লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। বাঘ মারি ভাল্লুক মারি, ঘরে বসে মারি
মোহাম্মদ ইসহাক খান
আচ্ছা, কন তো, বিশ্ববাজারে "ত্যালের" দাম এত বাইড়া গেল ক্যামনে? মাইন উদ্দিন সাহেব সাধারণ, আটপৌরে ভাষাতেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন। ভদ্রলোকের মাথায় চুলের বংশ নেই বললেই চলে, আয়নার মতো চকচকে টাক।
কপালে চার-চারটে বিদঘুটে ভাঁজ, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে তিনি যে সত্যি সত্যি চিন্তিত, সেটা খুব স্পষ্ট। কথা বলতে গিয়ে প্রচণ্ড থুথু ছিটিয়ে থাকেন ভদ্রলোক, সামনে উপবিষ্ট ব্যক্তিকে আত্মরক্ষার্থে খবরের কাগজ ব্যবহার করতে হয়।
বুঝলেন না, তেলের দাম না বাড়লে কিছু সার্টেন কান্ট্রির স্বার্থ রক্ষা হবে কী করে? এগুলো আগে থেকে প্ল্যান করা থাকে। জনাব নূর মোহাম্মদ সাহেব অত্যন্ত সুশীল ব্যক্তি, তিনি কথাবার্তায় মার্জিত ভাব বজায় রাখেন এবং নিজের জানার মধ্যে সাধ্যমতো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন।
আমাগো দ্যাশের বাজারেও তো এইটার কু-প্রভাব পড়তাছে।
কারো কোন হিসাব নাই? "প্যাট্রোলের" লিটার কত জানি হইল?
কী করবো বলুন। আমরা ছাপোষা মানুষ। আমাদের কথা কে-ই বা ভাবে। এই যে লোকাল বাসগুলোতে প্রতি মাসে ভাড়া বাড়ছে, আমাদের মতো নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস ওঠার দশা। কারো কোন হুঁশ আছে?
হক কথা কইছেন।
ঐ ব্যাডাগুলানরে ধইরা ... ... (এই পর্যায়ে মাইন উদ্দিন সাহেব কিঞ্চিৎ অপরিশীলিত ভাষা ব্যবহার করলেন)।
বিশ্ববাজারে যেতে হবে কেন? কাঁচাবাজারেই দেখুন না। একটা জিনিস ছুঁয়ে দেখার উপায় আছে?
হেলাল সাহেব এই পর্যায়ে আলোচনায় যোগ দিলেন। বললেন, আমাদের মনে হয় সামগ্রিকভাবে চিন্তা করা উচিৎ। বাজেটের দিকে তাকালে কিন্তু বোঝাই যায়, আমাদের জন্য এটা নয়।
সাধারণ জনগণের দিকটা যে লক্ষ রাখা হয় নি সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
ঠিক কথা, ঠিক কথা। এবার মাইন উদ্দিন সাহেব এবং নূর মোহাম্মদ সাহেব দুজনেই মাথা নেড়ে ওঠেন।
সিণ্ডিকেট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অগ্নিকাণ্ড, নারীদের নিরাপত্তার অভাব, যৌতুক, ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপ, দেশে সন্ত্রাস এবং রাহাজানির উদ্বেগজনক বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের করাল গ্রাস থেকে উত্তরণে তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের কী করণীয়, উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা এবং দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা, মায়ানমারের সাথে সীমান্ত নিয়ে সদ্য সমাপ্ত গোলযোগ, ভারতের সাথে পানি বণ্টন, ইরাক-আফগানিস্তান-ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ, গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপ এবং এসবের নেপথ্যে তাদের মূল উদ্দেশ্য কী, বিভিন্ন দেশের সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স ও তাদের ক্রিয়াকলাপ - এক কথায় আধ ঘণ্টার মধ্যে সবাই সব বিষয় নিয়ে এক দফা প্রাণবন্ত আলোচনা করে ফেললেন। আলোচনার বিষয় যে কখন কোন বিষয়ে যাচ্ছে এবং কীভাবে আগের বিষয়ে ফিরে আসছে, সেটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।
তাঁরা আলোচনা করেই সুখ পান। তাঁরা দেশের সচেতন নাগরিক, তাঁরা আলোচনা না করলে সমস্যাগুলোর সমাধান হবে কী করে?
ব্যাপারটা এভাবে বোঝানো যেতে পারে। ধরা যাক, গরু নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। গরু দুধ দেয়, এটা বলা মাত্রই আলোচনা চলে গেল গরু থেকে দুধের পুষ্টিগুণের বিষয়ে। দুধে কী কী পুষ্টি গুণাগুণ আছে, সেটা বলতে বলতে কথা চলে গেল পুষ্টির অভাবজনিত অসুখ-বিসুখ এবং সেখান থেকে চলে গেল দেশের ওষুধ শিল্পের বিকাশে।
ওষুধের দড়ি ধরে টানা মাত্রই চলে এলো ডাক্তারের প্রসঙ্গ। ডাক্তাররা কেমন গলাকাটা ভিজিট নিয়ে থাকেন, এটা নিয়ে কথা বলতে বলতে (এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিজের জীবন থেকে চুম্বক অংশ তুলে এনে আলোকপাত করে) আলোচনা মোড় নিলো ডাক্তারদের মধ্যে দলাদলি এবং সেটার জন্য রোগীদের কেমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সেটাতে। দুর্ভোগের কথা বলতে বলতে চলে এলো লোডশেডিং, মশার কামড়, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ইত্যাদি বিষয়ে। পাঠক, মনে আছে, আলোচনা কী নিয়ে শুরু হয়েছিল? "গরু" নিয়ে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোচনার মাঠ থেকে যে গরু দড়ি ছিঁড়ে পালাল, সেটা আমাদের যেমন খেয়াল নেই, তেমনি যারা আলোচনা করছেন, তাঁদেরও নেই।
এতক্ষণ আর যা-ই হোক, বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছিল। কিন্তু আলোচনার আসল মজা কোন বিষয়ে? অবশ্যই রাজনীতি। আর তাই করতে গিয়ে যখন হাফিজ সাহেব একটি বিশেষ দলের রাজনৈতিক নেতাকে কিছু কটু শব্দমালার মাধ্যমে সরাসরি আক্রমণ করে বসলেন, তখনই ঘরের আবহাওয়াতে চকিত পরিবর্তন এসে গেল।
ঘরে সব রাজনৈতিক দলের সমর্থক লোকজনই আছেন। কাজেই হাফিজ সাহেবের কথার সমর্থক যেমন কিছু মানুষ পাওয়া গেল, তেমনি সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের লোকও পাওয়া গেল।
হাফিজ সাহেব তীব্র প্রতিবাদের মুখেও কিছুক্ষণ চালিয়ে গেলেন তাঁর বক্তব্য, কিন্তু পরক্ষণেই সবার গলার স্বর আকাশচুম্বী হওয়াতে কারো কথা শোনাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ালো।
ঘরে এখন যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব, সিগারেটের ধোঁয়া উড়ে ব্যাপারটাকে আরও তীব্র রূপ দিয়েছে। আলোচনারত প্রৌঢ়সকল এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একটি দলের নেতৃত্বে আছেন হাফিজ সাহেব, যিনি তীব্র ভাষায় বিপক্ষের নেতাকে আক্রমণ করছেন, আরেক দলের পুরোভাগে মতিন সাহেব, তিনি তার চেয়েও তীব্র এবং গভীর ভাষায় নিজের সমর্থনপুষ্ট দলের নেতার স্তব করে চলেছেন। গোলমালে কান পাতা দায় হয়ে দাঁড়ালো, এবং ক্রমশ এই সম্ভাবনা অত্যন্ত জোরালো হয়ে পড়লো যে, এই সুন্দর "সান্ধ্য-আলোচনার" ব্যাপারটি শেষে হাতাহাতির রূপ নেবে।
অনেকেই ভয় পেতে লাগলেন যে, এখনই হাফিজ সাহেবের মুখের দু'পাশ দিয়ে দুটো শ্বদন্ত বেরিয়ে আসবে এবং তিনি মতিন সাহেবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা কামড়ে ধরবেন। এখনো থামেন নি তিনি, চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে মতিন সাহেব হাইপারটেনশনের রুগী, কিন্তু সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই, হাফিজ সাহেবের ভ্রান্ত রাজনৈতিক ধারণার মূলোৎপাটন না করে তিনি ক্ষান্ত দেবেন না বলে এককাট্টা হয়েছেন। এখুনি প্রেশারের কারণে তাঁর ঘাড়ে কিঞ্চিৎ ব্যথা শুরু হয়েছে।
এমন সময় হঠাৎ ফরিদ সাহেব সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
দেখুন তো, হারুন সাহেব কী করছেন।
এত গোলমালের মধ্যেও ভাটা পড়লো, সবাই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে হারুন সাহেবের দিকে তাকালেন। ভদ্রলোক আগাগোড়া এই ঘরেই ছিলেন, কিন্তু কোন কথা বলছিলেন না বলে কেউ খেয়ালই করেন নি যে তিনি কোথায় এবং কী করছেন। তাঁকে দেখে সবার বিস্ময়ের সীমা রইলো না।
হারুন সাহেব কোণার দিকে সোফাটাতে বসে আরাম করে ঘুমোচ্ছেন।
ক্ষীণ শ্বাস পড়ছে তাঁর, বোঝাই যাচ্ছে খুব গভীর ঘুম। ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে এখনো ধরা আছে একটা সিগারেট, সেটার আগুন নিভে গেছে বহু আগেই, ছাই জমে আছে সিগারেটের আগায়। সিগারেটটা মাটিতে পড়ি-পড়ি করেও পড়ছে না কেন, সেটাই এক রহস্য।
সবাই মিলে হাঁকডাক করে ডেকে তুললো হারুন সাহেবকে। তিনি আচমকা এতগুলো বাজখাঁই গলার চিৎকারে চমকে জেগে উঠে বললেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে?
সবাই বলল, আরে সাহেব, এখানে এত "লাইভলি ডিসকাশন" হচ্ছে, আর আপনি পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছেন? আপনার আক্কেলের "বলিহারি যাই"।
হারুন সাহেব আস্তে আস্তে মুখ খুললেন। কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল?
বড় বড় বিষয় নিয়ে। রাজনীতি, অর্থনীতি, দারিদ্র্য, বিশ্ব পরিস্থিতি - সব। আলোচনা না হলে সবকিছু খোলাসা হবে কী করে?
ও। কিন্তু আমি তো সামান্য কেরানী।
রোজ সকালে উঠে অফিসে যেতে হয়, সারাদিন কলম পিষতে হয়। রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমোতে যেতে হয়। এর বাইরে তো আর আমার কিছু নেই। আমি এসব বড় বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা করে কী করবো? আমার চিন্তার দৌড় বাড়িভাড়া, ওয়াসার পানিতে বদগন্ধ, মেয়ের বিয়ে এসব পর্যন্ত। আপনারাও তো আমারই মতো, আপনারাই বা এসব ব্যাপার নিয়ে রাজা-উজির মেরে কী পাচ্ছেন শুনি? আর এসব নিয়ে মারামারি পর্যন্ত বাঁধিয়ে বসেছেন? বলুন, বলুন, কথা বলুন।
চুপ করে থাকবেন না।
এতক্ষণ যে মতিন সাহেব আর হাফিজ সাহেব পরস্পরকে তুমুল গালিগালাজ করছিলেন এবং সব বিষয়ে নিজেদের গভীর জ্ঞান ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন আকাশে-বাতাসে, তাঁদের মুখে এখন আর কোন কথা নেই।
বাকি সবারও একই অবস্থা। সবাই বোকার মতো মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। সত্যিই তো তাঁরা জানেন না, এসব নিয়ে আলোচনা করে ফায়দা কী।
কেনই বা এত কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছিলেন। আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর দিয়ে দরকার কোনকালেই তো ছিল না। তাঁরা বুঝতে পারলেন, কেন সতর্ক দোকানী চায়ের দোকানে লিখে রাখে, "রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ। " কারণ তাতে চায়ের কাপ ভাঙা ছাড়া আর কিছু হয় না।
হারুন সাহেবই আবার মুখ খুললেন।
অভিযোগের সুরে বললেন, ধুর, আরামের ঘুমটা ভাঙালেন।
(২১ ডিসেম্বর, ২০১২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।