সত্য ও সুন্দরের পথের অভিযাত্রী আমি, কিছুতেই যেন এ যাত্রা শেষ না হয়...
আমাদের পরিবারে আমরা একহালি ভাই-বোন আর আমাদের মা-বাবা থাকি। ভাই দুটি বড় তারপর আমরা দু’বোন । আমরা দুজন দুই ভাইয়ের চোখের মনি। আমাদের ছাড়া কিছু বোঝেনা ভাইদুটি। বড়ভাইয়ার কথা আগে একটু বলে নেই, তারপর এইগল্পের ‘হিরো’ মানে আমার ছোটো ভাইয়ার কথা বলছি।
আমার দুই ভাইকে দেখলে মনে হবে দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। বড় ভাইয়া অনেক গম্ভীর আর একটু বেশি রাগী। বেশি কথা বলে না। একটু বেশি চুপ-চাপ। নিজের প্রয়োজন কখনও মুখ ফুটে বলেনা।
এতটা হইহুল্লর করে না। এখন একটি টিভি চ্যানেল এ নিউজ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত আছে। আমি ঢাকাতে বড়ভাইয়ার সাথেই থাকি। আর ছোটোভাইয়াও আসে মাঝে মাঝে, ছুটি পেলে। ও সামরিক বাহিনীতে কর্মরত আছে, আর থাকে পিলখানাতে।
আর আমার মা-বাবা ছোটবোনকে নিয়ে কুমিল্লা থাকে।
আমার ছোটভাইয়া ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে স্বভাবের। অনেক বেশি সাহসী। ওর বন্ধুদের দলের ও ছিল লিডার। ওর নেতৃত্তে সবগুলোর বাঁদরামি চলত।
পড়ালেখায় যেমন ভাল, দুষ্টামিতেও সেরা। আর খেলাধুলা! অলরাউণ্ডার। এমন কোন খেলা নাই যে, সে পারে না। ছোটবেলায় কাওকে কিছু না বলেই একাই চলে যেত নানু বাড়ি। এদিকে আম্মু-আব্বু চিন্তায় অস্থির হয়ে যেত।
পরে মামা নাহয় নানাভাই ওকে বাসায় দিয়ে যেত। ও ছোটবেলা থেকেই কারো সাহায্য নিতে পছন্দ করত না, এমনকি নিজের লেখাপড়ার খরচও নিজে বহন করত। ও অনেক আত্মনির্ভরশীল একটা ছেলে। বাসায় সারাদিন হইহুল্লর করে সবাইকে মাতিয়ে রাখত। আমার ভাই দুটি বাসাতে আমাদের সময় দিতে অনেক পছন্দ করে।
আমরা সারাদিন অনেক মজা করতাম। ওরা বাইরে গেলেই আমাদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। অনেক মজা করে কেটেছে আমাদের ছোটবেলা। আমরা ছোটবেলায় শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনতাম, তারপর মালা গেঁথে দেখতাম কারটা বেশি বড় হয়েছে, আমি কখনই পারতাম না ভাইয়াদের সাথে। তারপর আমি কান্না শুরু করতাম আর মা ওদের বকত, আমায় কাঁদায় বলে।
অবশ্য তখন আমার ছোটবোন না থাকায় আমি ছোট ছিলাম আর আদরও বেশি পেতাম। ওরা সারাদিন আমাদের ক্ষ্যাপাত আর মাএর বকুনি খেত। এখনও এমনটা করে, এতবড় হয়ে গেছে তবুও মানুষ হল না। আর আমার ছোট বোনটিও অনেক রাগী, নিজের ইচ্ছা মত চলতে পছন্দ করে, কারো কথা শোনে না, এবার ইন্টারমিডিয়েটএ পড়ছে। সারাদিন কলেজ এর নাম দিয়ে বন্ধু-বান্ধুবির সাথে থাকে, ওর মধ্যে একটু ছেলেদের স্বভাব বেশি।
কারো পরওয়া করে না, আমি ওকে ডাকি লেডি গুণ্ডি। আমার দেখাদেখি ভাইয়ারাও ডাকে।
এভাবে চলতে থাকল আমার ছোটভাইয়ের জীবন, আস্তে আস্তে ও বড় হতে থাকল। তারপর সে এখন কর্মজীবন নিয়ে ব্যাস্ত। এখন আমরা যে যার যার মত থাকি, আগের মত আর মজা করা হয় না।
বড়ভাইয়া তার কাজ নিয়ে, ছোটভাইয়াও ওর কাজে ব্যাস্ত, আমি আমার ক্লাস আর পড়া নিয়ে। তিনজন একি শহরে থাকি অথচ সবাই ব্যাস্ত। তারপরও আমরা ছুটির দিনগুলিতে একসাথে হই, আমরা একসাথে সারাদিন ঘুরে বেড়াই, শপিং করি, রেস্টুরেন্ট এ যাই। অথবা ছোটভাইয়া বাসায় চলে আসে তারপর আমার প্রিয় খাবারগুলি রান্না করে, আমার দুই ভাই ভাল রাঁধতে পারে, অন্যসময় বড়ভাইয়া যদিও রাঁধে, কিন্তু ছুটিতে ছোটভাইয়া রাঁধে। বড়ভাইয়া অবশ্য এতটা টাইম বের করতে পারে না, তাই ছোটভাইয়াই আমাকে নিয়ে ছুটির দিন কাটিয়ে দেয়।
এছাড়া ঈদে আমরা সবাই একসাথে হই, অনেক মজা হয়, আমি আর আমার দুই ভাই মিলে সবার জন্য শপিং করি, তারপর বাড়ি যাই, কি বলব, আমাদের বাড়িতে তখন উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে। আম্মু আব্বু ছোটবোন সবাই অনেক খুশি থাকে, সেই ছোটবেলার মত আমরা মজা করি।
আমি ছোটবেলা থেকেই একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের। আর খাওয়া নিয়ে সবাইকে বিরক্ত করতাম, কিন্তু ঢাকায় আসার পর আমি পুরো চেঞ্জ হয়ে গেছি। আমি আর কাওকে বিরক্ত করি না, এখন নিজে নিজে মাছ বেছে খাই, আর এর সব অবদান আমার ছোটভাইয়ার, ও আমাকে শিখিয়েছে কেমন করে মাছের কাঁটা বাছতে হয়।
অন্যান্য খাবারও খাই এখন। ও আসলেই একটা সুপার-ডুপার হিরো।
আর এজন্যই মেয়েরা ওর জন্য পাগল। মেয়েগুলোর যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাওয়ার দশা। ওকে কেউ রেহায় দেয় না, না কলেজের মেয়ে না পাড়ার মেয়ে।
কিন্তু আমার ভাই এসব পাত্তা দেয় না। কারন আমাদের পরিবার অনেক ধার্মিক। এসব পছন্দ করা হয় না, আমাদের পরিবারে। আমাদের উপর কড়া নিষেধ আছে যেন আমরা বিয়ের আগে কোনরকম প্রেমে না জড়াই। আমরা সবাই পারিবারিক মূল্যবোধ এ বিশ্বাসী।
যথেষ্ট সম্মান আছে আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধের প্রতি। আম্মু সেইদিন ঘোষণা করেছে আমার ভাইদের বিয়ে করাবে। কি মজা !!
ছোটভাইয়ার সাথে ফোনে সবসময় কথা হয়, কি করছি, না করছি, খেয়েছি কিনা, কয়ঘণ্টা পড়লাম, আজ ক্লাসএ কি হল না হল সব বলি ভাইয়াকে। আমার ভাইগুলো আমার অনেক ভালবন্ধু, তাইতো আমার আর অন্যকোন বন্ধুর দরকার হয় না। এটা দেখে আমার সহপাঠীরা বিরক্তই হয়, আমাকে বলে আমি নাকি ভাইদের চামচা।
আজবতো!! চামচা ভাল কথা, আমার ভাইদেরই তো চামচা। পারলে তোরাও হ দেখি তোদের ভাইদের চামচা।
ছোটভাইয়া আসলেই একটা পাগল, একটু কিছু হলেই মন খারাপ করে বসে থাকে, আর আমাকে বকা দেয়। আমিও মন খারাপ করে বসে থাকি। কিছুক্ষন পর আবার বলে মন খারাপ করেছিস? আমি বলি হুম।
ভাইয়া বলে কততুকু? আমি বলি অনেক। তারপর ও এমন কাণ্ড করে, এমনিতেই মন ভাল হয়ে যায়। আবার মাঝে মাঝে করে কি, আমাকে এমন বকা দেয় যে আমি কেঁদেই ফেলি। তখন আবার বলে চোখ মুছে আয়, এমনটা আমি ইচ্ছা করে করেছি। তোকে শিখানোর জন্য।
যেন আর ভুল না করিস। বুঝেছিস? আমি বলি, হুম। এরপর বলে কি বুঝলি? আমি চুপ করে থাকি। তারপর বলে ঘোড়ারডিম বুঝছিস।
সেদিন বলে কি, ওই তুই এত তেল মেরে কথা বলিস কেন? সবসময় শুধু প্রশংসা করিস কেন এত? আমি বললাম কই নাতো।
ছোটভাইয়া বলে মিথ্যা বলবি না। ও জানে আমি লেখা-লেখি করতে পছন্দ করি। হঠাৎ করেই বলে কি, শোন তুই এবার যে গল্পটা লিখবি সেটার টপিক আমি সিলেক্ট করে দিব। আমি বললাম, আচ্ছা। ভাইয়া বলল প্রমিস কর যে লিখবি।
আমি বললাম ঠিকাছে, প্রমিস করলাম। তারপর সে যা বলল আমি শুনে তো আকাশ থেকে পরলাম, বলে যে তুই একটা গল্প লিখবি আমার নেগেটিভ দিক নিয়ে। আমি বললাম পারব না, ও বলল তুই তো প্রমিস করেছিস, এখন না বলতে পারবি না। আমি বাধ্য হয়ে বললাম ঠিকাছে লিখব। জিগ্যেস করলাম কি লিখব? তোমার তো নেগেটিভ দিক আমার চোখে পড়ে না।
ভাইয়া বলে যে লিখতে বলেছি ব্যাস লিখবি এত কথা বলিস কেন? আমি বললাম যে কি লিখব? তারপর ও আমাকে শিখিয়ে দিল, লিখবি যে তোর ভাই অনেক খারাপ ছেলে, সে নিজেকে সেরা মনে করে, মনে করে তারমত ভাল আর কেউ নেই, ও সবাইকে সবসময় উপদেশ দিয়ে বেড়ায়, অথচ নিজে ভাল কাজ করে না, ও অনেক মেয়ের লাইফ হেল করে দিয়েছে, ও একসাথে অনেক প্রেম করে, সারাদিন শুধু মেয়েদের পিছে ঘুরে বেড়ায়, স্কাইপি, ফেসবুক, ফোন, কোনজায়গা থেকে মেয়েরা রেহায় পায় না, আরও লিখবি তোকে কষ্ট দেই সবসময়, তোকে কাঁদাই, মন খারাপ করে দেই। আমি বললাম ভাইয়া এসব কি বলছ তুমি? আমি এগুল লিখতে পারব না, ভাইয়া বলে প্রমিস করেছিস লিখতেই হবে, আর আমি কি মিথ্যা বলেছি নাকি? আমি বললাম আচ্ছা লিখব। এরপর বললাম, তোমার নেগেটিভ দিক শুধু একটাই যে তুমি ফজর এর নামাজ পরতে উঠতে পারনা, মাঝে মাঝে নামাজ মিস কর, ভাইয়া বলে এটাও লিখবি।
আচ্ছা পাগল মানুষ ও। যেটা একবার বলে সেটা করতেই হবে।
তিনদিন পর, গতকাল আমাকে ফোন দিয়ে বলল কাজটা শেষ করেছিস? আমি বললাম না, এরপর বলে, কেন? কি কথা ছিল? আমার কথায় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছেনা, তাই না? যারা আমার কথায় গুরুত্ব দেয় না আমি তাদের সাথে কথা বলি না। তারপর আমি বললাম আমি আজ লিখে দিব, ভাইয়া বলে ঠিকাছে। কিন্তু আমি টাইম পাইনি লেখার। আজ আবার ফোন দিয়ে বলে লিখেছিস? আমি বললাম যে না, এটা শুনে ভাইয়া তো রেগেই আগুন। রাগ করে ফোনটা রেখে দিয়েছে।
আমি খুজে পাচ্ছি না কি নেগেটিভ দিক লিখব? এত অসাধারন একটা ভাই আমার, যার নেগেটিভ দিক নাই বললেই চলে, আমার ভাই বলে বলছি না। আমার ভাইদের সুনাম সবজায়গাতেই, আমাদের মহল্লাতে ওরা ওদের ব্যাবহার দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছে, কর্মক্ষেত্রেও এর বাতিক্রম না। ওরা অনেক ভাল মানুষ, সবসময় সৎ পথে চলার চেষ্টা করে, অন্যদের কষ্ট দেখতে পারে না, নিজের ক্ষতি হলেও অন্যকে সাহায্য করে, মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এককথায় দুনিয়ার সেরা দুটি ভাই আমার।
ভাইয়া এখনও রাগ করে আছে, বুঝতে পারছি না কখন রাগ ভাঙবে? আমি তো চেষ্টা করেছি গল্পটা লিখতে, ছোটভাইয়া প্লিজ রাগ করে থেক না।
আমি আম্মুকে বলে দিব কিন্তু। দাঁড়াও তোমার জন্য তো বউ খুজছে তাই না? এমন ভাবি খুঁজে আনবো যে তমাকে এমনটা করতে দিবে না, আমার সাপোর্টে থাকবে, তখন খুব ভাল হবে। ভাইয়া তুমিতো অনেক ভাল, তাইনা? প্লিজ রাগ করে থেক না, তুমি যতবার বলবে আমি ততবারই কান ধরে উঠবস করব, তবুও রাগ করে থেক না, আমার লক্ষ্মী পাগল ভাইয়া।
[ ভাইয়া তোমার জন্য গল্পটা লিখেছি, পড়ে দেখ কেমন হল? তারপর আমাকে জানাও। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।