ইন্টার্ন ভাইয়া বলে যাচ্ছেন, ''আমার ডিউটি সেদিন ছিল ট্রমা সেন্টারে। দুপুরের দিকে একজন পেশেন্ট আসলো। রোগীর সাথে দুইজন লোক। একজন দেখলাম তেমন কথা বলছে না, তবে চোখে দিশেহারা ভাব, অন্যজন বকবক করেই যাচ্ছে। ।
বিশাল জ্ঞানী। অন্য লোকটাকে বলছে, ''কি রকম রক্ত পড়ছে দেখছেন? এই রকম রক্ত পড়লে এই হয়ে যাবে সেই হয়ে যাবে। পা মনে হয় ভেঙে গেছে। '' পেশেন্টের আরটিএ (রোড ট্রাফিক এক্সিডেন্ট)। পা দিয়ে ভালোই ব্লিডিং হচ্ছে।
হাত দিয়ে ধরে বুঝলাম ফ্র্যাকচার হয়নি। স্টিচ দিলেই শেষ হয়ে যাবে। এক্স-রে করানোর পর প্যাডে সুচার (সুতা) আর ঔষধ লিখে দিলাম নিয়ে আসার জন্য। বেশি কথা বলা এটেন্ড্যান্ট কম কথাওয়ালাকে বলল, 'আপনি বসেন। আমি নিয়ে আসছি।
পরে টাকা দিলেই চলবে। ' লোকটা ঔষধ আনতে যাওয়ার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'লোকটা কে? আপনাদের আত্মীয়?' কম কথাওয়ালা উত্তর দিলো, 'না। এখানে আসার পরে দেখা। খুব ভালো লোক। আমাদের অনেক উপকার করছে।
' বুঝলাম দালাল। একটু পরে লোকটা সুচার আর ঔষধ নিয়ে আসলো। চারটা সুচার লাগলো। আমি নিজ হাতে স্টিচ দিলাম। প্রেসক্রিপশন লিখে দিলাম।
সবমিলিয়ে কত খরচ হয়েছে জানো?''
আমি বললাম, ''কত''?
- সুচারের দাম একটু বেশি। সুচার আর ঔষধ মিলিয়ে খুব বেশি হলে দাম ১৫০০ বা ২০০০ হবে। বিল এসেছিল কত জানো?
-কত?
-আন্দাজ করো।
-দালাল যেহেতু কিছু টাকাতো মারবেই। উউউউ... কত? ৩০০০-৪০০০?
-১২০০০ টাকা।
আমার লেগেছিল চারটা সুচার। বিল এসেছে ১২ টা সুচারের।
-কী বলেন? আপনি কিছু বলেননি কেন?
-আমি বললে হয়তো রোগী কিছু কম টাকা দিয়ে চলে যেতে পারতো? কিন্তু আমি রুমে যেতে পারতামনা। আমার হাত-পা ভেঙ্গে শুইয়ে রাখা হতো।
-!!!
-বিশ্বাস হচ্ছে না।
আরতো বেশিদিন নেই। তুমিও ইন্টার্ন করবে, তখন বুঝবে। আমাদেরতো প্রায়ই হুমকি দেয়া হয়, এই এই কোম্পানির ঔষধ লিখবেন। নাহলে রুমে যেতে পারবেননা। ড্রাগ লেখা নিয়ে আমার তেমন চিন্তা নেই।
মূল চিন্তাটা কী জানো? এই পেশেন্ট যদি কোনদিন জানে ২০০০ টাকার ট্রিটমেন্ট করে তার কাছ থেকে ১২০০০ টাকা নেয়া হয়েছে, সে যা বলবে তা হচ্ছে, শুওরের বাচ্চা ডাক্তার। নিশ্চয় ছয় সাত হাজার টাকা কমিশন পেয়েছে। কিন্তু পেশেন্টটা জানলোনা, আমি এক টাকাও পাইনি। আমি শুধু আমার জীবনটা বাঁচিয়েছি।
উপরের ঘটনাটি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ঘটেছে ১ মাসও হয়নি।
আমার জীবনের কাহিনী। এবং এটা বাংলাদেশের প্রায় সব মেডিকেলেরই কাহিনী।
ডাক্তাররা বিশাল ভালো, তারা মানবতার সেবা করেন, ঈদের দিনেও তাদের ছুটি নেই- এই সকল কথা লিখার জন্য আমি কি-বোর্ড ধরিনি। আমি জানি ঈদের দিনে সেনাবাহিনীর অর্ধেক সদস্যও ছুটি পাননা, পুলিশের বিশাল অংশ ছুটি পাননা, সুতরাং ডাক্তাররা ঈদের দিনে ওটি করে মহান হয়ে গেছেন- এই সকল কথা বলার কোন মানে হয়না। উনারা চাকরি করছেন, সুতরাং চাকরির রুলস অনুযায়ী কেউ ছুটি পাবেন, কেউ পাবেননা-এটাই নিয়ম।
এটা দিয়ে মহান হওয়ার কিছু নেই। আমি শুধু কিছু বাস্তব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কোন পেশাকে সবচেয়ে মহান হিসাবে মনে করেন, আমি কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই সাথে সাথে উত্তর দিবো, শিক্ষকতা। আমার ব্যক্তিগত মতামত, শিক্ষকতার চেয়ে মহান আর কোন পেশা হতে পারেনা। কিন্তু আমি নিশ্চিত, মোটামুটি সবাই তাদের স্কুল-কলেজ লাইফে এমন শিক্ষকের মুখোমুখি হয়েছেন যার কাছে কোচিং না করলে, কখনোই ভালো রেজাল্ট করা যায়না।
এরকম শিক্ষক প্রায় প্রতি স্কুলে ১-২ জন থাকেন। আমার জীবনে আমি এমন শিক্ষক পেয়েছি যিনি আমার যে উত্তরটা কেটে দিয়েছেন, যার ফলে আমি মার্জিন মার্কসে পাশ করেছি, সেই একই উত্তরে তার কাছে কোচিং করা ছাত্রকে পূর্ণ মার্কস দিয়ে ৮০% এর উপর মার্কস পাইয়ে দিয়েছেন। সব জায়গায় এরকম শিক্ষক থাকার পরও কেউ কখনোই বলবেননা, মাস্টারেরা সবাই খারাপ, এদের টাকা না দিলে এরা মার্কস দেয়না।
রানা প্লাজা ধ্বসে ১০০০ জনের উপর মারা গেলেও কেউ কখনো বলেনা এবং এটা বলা উচিতও না, সব ইঞ্জিনিয়াররা খানকির পুত, এরা টাকার জন্য বিল্ডিং-এর ডিজাইন উল্টা-পাল্টা করে। কারণ খুব সোজা।
কেউ খারাপ কাজ করলে সেই দোষী, তাকেই শাস্তি দেয়া উচিত, অন্যদের নয়। আর একটা পেশার সবাই খারাপ হয়ে গেছে এটা ভাবার কোন কারণ নেই। ইমাম সাহেব ৭ বছরের বাচ্চাকে মসজিদের ভেতর ধর্ষণ করলেও কারো ধর্মানুভূতীতে আঘাত লাগেনা। কেউ বলেনা বা বলাও উচিত নয়, সকল ইমামরা চুদির ভাই, ছোট বাচ্চাদের দেখলেই এদের দাঁড়িয়ে পড়ে। রাজ্জাক সাহেব জামাতীদের পক্ষে ওকালতি করলেও আমাদের বলা উচিত না, ব্যারিস্টার, এরাতো মানুষের জাত না।
উল্টা-পাল্টা সংবাদ রিপোর্ট করার পরেও কেউ বলেনা, সাংবাদিক! হুহ, সবগুলা চুতমারানি। ........................ থামেন, একটা পেশা আছে, যাদের সবাইকে এক লাইনে গালি দেয়া যায়।
ডাক্তার! শুওরের বাচ্চারা, সবগুলা কসাই।
না উপরের লাইনটা সব জায়গায় ঠিক নয়। বিদেশি ডাক্তাররা খারাপ না।
বিদেশি হওয়ার জন্য সাদা চামড়া লাগবেনা, পাশের দেশ ভারত গেলেই চলবে। শুধু কসাই হলো বাংলাদেশি ডাক্তার। আরো সহজ করি। প্রাইভেট মেডিকেল বা হাসপাতালের ডাক্তাররাও কসাই না। কসাই শুধু সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা।
এরা এতো এতো টেস্ট দিয়ে কমিশন খায়, ক্যান আগের কালের ডাক্তাররা টেস্ট ছাড়া রোগী দেখে নাই? জাফ্রিকবাল স্যার, উত্তর দিয়ে যান।
আমার রুমমেট পিয়াল। তার খালার গল্পটা শুনুন।
খালা যথেষ্ট ধনী পরিবারের। গাইনিকোলজিকেল কী একটা সমস্যায় তিনি এক ডাক্তারের কাছে গেলেন।
ডাক্তার তাকে ৪টা না ৫ টা টেস্ট করিয়ে নিয়ে আসতে বললেন। তিনি টেস্ট করিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসে পিয়ালের কাছে গজগজ করা শুরু করলেন, ''বাংলাদেশের এইগুলা কিসের ডাক্তার! শুধু কমিশন খাওয়ার ধান্দা। এতগুলা টেস্ট করতে দিলো! সব যদি টেস্ট করতে হয় তুমি ডাক্তার হয়েছো কেন? আগেরকার ডাক্তারেরা টেস্ট না করে ঔষধ দেয়নি। '' খালা দুই মাস পরে ঘোষণা দিলেন, তিনি এই দেশে আর ডাক্তার দেখাবেননা। বাংলাদেশের ডাক্তার একটাও ভালো না।
তিনি ইন্ডিয়া যাবেন। সেখানে ডাক্তার দেখাবেন। খালা একমাস পরে ভারতে ডাক্তার দেখিয়ে আসলেন। পিয়ালের কাছে হাসতে হাসতে বললেন, ''ইন্ডিয়ার ডাক্তারেরা কত ভালো জানিস? একদম শিওর না হয়ে কোন ঔষধই দেয়না। আমাকে ১৩ টা টেস্ট করলো, তারপর ঔষধ দিলো।
আর বাংলাদেশি ডাক্তারদের দেখ। কোন টেস্ট-ফেস্ট করেনা। আন্দাজের উপর ঔষধ দিয়ে দেয়। ''
খুব ভালো করে লক্ষ্য করুন, বিদেশি ডাক্তার আর টনসিলেকটমি অপারেশন করতে লাখ টাকা লাগে এরকম প্রাইভেট হাসপাতালের বিরুদ্ধে কারো কোন অভিযোগ নেই। সকল অভিযোগ সরকারি মেডিকেলের ডাক্তার আর গ্রাম থেকে উঠে আসা নুরুল ইসলামদের বিরুদ্ধে।
এই অভিযোগপ্রাপ্তরা লাঞ্ছিত হতে হতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেই শুরু হবে কর্পোরেট স্বাস্থ্য শোষণ।
আমি বলছিনা সকল ডাক্তার ভালো। অনেক ডাক্তার পৈশাচিকরকম খারাপ আচরণ করেন রোগীদের সাথে, ৫০ টাকা কম রাখতেও রাজি না, ঔষধ কোম্পানি থেকে কমিশন খান, ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন খান- সবই সত্য। কিন্তু আপনি যখন সিম্পলিফিকেশন করে পুওর ম্যানস সকল ডাক্তারদের একই তকমা -'ধান্দাবাজ', 'কমিশনখোড়', 'কসাই'- বরাদ্দ করেন, তখন সত্যিই গায়ে লাগে। আর বিদেশি ডাক্তারদের প্রতি যাদের অনেক মায়া-মহব্বত, আপনাদের বলছি, আপনারাতো ভারতে গিয়ে প্রাইভেট ডাক্তারের চেম্বারে বা হাসপাতালে দেখান, দয়া করে একবার ভারতের সরকারি হাসপাতালে ঢু মেরে আসবেন।
একবার ঘুরে আসলে বলবেন, বাংলাদেশেতো ওয়ার্ল্ড ক্লাস স্বাস্থ্য সেবা। আর যদি সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার সময় সুযোগ করতে না পারেন, তাহলে কষ্ট করে ভারতে গিয়ে টাকা-পয়সা খরচ করার কী দরকার- দেশেই লাখ টাকা খরচ করার জন্য স্কয়ার, এপোলো আছে- ঐখান থেকে ঘুরে আসুন। আর হ্যাঁ, আপনাদের ঐ ইন্ডিয়ান ডাক্তারও কিন্তু ডায়গনোস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন পান।
একজন ডাক্তার কত টাকা বেতন পান? আপনার সর্দি হোক, কাশি হোক, পেটে ব্যথা, মাথায় ব্যথা, চুলের আগা ফাটা- যাই হোক না কেন, আপনি কার কাছে যাবেন? একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে। কখনই একজন এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে যাবেননা।
ফলে এখন আমাদের এমবিবিএস করার পরই মাথায় ঘুরে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে হবে। ধরেন এডমিশন টেস্টের বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমি এমএস বা এমডিতে ভর্তি হয়ে গেলাম। ভর্তি হওয়ার পর কী করতে হবে জানেন? আমাকে একজন প্রফেসরের আন্ডারে একটি মেডিকেল কলেজে ৪ বছর কাজ করতে হবে। আমার বিশাল গালভারী একটা পোস্ট থাকবে- অনারারি মেডিকেল অফিসার। বেতন কত জানেন? ০ টাকা।
জ্বি, আসলেই আমাকে কোন বেতন দেয়া হবেনা। বলতে পারেন, এইসময় আমি খাবো কী? আমার মা ঘোষণা দিয়েছেন, এমবিবিএস পাশ করার পর আমার নামে কোন টাকা-পয়সা স্যাংশান হবেনা। আর কোন পেশা দেখাতে পারবেন যেখানে টানা চার বছর কোন বেতন ছাড়া সার্ভিস দেয়া হয়?
বাংলাদেশের সরকারি মেডিকেলের ডাক্তাররা খুব খারাপ। মনে যদি করতে পারেন, কিছুদিন আগে প্রথম আলোর দ্বিতীয় পাতায় ৩ কলাম জুড়ে একটা বক্স খবর ছাপানো হয়েছিল। খবরটা খুবই ভিবৎস।
খবরটা এরকম- ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে বাচ্চা ডেলিভারির সময় বাচ্চার মাথা ছিঁড়ে চলে এসেছে। এরকম কাজ হলে ডাক্তারদের মানুষ গালি দিবেনা কেনো বলুনতো? কিন্তু প্রথম আলো যে খবরটা ছাপতে ভুলে গেছে সেই বাচ্চাটা আইইউডি (ইন্ট্রাইউটেরাইন ডেথ) ছিল। আইইউডি হলে জরায়ুর ভিতরে মেসিরেশন (মানুষ মারা গেলে যেরকম পঁচতে থাকে, এখানেও এরকম পঁচতে থাকে। পার্থক্য হলো, মানুষ মরলে পঁচা গন্ধ বের হয়, আর আইইউডিতে একটু মিষ্টি গন্ধ বের হয়) হয়। নিয়মটুকু হচ্ছে, আইইউডি হলে আমরা কখনই সিজারিয়ান সেকশন করিনা।
মাকে লিথোটমি পজিশনে শুইয়ে রাখা হয়, যাতে নরমালি বাচ্চা ডেলিভারি হয়। একটা আইইউডি যার ইতমধ্যেই মেসিরেশন ডেভেলাপ করেছে তার ডেলিভারির সময় এই মিসএডভেঞ্চার- এটা প্রথম আলো উল্লেখ করতে ভুলে গেছে এবং এর কোন ফলোআপও তারা ছাপেনি। জুড়সে বলুন, কসাই ডাক্তার।
আমার প্যাথলজির প্রফেসর ড. সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া সরকারি মেডিকেলের ৩০-৪০ হাজার টাকার চাকরি ছেড়ে লাখ টাকার উপরের বেতনের প্রাইভেট মেডিকেলের চাকরিতে জয়েন করেননি। মাইক্রোবায়োলজির প্রফেসর ড. রাফিউদ্দিন আহমেদকে তার ২২ বছরের চাকরি জীবনে ২৫ বার ট্রান্সফার করা হয়েছে।
তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে পারতেন। তারপরেও পড়িয়ে যাচ্ছেন। এরকম অনেক উদাহরণ আমি দিতে পারবো। উনারা শুধু এই দেশটাকে দিয়ে যাচ্ছেন। আরেকবার 'শালার পুত কসাই' বলার আগে একবার চিন্তা করবেন প্লিজ।
_______________________________________________________
এ হাসনাত
সচলে আমার অন্যান্য লেখাঃ
প্রিয় আওয়ামিলিগ...
আমার নজরুল কাহন
মহান শাবি ভ্রমণ
মেডিকেল লাইফ সাক্স
আমি যামুনা। আমার ইচ্ছা।
ঢাকা-সিলেট বাস ভ্রমণ এবং আমার স্বজাতি ভাবনা
মৃত্যু
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।