পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ
...অত:পর বছর গড়িয়ে যায়। গড়াতেই থাকে বছরের পর বছর। শহীদের রক্তে ভেজা জায়গা ধুয়ে-মুছে আমরা মিনার বানাই। হৃদপিন্ডের মধ্য থেকে ভালোবাসার লাল সূর্যটাকে খুলে এনে শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে দেই মিনারের গায়ে। প্রতিবছর- ফুলে ফুলে সাজাই তাকে।
মধ্যরাতে খালি পায়ে এসে গান গেয়ে যাই। কি সমধুর সেই গান- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি-। গাইতে গাইতে গলা বেয়ে অশ্রু ঝরে পরে। আহা, সেই অশ্রু যদি মাখিয়ে দিতে পারতাম ভাইয়েদের বুলেট-বিদ্ধ বুকের ক্ষতে!
একুশের সংকলনের পাতা ওলটাই আজ। অজস্র শ্রদ্ধানজলি সেখানে মুখের ভাষা ফিরিয়ে দেয়া সেই বীর শহীদদের জন্যে।
দেখে- পড়ে- শুনে ভাল লাগে। ভাল লাগা বাড়িয়ে যাই আমি। পাতা উলটে চোখে পড়ে - একুশের গল্প। জহির রাুহানের। কোন এক হবু ডাক্তার একুশের মিছিলে তার বন্ধুকে হারায় পুলিশের গুলিতে।
কপালের ঠিক মাঝখানটায় গুলি লাগে বন্ধুর। লাশ তুলে নিয়ে যায় সেনাবাহিনির লোকেরা। প্রায় বছর তিনেক বাদে তারই রুমমেট এনাটমি পড়ার জন্যে কঙ্কাল নিয়ে আসে। বাক্স খুলে সবাই দেখে প্রয়াত বন্ধুর মতন এর কপালেও একটা মসৃণ ফুটো, ডান পায়ের হাড়টা তেমনি এক ইঞ্চি ছোট বাম পায়ের চেয়ে।
পড়তে পড়তে শিউরে উঠি আমি।
বুকের মধ্যে টের পাই ব্যথার কাঁপন। মাথা ব্যথা করতে থাকে আমার- বিশেষ করে যেন কপালের মাঝখানটা!
ব্যথা পোহাতে পোহাতে গল্প রেখে ইতিহাস খুলি। অবাক বিস্ময়ে জানি- সেই দুপুরে গুলি লেগেছিলো রফিকের খুলিতেও। (রফিক, যে কিনা আমার ভাই। ) আমার ভাইকে চেনা যায় নি সেদিন।
কেউ কেউ ওকে সালাহউদ্দীন ( আমার আরেক ভাই) বলে ভুল করেছিলো।
আচ্ছা, সালাহউদ্দীন কি আজো দু:খ করে, কেন সে রফিক হতে পারলো না!
রফিকের মৃত্যুসংবাদ থেকে চোখ সরিয়ে নিই। যেমন করে প্রতিদিন সকালে মুখ মুছে দুরে ঠেলে দিই ভেজা টাওয়েল। একুশের কাহিনিতে অনাবশ্যক আগ্রহ টের পেয়ে আমার ভুরুরা কুঁচকে ওঠে। ' এটা তো ফেব্রুয়ারি নায়-, তবে?'।
মে মাসের আলোকোজ্জ্বল এই বিকেলে কেনই বা তবে ফেব্রুারির ধোঁয়াটে দুপুরকে টেনে আনা!
ভীষনই অপ্রয়োজনীয় ওরা। ঠেলে সরিয়ে আমি হেঁটে যাই সামনে। সামনে আর উপরে। উপরে, যেখানে তিনতলা বাড়ির চিলেকোঠায়- ঝাঁঝালো ধোয়ায় ডুবে যেতে যেতে আমার লেখক-বন্ধু সাদা কাগজের বুকে কল্পনা এঁকে যায়- কোন এক উর্দুভাষি পাকিস্তানীর কথা- বউ কথা কও নামের এক বাঙ্গালী পাখির ডাক শুনে যার কিনা প্রতি রাতে ঘুম ভেঙে যেত সেই '52-র রাতগুলোয়।
স্বপ্নের মত দিন পকেটে পুরে আমি ফিরে আসি আবার রফিকের কাছে।
ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে বইয়ের পাতায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি সালামের বুক। (সালাম, আমার ভাই)। ঠিক কতখানি বড় ছিল তোমার হৃদয়, ভাই? কি ছুঁয়েছিলে তুমি, পরশপাথর?
খুঁজতে থাকি। খুঁজতে থাকি। খুড়তে খুড়তে খুঁজে বেড়াই সেই পরশমণিকে।
খুঁজে পেলে, ছুঁয়ে নিতাম, ছুঁইয়ে নিতাম সবাইকে। ছোট্ট এ জীবনের অনেকগুলো শান্ত মিছিলের মধ্যভাগে হেঁটে চলা এই আমি আজ সামনে আসতে চাই- বুক পেতে চুমু খেয়ে দেখতে চাই শত্রুর বুলেট।
আমি জানি, মিছিলের সামনে এসে দাঁড়ানোর মতন মানুষের আজ বড়ই প্রয়োজন আমার জন্মভূমির।
-------------------
রিলেটেড লিংক:
1। http://www.banglalive.com/dhakarchithi/redirect.asp
2।
http://konfusias.blogspot.com/
3। ছবি: ইন্টারনেটে পাওয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।