্য গজানো আক্কেল দাঁত নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির আসরে চলছে মাদারির খেলা। ফলে বাবাদের উদ্দেশ্য সফল করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। তারপরও দেশের ভেতরে সাধারণ মানুষের হাতে বাবাদের অনেক সহযোগী ও নেতারা নিহত হন।
বাবা এখনও প্রায়ই বলেন, "আহা যদি তারা বেঁচে থাকতেন তাহলে পয়ত্রিশ বছর লাগতো না, তার আগেই আমাদের উদ্দেশ্য কায়েম হতো। আর কুলাঙ্গার শেখ মুজিব যদি দালাল আইন আর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ না করতো তাহলে তার মরণ আরও আগে হতো, বাংলাদেশেও ইসলামী আইন কায়েম করতে আমাদের বেশি সময় লাগতো না।
তবে আমাদের অসুবিধে হয়নি, আমরা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে পেয়েছিলাম, প্রথম থেকেই। সেই সত্তরের দশকের প্রথমেই জিয়াউর রহমানকে পাকিসত্দানী বাহিনী কাজে লাগিয়েছিল বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্পর্কে তথ্য জোগাড়ের জন্য। জিয়াউর রহমানই একমাত্র বিশ্বাসভাজন বাঙালি অফিসার যাকে ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স টিমের একটি ভালো রকমের পদ দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমান আজীবন, মৃতু্য পর্যনত্দ বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি, তোমাকে মনে রাখতে হবে এই জিয়াউর রহমানের জন্য আমরা বাংলাদেশে নতুন করে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছি; জিয়াউর রহমানের জন্য পাকিসত্দানী সেনা বাহিনী একাত্তরে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সমসত্দ তথ্য অর্থাৎ তারা কবে কোথায় কখন কিভাবে আক্রমণ চালাবে সেইসব তথ্য জিয়াউর রহমানইতো দিতেন; তারপরে শেখ মুজিব হত্যার কথাই যদি ধরো, এটাতো আর কেউ নয় জিয়াউর রহমানকে দিয়েই পাকিসত্দানী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা অত্যনত্দ সফলতার সঙ্গে শেষ করতে পেরেছিল, সিআইএ ও আইএসআই-এর যৌথ পরিচালনায় শেখ মুজিব হত্যার চেয়ে বড় কোনও সাফল্য একটাও আছে কি? নেই। তারপরে জিয়াউর রহমান নিজ হাতে যতো মুকিযোদ্ধা সেনা অফিসারকে হত্যা করেছেন, তাতে তো আমাদের কাজ তিনি একাই অর্ধেক শেষ করে রেখে গিয়েছেন।
সংবিধান পরিবর্তন করে বিসমিলস্নাহ্ সংযোজন যদিও দেখানেপনা ছিল, আসল উদ্দেশ্য ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার নামে আমাদের ধর্ম-রাজনীতির সুযোগ করে দেওয়া_ আরও কতো কি বলা যায়, আসলে মওদুদী যদি আমাদের দলের সৃষ্টিকর্তা হন তাহলে রাসুল হচ্ছেন জিয়াউর রহমান। এটা কিন্তু আমাদের সব সময় মাথায় রাখতে হবে। এখনও দেখতে পাচ্ছো না, আমরা জিয়াউর রহমানের দলের মাথার ওপরই সুপারি আর ছুরতা রেখে সমানে রাজনীতির পান-শুপারি খেয়ে যাচ্ছি!"
বাবার সঙ্গে আলোচনা করার এটাই হচ্ছে মহা সুবিধে। বাবা সব জানেন, অনেক কথা বলেন, যা জানার পর মনে হয়, এুণি বোমা হাতে নেমে যাই, খতম করে দেই ওই সব বাঙালির বাচ্চাকে। যারা পাকিসত্দান ভেঙেছিল।
একাত্তরে মাত্র ত্রিশ লৰ মারা গিয়েছিল, এখন তো মারতে হবে অনত্দতঃ দশ কোটি, একাত্তরেই যদি অনত্দতঃ এক কোটিকে শেষ করা যেতো তাহলে আমাদের কাজ অনেক আসান হতো। কিন্তু বেটার লেট দ্যান নেভার_ এটাও বাবারই কথা। সময় ফুরিয়ে যায় না, প্রতিটি মুহূর্তই জিহাদ শুরম্নর জন্য উপযুক্ত। এবারের জিহাদ ত্রিশ লাখের নয়, দশ কোটির _ আর এবার পাকিসত্দানী সেনা বাহিনী নেই, যা করার আমাদেরই করতে হবে_ বাবার এই সব কথা আমাকে আরও সাহসী করে তোলে, আমার ভেতরে রক্ত গরম হয়ে ওঠে, আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। মনে হয় সিডনী হারভারের ওই ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আমি চিৎকার করে জিহাদের ডাক দেই।
বলি, ইসলাম জিন্দা হোতে হ্যায়, হর কারবালে কে বাদ. . . . .
(অসমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।