আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যরা তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ভাবছেন নিজ দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যানদের। নির্বাচনে বিভিন্ন আসন থেকে কমপক্ষে ১০০ উপজেলা চেয়ারম্যান মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার কারণেই এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে এরই মধ্যে সংসদ সদস্য এবং উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই প্রকট হয়ে উঠেছে। চেয়ারম্যানরা যাতে মনোনয়ন না পান সে জন্য অনেক সংসদীয় আসনেই বর্তমান সংসদ সদস্যরা নানাভাবে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করছেন। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন।
উপজেলা চেয়ারম্যান এবং জেলা পরিষদের প্রশাসকদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ সংশোধনের জন্যও একটা খসড়া প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি আর সংযোজন হয়নি। মনোনয়ন দৌড়ে উপজেলা চেয়ারম্যানরা যেন পেছনে পড়ে থাকেন সে জন্য বর্তমান সংসদ সদস্যরা অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান।
বিভিন্ন এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে কমপক্ষে ১০০ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা। সংসদ সদস্যরা এলাকাবিমুখ ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার সুযোগে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যনরা নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন।
ফলে আগামী নির্বাচনে অনেক আসনেই বর্তমান সংসদ সদস্যদের সঙ্গে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন স্থানীয় এই জনপ্রতিনিধিরা।
২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৪৮২ উপজেলার মধ্যে ৩৭৮টিতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী। একইভাবে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিতদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার জন আওয়ামী লীগ সমর্থিত। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, দুমকি উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন-অর রশীদ হাওলাদার বলেন, কতিপয় এমপির মালিকানাসুলভ আচরণের কারণে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ শুরু থেকেই ক্ষমতা ও মর্যাদাহীন। ফলে সংশ্লিষ্ট এমপিদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের সাংঘর্ষিক অবস্থা বিদ্যমান।
তিনি বলেন, কিছু কিছু এলাকায় উপজেলা চেয়ারম্যানদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় এমপিরা নিজেদের মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এ কারণেই তারা এখন দেশের অনেক জায়গায় উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রতিপক্ষ ভাবছেন। তিনি আরও বলেন, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মনোনয়নে ক্লিন ইমেজ, জনপ্রিয়তা, যোগ্যতাকে মেনে না নিয়ে প্রতিপক্ষ ভাবা হলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, এমপিরা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের প্রতিপক্ষ ভাবলেও চেয়ারম্যানরা তা ভাবেন না।
গাজীপুরের একজন উপজেলা চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এমপিরা চেয়ারম্যানদের জনপ্রিয়তা নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কিত।
কারণ চেয়ারম্যানদের প্রায় সবাই এমপি হওয়ার যোগ্য। এর প্রমাণ হচ্ছে নওগাঁ ও বরগুনা। এ দুই জায়গায় দুজন সংসদ সদস্যদের মৃত্যুতে দুটি আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দুজন উপজেলা চেয়ারম্যান যথাক্রমে আবদুল মালেক ও হাসানুর রহমান রিমন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় চেয়ারম্যানদের জনপ্রিয়তায় অনেক এমপি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
কুমিল্লার মেঘনা উপজেলা চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-সম্পাদক শফিকুল আলম বলেন, তার নির্বাচনী এলাকা কুমিল্লা-২ আসনের এমপি তাকে প্রতিপক্ষ ভেবে তার সমর্থকদের নানাভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন। তিনি বলেন, দেশের অনেক এলাকায় এমপির চেয়ে চেয়ারম্যানরা জনপ্রিয়।
এ কারণে আগামী নির্বাচনে যাতে চেয়ারম্যানরা মনোনয়ন চাইতে না পারেন সে জন্য নানাভাবে দলের স্থানীয় পর্যায়ে নিজেদের লোক দিয়ে এমপিরা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে প্রভাব খাটিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন।
শফিকুল আলম বলেন, ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত কুমিল্লা-২ আসনটি ছিল হোমনা ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে। কিন্তু গত নির্বাচনে মেঘনাকে কেটে দাউদকান্দির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এবার সংসদীয় এলাকা পুনর্বিন্যাসের সময় মেঘনার আটজন ইউপি চেয়ারম্যানের মধ্যে সাতজন এবং উপজেলা চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আগের সীমানায় সংসদীয় আসন পুনর্নির্ধারণের জন্য লিখিত আবেদন করলেও বর্তমান এমপি সুবিদ আলী ভূঁইয়া ও হোমনার এমপি এম কে আনোয়ারের প্রভাবের কারণে নির্বাচন কমিশন তা করেনি।
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শামীমা শাহরিয়ার আগামী নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হচ্ছেন আওয়ামী লীগের ইঞ্জিনিয়ান মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। শামীমা শাহরিয়ার বলেন, বর্তমান এমপি তাকে প্রতিপক্ষ ভেবে নানাভাবে হয়রানি করছেন। মিথ্যা মামলা দিয়েছেন। হাওরবাসীর পক্ষে কাজ করতে গিয়ে এবং হাওরের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে তিনি (শামীমা) জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় তাকে এমপির নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান এমপি কখনই চান না এ আসন থেকে আর কেউ মনোনয়ন পাক। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুর রউফ বলেন, আমার এলাকায় এমপি খুব একটা বাধা দিতে না পারলেও দেশের অনেক উপজেলায় জনপ্রিয় চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তার করে এমপিরা নানাভাবে হয়রানি করছেন। তিনি বলেন, এমপিরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। আর উপজেলা চেয়ারম্যানরা এলাকার উন্নয়নে তেমন কোনো কাজ না করতে পারলেও এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখে তাদের পাশে থাকায়, তাদের কথা শোনায় এবং ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করে দেওয়ার কারণে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এটাই হচ্ছে চেয়ারম্যানদের প্রতি এমপিদের সবচেয়ে বড় ক্ষোভের কারণ।
এ জন্যই তারা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের প্রতিপক্ষ ভাবছেন। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান বিশ্বনাথ সরকার বিটু বলেন, আমার এখানে এমপি জাতীয় পার্টির। তিনি আমাকে প্রতিপক্ষ না ভাবলেও সারাক্ষণ আতঙ্কে আছেন। কারণ মহাজোট না থাকলে এ আসনে আমিই প্রার্থী হব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।