ঘটনা-১ : রাজধানীর বনানীর বাসিন্দা করবী মিজান (৪৫)। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ২০১০ সালের ৩১ মার্চ তাদের উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টর, ১৫ নম্বর রোডের ৩৫ নম্বর প্লটের সাড়ে সাত কাঠা জমিতে ১০ তলা ভবন নির্মাণের জন্য চুক্তি হয় রিয়েল এস্টেট কোম্পানি মেগা বিল্ডার্সের সঙ্গে। সে অনুসারে মেগা বিল্ডার্সের এমডি মুরাদ ইকবাল চৌধুরীকে ওই জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেন করবী মিজানের বাবা ক্যাপ্টেন (অব.) মিজানুর রহমান। চুক্তির শর্ত ছিল ৪২ মাসের মধ্যে ভবন নির্মাণ করা হবে এবং মিজানুর রহমানকে ২ কোটি টাকা দেওয়া হবে।
৪২ মাস পেরিয়ে গেলেও জমিতে একটি ইটও ফেলা হয়নি। একই সঙ্গে সাড়ে তিন বছরে ক্যাপ্টেন (অব.) মিজানকে দেওয়া মুরাদ চৌধুরীর মার্কেন্টাইল ব্যাংকের দুটি চেকও দুই দফা ডিজ অনার হয়েছে বলে জানিয়েছেন করবী মিজান। বিষয়টি রিহ্যাবকে (আবাসান কোম্পানিগুলোর সংগঠন) অবহিত করলে তাদের মধ্যস্থতার উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে মেগা বিল্ডার্সের এমডি তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিলে তা থানা পর্যন্ত গড়ায়।
ঘটনা-২ : মিরপুরের বাসিন্দা সায়েদুল ইসলাম।
সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে গত বছর অক্টোবরে ধানমন্ডি ৬১ ক্রিসেন্ট রোডের পাঁচ তলার এ/৪ নম্বর ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছিলেন আরএসএ হাউজিং লি. নামের একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে। ফ্ল্যাটটি ছিল জমির মালিক নাসিমা খানমের অংশের। নাসিমার মেয়ের জামাই মঈন সাদিকের উপস্থিতিতে সায়েদুল এরই মধ্যে দুই কিস্তিতে আরএসএর মালিক এম এ সবুরকে ২০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। তবে গত ফেব্রুয়ারি থেকে সবুরের সব কটি মুঠোফোন বন্ধ পান সায়েদ। পরে ৫৬৮ শামীম সরণিতে আরএসএ হাউজিংয়ের অফিসও তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।
জানা গেছে, নির্মাণাধীন পাঁচ তলা ভবনের মালিকের অংশসহ মোট ১৩ জনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর থেকে উধাও হয়ে যান সবুর। এ বিষয়ে ১১ জুন শেরেবাংলানগর থানায় একটি জিডি করেন ভুক্তভোগী সায়েদ।
ঘটনা-৩ : ইতালিপ্রবাসী হারুনুর রশিদ। ২০০৮ সালের শুরুর দিকে উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টর, ১৫ নম্বর রোডের ৪৬ নম্বর বাসার পাঁচ তলায় ১০৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনেন নভেলা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কাছ থেকে। শর্ত অনুযায়ী ২০১০ সালের শুরুতে হারুনুর রশীদের ফ্ল্যাট বুঝে পাওয়ার কথা ছিল।
তবে গতকাল পর্যন্ত তিনি ফ্ল্যাট বুঝে পাননি। নভেলা রিয়েল এস্টেটের মালিক খলিলুর রহমানের মুঠোফোনে গতকাল রাতে কয়েক দফা ফোন দিলে তিনি তা রিসিভ করেননি। এমনই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত গ্রীন ডেল্টা হাউজিং কোম্পানির এমডি বেলাল আহমেদকে ১৫ সেপ্টেম্বর গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর আদালত প্রাঙ্গণে ছুটে যান শতাধিক ভুক্তভোগী। তাদের কান্না দেখে অনেকেই চোখের পানি সংবরণ করতে পারেননি। ফ্ল্যাট কেনা এবং ডেভেলপারকে জমি দিয়ে এ ধরনের হয়রানিতে ভুগছেন অসংখ্য মানুষ।
সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের স্বপ্ন অনেক ভুক্তভোগীরই ধূসর হতে চলেছে। রিহ্যাব কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে এ ধরনের অভিযোগের সংখ্যা পাহাড়সম। অভিযোগ দিয়েও সুরাহা মিলছে না। অনেকেই কেবল নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। অপরাধীরা অনেক সময় গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসছেন।
চেক প্রতারণাসহ এ রকম ২৬টি মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি গ্রীন ডেল্টা হাউজিং কোম্পানির এমডি বেলাল আহমেদ। গ্রীন ডেল্টার মাধ্যমে প্রতারিতদের একজন পূবালী ব্যাংকের সহকারী ব্যবস্থাপক হারীভূষণ দেব। তিনি জানান, ২০১০ সালে স্বামীবাগে ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে গ্রীন ডেল্টার ফ্ল্যাট কিনেছিলাম। তবে এখন পর্যন্ত ফ্ল্যাটও পাইনি, টাকাও পাইনি। ২০০২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কোনো গ্রাহককে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেনি হাউজিং কর্তৃপক্ষ।
গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা ফ্ল্যাট হস্তান্তর না করার কারণে গ্রীন ডেল্টার চেয়ারম্যান নূরুল আমিন ও তার ছেলে এমডি বেলালের বিরুদ্ধে ত্রিশটির অধিক মামলা হয়েছে। প্রতারণা করে গ্রাহকদের কাছ থেকে ওই কোম্পানি অন্তত ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। র্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কিসমত হায়াৎ বলেন, প্রায়ই এ-সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে অনেকে আসেন। আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সমস্যার সমাধানও দিতে পারি না। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া।
রিহ্যাব সূত্র জানিয়েছে, রিহ্যাবের নিবন্ধনভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৪০০। তবে ১ হাজার ১৬৫টি প্রতিষ্ঠান সক্রিয়। ২০০৮ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত রিহ্যাব অধিভুক্ত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ১ হাজার ২৯১টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৫৬৮টির নিষ্পত্তি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জবাবের অপেক্ষায় আছে ২০০ অভিযোগ।
২৭৭টি অভিযোগ আপস-মীমাংসার প্রক্রিয়াধীন। বিচারাধীন ১২টি অভিযোগ। ২২৩টির ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না। ১১টি অভিযোগের কোনো তথ্য মেলেনি। তবে রিহ্যাবের পরিসংখ্যান যাচাই করে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত জমা পড়া অভিযোগের অর্ধেকেরও বেশির কোনো সমাধান হয়নি।
রিহ্যাব সভাপতি নসরুল হামিদ বিপু গতকাল মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৬০০ অভিযোগ জমা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। এ খাতটি ক্রমেই বড় হচ্ছে। এ জন্য একটি ফাংশনাল রেগুলেটরি বডি দরকার। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্তত ১২টি প্রতিষ্ঠানের শীঘ্রই নিবন্ধন বাতিল করা হবে।
মেগা বিল্ডার্সের এমডি মুরাদ ইকবাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে করবী মিজানের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করবী মিজানের একটি অভিযোগও সত্য নয়। তাদের এরই মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।