আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেখ হাসিনার নেতৃত্বের অপরিহার্যতা ও সমকালীন রাজনীতি

আমি কেবলই আমার মতো

১৯৪৭ সালের বিভক্তির চুড়ান্ত সময়ের প্রাক্কালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলো। যার শুরু মুলত জিন্নাহর ডাইরেক্ট একশন ডে’কে কেন্দ্র করে ১৯৪৬ সালে ১৬ই আগষ্ট। সেটার ধারাবাহিকতা ১৯৪৭ এর বিভক্তির পরেও চলছিল। সেই দাঙ্গার সময়ে যুক্তবাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শেখ মুজিবের প্রিয় নেতা তাঁকে বললেন, ‘এই দাঙ্গার সময়ে শুধু সরকারী কর্মচারীদের উপরে ভরসা করতে পারছি না।

তাই তুমি যদি ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডের একটা ভলান্টিয়ার কোর গঠন করে বর্ডারে গিয়ে শরণার্থীদের আসা-যাওয়ার বিষয়টি তদারক করো তবে আমি নিশ্চিন্ত থাকি’ একথা বলেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী দ্বিধাগ্রস্থভাবে শেখ মুজিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমি জানি রেণুর শরীর ভালো নয়। তার উপর বাচ্চা হারিয়েছে(১৯৪৪ সালের ডিসেম্ভরে তাদের প্রথম ছেলে সন্তান জন্ম হয়ে মারা যায়) তোমার উচিৎ তাকে সঙ্গ দেওয়া। অবশ্য আরো প্রায় দশদিন সময় বাকী আছে কাজ শুরু হতে। তুমি ভেবে দেখো। আর তোমার পক্ষে সম্ভব না হলে অন্য কারো নাম সাজেষ্ট করতে পারো।

’ শেখ মুজিব শুধু কয়েকদিন সময় নিয়ে চলে এলেন। তখন বেগম মুজিব অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এর আগে সন্তান হারানোয় এবার ভেবেছিলেন হয়ত স্বামীকে কাছে পাবেন। কিন্তু শেখ মুজিব কলকাতার ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করে লিখলেন চিঠি। তার স্ত্রীও উত্তর দিলেন।

সেই উত্তরে স্বামীকে নিশ্চিন্তে তার কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে লেখেন, “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপরে আমার ভার ছেড়ে দিন।

” এরকম চিঠি অন্য কোনো পতিব্রতা নারী লিখেছে কিনা ইতিহাসে তেমন পাওয়া যায়না আজও। অথচ গ্রামের অল্পবয়সী একজন নারী যার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই বললেই চলে তিনি লিখেছেন ব্রিটিশ ভারত যুগে। এখানেই স্বামীকে দেশের জন্য উৎসর্গ করা একজন বিদুষী নারীর চরিত্র ফুটে উঠে। এমনি একজন মহিয়সী নারীর গর্ভে জন্ম নিয়েছেন আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ মুজিব এই চিঠি পাওয়ার পরেই তার নেতা শহীদ সোহরাওয়াদী’র নিকট গিয়ে শরনাথীদের তদারকিতে যাওয়ার কথা ব্যক্ত করলে শহীদ সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তুমি রেণুর সঙ্গে পরামর্শ করেছো?' মুজিব হ্যা সুচক জবাব দিয়ে বললেন, চিঠি পেয়েছি।

সে নিশ্চিন্তে দেশের কাজে যেতে বলেছে। ' শহীদ সাহেব রাশভারী মানুষ ছিলেন। ভাবাবেগ প্রকাশ করতেন না। কিন্তু সেদিন শেখ মুজিবকে বললেন, 'Mujib, She is a very precious gift to you from God. Don't neglect her please.' অথাৎ 'মুজিব, সে তোমার জন্য খোদার দেওয়া অমুল্য দান। তাকে অবহেলা করো না।

' পরবর্তী ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কথা কত সত্য। বেগম মুজিবের এই পত্র লেখার সময়ে তিনি যে সন্তানটি গর্ভে ধারন করছিলেন তিনিই শেখ মুজিবের আদরের ‘হাচু’, এদেশের মানুষের জননেত্রী, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রচলিত আছে, সন্তান গর্ভে থাকাকালীন সময়ে অন্তসত্ত্বা জননী যা ভাবে, স্বপ্ন দেখে সন্তানের মধ্যে সেগুলোই প্রতিফলিত হয়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে যেমন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের চরিত্রের উজ্জ্বল একটি দিক প্রতিভাত হয়, ঠিক তেমনি অন্তাসত্ত্বাকালীন একজন মায়ের ভাবনা-চিন্তার প্রতিফলন হিসেবে ১৯৪৭ সালের এই দিনে জন্ম নেওয়া শিশুটির উপরেও সেটার চূড়ান্ত প্রভাব প্রমানিত হয়। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, শেখ হাসিনার নিরন্তর সংগ্রামী চেতনার প্রেরনা পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের রক্তের ধারাবাহিকতায়ই এসেছে।

আজকে শেখ হাসিনার ছেষট্টিতম জন্মদিন। আজকের এই দিনে তাই শেখ হাসিনার জীবনের অনন্য ও অনিবার্য কিছু বিষয় পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই। বাংলাদেশের মানুষ সত্যিকারভাবেই ভাগ্যবান যে, তাঁরা এদেশের প্রতিষ্ঠাতার অনুপস্থিতিতে তাঁরই সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্ব পেয়েছে। প্রায়শই শোনা যায় যে, বাংলাদেশের রাজনীতি উত্তরাধিকারের রাজনীতি। অনেকেই রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন তোলে আকাশ বাতাস কাপিয়ে তোলেন।

অথচ তাঁরা ভুলে যান যে, ফরাসী বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীতে উত্তরাধিকারের রাজনীতিই ছিল শেষ কথা। হ্যাঁ ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার মাধ্যমে গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্ধারণ করার সুযোগ তৈরি করেছে। তাহলে প্রশ্ন এসে যায়, কেউ যদি যোগ্য হয় তবে সে কার সন্তান সেটা বিবেচ্য হবে কেনো? সেই প্রশ্ন উত্থাপন করাটা প্রশ্নকারীদের দৈন্যতা বলেই আমার মনে হয়। আর বিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ থেকে অদ্যাবধি পৃথিবীতে উত্তরাধিকারের রাজনীতিবিদ হিসেবে যাদেরকে গননা করা হয় তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা অবশ্যই অনন্য ও ব্যতিক্রম। ১৯৭০ সালের প্রথমদিকেই, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গোপন উদ্যেগে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহনের জন্য সামরিক শিক্ষা, গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল এবং ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগ্রামে স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত জোড়দার করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রস্তাবনা এবং রাজনৈতিক স্লোগানসহ যেসব কর্মসূচী গ্রহন ও বাস্তবায়ন করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল প্রকাশ্যে সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজ প্রশিক্ষন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়(বুয়েট) চত্বরে ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারীর ১৫ তারিখে প্রথম কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামক সত্য মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিতে অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজের নামকরন করা হয়েছিল ‘ফেব্রুয়ারী-১৫ বাহিনী’। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী, ছেলে-মেয়ের অংশগ্রহনে ‘ফেব্রুয়ারী-১৫ বাহিনী’র অধিনায়ক ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঢাকা নগর শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মফিজুর রহমান খান এবং উপ-অধিনায়কত্ব করেছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক হাসানুল হক ইনু। ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেত্রী ও ছাত্রীসংসদের নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাও সেই কুচকাওয়াজে অংশগ্রহন ও ইডেন কলেজের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সেসময়ে ঢাকার রাজপথে এমন প্রকাশ্যে তাও আবার সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হওয়া যেমনি ইয়াহিয়া সরকারের কাছে ছিল রাষ্ট্রদোহীতার সামিল, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কাছে তেমনি ছিল রোমাঞ্চকর ও স্বাধীনতার দীক্ষায় আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া।

বাবার মতো জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার প্রায় একবছর পূর্বেই এমন বিপ্লবী ভুমিকায় অবতীর্ণ হওয়া আজকের দিনে অসম্ভব। অথচ শেখ হাসিনা এমনই দীক্ষাতে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। তারও পূর্বে ’৬৬ এর ছয় দফার সময়কালীন শেখ হাসিনার রাজপথ ও জেলখানার দুতিয়ালী ভুমিকা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রলীগ ও রাজপথ সকল স্থানে নিজের পরিশ্রম, সৃষ্টিশীলতা ও দূরদর্শিতা প্রদর্শন করেই শেখ হাসিনা নিজেকে রাজনীতির অপরিহার্য নেতৃত্ব হিসেবে প্রমান করেছেন। এখানে বললে অত্যুক্তি হবে না যে, গত পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এদেশের সকল নেতাদের ছেলেমেয়রা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হবে এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক বিষয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে সত্তরের দশকে এই ধারাবাহিকতা কিছুটা থাকলেও এখন প্রায় একেবারেই অনুপস্থিত। বোধকরি রাজনীতির সংজ্ঞাই এখন বদলে গেছে! তখন দেশের জন্য সকল পিতা-মাতা সন্তানদের উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। যে কারনে বাংলাদেশের প্রধান নেতা শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল জনতার কাতারে থেকে লড়াই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন। আর তখন সেটা সম্ভব হয়েছিল বলেই আজকে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্ব পেয়ে গর্ব করতে পারছে। কেননা, রাজপথ থেকেই প্রকৃত নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে।

সেই ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে রাজপথ ও কারাগারের কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়েই আজকের শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনকসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে হত্যা করার সময়ে বিদেশে থাকার দরুন প্রানে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু আদরের দুলালী শেখ হাসিনা(হাসু) ও শেখ রেহানা(মুন্না)। বাবা, মা, ভাই, ভাবী সহ নিকটাত্মীয়দের হারিয়ে নির্বাক দু’বোন অথৈ সাগরে পড়েন। জার্মানিতে ড.এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থলে শেখ হাসিনার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া শেখ রেহানা ঘাতকের হাত থেকে বেঁচে গিয়েও যেন প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুতাড়িত হয়ে ফিরেছেন নানা জায়গায়। শেখ কামালের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে জার্মানি গিয়েছিলেন বেড়াতে, কথা ছিল বঙ্গবন্ধু কিছুদিন পরেই ইউরোপ যাবেন তখন জার্মানিও যাবেন বড় মেয়ে-জামাইয়ের সংসার দেখতে এবং রেহানা পিতার সঙ্গেই দেশে ফিরবে।

হায়রে নিয়তি! মা-বাবা বেঁচে থাকতে আর দেশে আসা হলোনা দু’বোন, নাতি জয় ও নাতনী পুতুলের! ইতিহাসের ভয়াবহতম জঘন্য হত্যাকান্ড ঘটিয়ে ঘাতকেরা চিরতরে স্তব্ধ করে দিলেন বাঙালির অতি আপন মানুষ বঙ্গবন্ধু তথা দেশের কণ্ঠ। নির্মম হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধীচক্র একের পর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যেই দু’বোন জার্মানি থেকে ২৫ আগস্ট ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহন করে শুধু বেঁচে থাকার ইচ্ছেতে। দিল্লীর ‘ইন্ডিয়া গেট’র কাছে পান্ডারা রোডের কড়া নজরদারির মধ্যে মানবেতর জীবন যাপনের শুরু। এ যেন বেঁচে থেকেও মরনযন্ত্রনার অধিক কষ্ট নিয়ে দিনাতিপাত।

বঙ্গবন্ধুর পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে ১৯৭৬ সালের ২৪ জুলাই বিয়েও হয় শেখ রেহানার লন্ডস্থ বঙ্গবন্ধুর ফোফাতো ভাই মমিনুল হক খোকার বাসায়। বঙ্গবন্ধু পরিবারতো বটেই সারা দেশের আওয়ামী পরিবারের উপর চলতে থাকে নিষ্ঠুর আচরন। এমনি বৈরি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারীর দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সর্ব সম্মতিক্রমে সভানেত্রী নির্বাচিত হলে ১৭ মে দেশে ফেরার দিন ধার্য হয়। রাষ্ট্রের শত বাধা সত্বেও সম্পূর্ণ জনগনের ভালোবাসার উপর নির্ভর করে দীর্ঘ ৫বছর ৯মাস ১৬দিন(৩০জুলাই ’৭৫ থেকে ১৭মে ’৮১)পরে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী হিসেবে। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, পরিবর্তিত বিশ্বে রাজনীতিতে আমুল পরিবর্তন এসেছে।

এখন কেনো উত্তরাধিকার চর্চা অব্যাহত থাকবে? কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে মানুষের সমাজে অনিবার্যতা বলে একটা কথা আছে। এই অনিবার্যতাই বিংশ শতক এমন কি একবিংশ শতকেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত হয়ে রাজনীতি কার্য চলছে। বাংলাদেশে তারেক রহমান, ভারতে রাহুল গান্ধী, পাকিস্তানে বিলাওয়াল ভুট্টো প্রমুখ বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারেরই ফসল। অবশ্য এ তিনটি ক্ষেত্রে পারিবারিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষায় অনিবার্যতা থাকলেও স্বদেশীয় রাজনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষায় কতটুকু অনিবার্যতা রয়েছে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। আর যদি বিশ্বের ইতিহাসের দিকে একটু নজর দেই তাহলে এই বিষয়ে আরও চমকপ্রদ সত্যতা দৃশ্যমান হয়।

খোদ গণতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটেনে এবং শিল্পোন্নত জাপানসহ অনেক দেশের রাজনীতিতে খুব সীমিত পরিসরে হলেও বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের রাজনীতি অনুসরন করা হয়। অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী দেশেও রাজতন্ত্রের নামে বংশানুক্রমিক রাজনীতি বহাল তবিয়তে। শুধু রক্ষনশীলতা এসব রাজবংশ টিকিয়ে রেখেছে অথবা আজকের প্রগিবাদী বিশ্বে তাঁদের কোনই অবদান নেই এমন বলার অবকাশ নেই। এসব যুক্তি দিয়ে কোনভাবেই অযোগ্য বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের রাজনীতিকে বৈধতা দেওয়ার ন্যুনতম অভিলাষ আমার নেই। কিন্তু যে রাজনীতির আদিপাঠ রাজপথ ও পরিবার থেকে সেই ছাত্রজীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছেন তাঁর ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই সকল যুক্তিই গ্রহনযোগ্য।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা এমনি একজন নেতা। বংশানুক্রমিক রাজনীতির উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতায় গত শতকের শেষ পাদে এসে দেখা গেছে যে, উত্তরাধিকারের রাজনীতি শুধুই রক্ষনশীল সমাজ ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করেনি। অনেক অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে, মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও এর ভুমিকা সর্বজন স্বীকৃত। উত্তরাধিকারের রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রেই প্রগতিশীল রাজনীতি। তবে যথার্থভাবেই সেটা স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়।

অনেক দেশেই উত্তরাধিকারের রাজনীতি করার সুযোগ না থাকলে প্রগতিশীল সমাজ গঠন ও সৃষ্টির আন্দোলন তথা সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনই হতো না। হয়ত ক্রমেই অন্ধকারে তলিয়ে যেতে হতো। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা যদি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত না হতেন তাহলে শুধু আওয়ামী লীগ নয় সমগ্র বাংলাদেশের অবস্থা কী হতো সেটা ভাবলেই গা শিউরে উঠে। কেননা, ১৯৮৩ সালে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা গ্রহনের পরে প্রথম প্রতিবাদ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই করেছিল। যার ধারাবাহিকতা চলে দীর্ঘ নয় বছর।

এবং শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল ও নেতৃত্বে সামরিক সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে সংসদীয় গনতন্ত্র, আমার ভোট আমি দেবো যাকে খুশী তাঁকে দেবো, ১৯৯৬ সালে জেনারেল নাসিম ও সেনা-অভ্যুত্থান এমন সংকটাপন্ন সময়েও শেখ হাসিনাই প্রথম হুশিয়ারী উচ্চারন করেন। ২০০১ সালের পরে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও দেশে জঙ্গীবাদের উত্থানের বিরুদ্ধে দূর্বার আন্দলন শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই দেশের সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল মাঠে নামে। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার আপ্রান প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১/১১ এর মতো দুর্যোগ এদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী সকলের জন্য খড়গরুপে হাজির হলে শেখ হাসিনাই প্রথম প্রতিবাদ করেছিল। এই সকল কিছু শেখ হাসিনা করতে পেরেছেন তিনি আওয়ামী লীগের মতো একটি গনমানুষের সংগঠনের প্রধান একারনে।

কথায় আছে, চেয়ার মেইকস এ ম্যান পারফেক্ট। কিন্তু চেয়ারে বসলেই সকলেই যোগ্য হয়ে যায় না। তাহলে সকল সমাজে ও দেশে একবার যারা বিত্তশালী হয়ে যেতো, ক্ষমতাশালী হয়ে যেতো তাঁরা কোনদিন ধ্বংস হতো না। এক্ষেত্রে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, প্রাচীনকালের সকল রাজ-রাণীরাই ধ্বংস হয়ে গেছে। বিগত কয়েক শতকেও দেখা যায়, অশিক্ষা, অভিজ্ঞতা আর পশ্চাদপদতা শুধু উত্তরাধিকার নয় জিরো থেকে হিরো হয়ে যাওয়া সকলেই ধ্বংস হয়ে গেছে।

সম্প্রতি আমাদের দেশেও একটি দলের ভাবী নেতার প্রায় একই অবস্থা। কিন্তু শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এধরনের কোন সম্ভাবনা কখনোই দেখা যায় নি। কারন, তিনি বেড়ে উঠেছেন একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে। নিজে ছাত্ররাজনীতি করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলিষ্ঠভাবে।

শুধু একটি সংগঠনের নেতাই ছিলেন না, ছিলেন সকল ছাত্রীদের ভোটে নির্বাচিত ছাত্রসংসদের নেতা। স্বামী হিসেবে যাকে পেয়েছেন তিনিও একজন নির্বাচিত ছাত্রনেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বন্দী জীবন ও মানসিক নির্যাতন সয়ে স্বাধীন দেশের স্বাধ নিয়েছেন। কাজেই শেখ হাসিনা আক্ষরিক অর্থেই জন্মগত রাজনৈতিক মানুষ। এসকল অভিজ্ঞতাই তাঁকে একজন গনমানুষের নেতা হতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে।

শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দলের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন তখন প্রকৃত অর্থেই একজন রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী এবং আওয়ামী লীগের অখন্ডতার রক্ষক হিসেবে আসেন নি। বরং এগুলো ছিল উপলক্ষ্য মাত্র। বাস্তব অর্থে তখনকার অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠীর হাত থেকে এদেশের নিরীহ মানুষকে রক্ষা করার স্বার্থেই তিনি রাজনীতিতে আসেন। যদি এক্ষেত্রে সংগ্রামী নেতৃত্বের বংশানুক্রমিকতার সুযোগ না থাকতো তাহলে এদেশের চলমান অত্যাচারী স্বৈরশাসকেরা আরও বেশি নিরাপদে শোষণ প্রক্রিয়া বজায় রাখতে সক্ষম হতো। ভারতের কংগ্রেস নেতা মতিলাল নেহরু’র পুত্র জওহরলাল নেহরু ইংরেজ বিতাড়নে নেতৃত্ব দেওয়া এবং জওহরলাল নেহরু কন্যা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর পুত্র রাজীব গান্ধী সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে যে অবদান রাখতে পেরেছেন সেটা সম্ভবত বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের কারনেই সহজ হয়েছিল।

পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো সেদেশে চলমান মধ্যযুগীয় ভাবধারার সেনাশাসক জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে না যেতেন তাহলে পাকিস্তানের জনগন স্বল্প মেয়াদে হলেও আরও কিছুকাল তখন সামরিক বুটের তলায় পিষ্ট হতেন। হয়ত মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারতেন তবে রক্ত অবারিত ধারায় বয়ে যেতো। আমাদের বাংলাদেশে বিএনপি’র চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া যদি দলের প্রধান হওয়ার সুযোগ না পেতেন আজকের বিএনপি কয়ভাগ হতো সেটা বিজ্ঞমহলের অজানা নয়। এমন কি ফিলিপাইনের কোরাজন যদি তাঁর স্বামী একিনো’র অসমাপ্ত সংগ্রামের হাল ধরতে ব্রত না হতেন তাহলে মার্কসের হিংস্র থাবা থেকে ফিলিপাইনের জনগন আজো মুক্ত হতেন কিনা অথবা মার্কসের পরিবর্তে অন্য কোন দানব ক্ষমতা দখল করতেন কিনা সেটা ইতিহাসই স্বাক্ষ্য দেয়। এদের প্রত্যেকেই প্রয়াত পূর্ববর্তীদের ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করেছেন সমাজ গঠনের রাজনীতিতে একটি গনতান্ত্রিক অবকাঠামোর মধ্যেই।

এক্ষেত্রে বলতে দ্বিধা নেই যে, অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহনই মানুষের পক্ষে স্বাভাবিকতা। কাজেই মহান ঘটনা বা ব্যক্তি থেকেও শিক্ষা নিতে হয়। সেটা শুধু সন্তানের ক্ষেত্রে নয় বরং রাষ্ট্র ও রাজনীতি পরিচালনায় সকলেই গ্রহন করে। এটাই ইতিহাসের চূড়ান্ত রায়। পঁচাত্তরে যেভাবে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হয়েছে পঁচাত্তরের পর থেকে অদ্যাবধি শেখ হাসিনা এবং প্রগতিশীল নেতাদের হত্যার ষড়যন্ত্র কোনক্রমেই কমেনি।

তার প্রকৃষ্ট উদাহরন, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১৮বার চেষ্টা চালানো হয়েছে। শেষবারের হামলার ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন। সারাদেশে শামস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাষ্টার, আইভি রহমান, মঞ্জুরুল ইমাম, মমতাজ উদ্দিন সহ অসংখ্য গনমানুষের নেতাদের হত্যা করা হয়েছে। এগুলো থেকেই স্পষ্ট হয় যে, কিলিং মিশন থেমে নেই। হন্তারকের ছুরি সর্বদা প্রস্তুত।

কাজেই আমাদের সর্বদা সজাগ ও দায়িত্বশীল থাকতেই হবে। কেননা, বাংলাদেশের রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা। আরেক ভাগের নেতৃত্ব আরেকজন নারী। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা রক্ষার আর্থবহ নেতৃত্ব শেখ হাসিনাই দিয়ে চলেছেন।

অপরদিকে রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়দান, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের পুনর্বাসন, ধর্মীয় রাজনীতির নামে জঙ্গীবাদের উদ্গাতা গোষ্ঠী। অতীত থেকে আমরা দেখেছি, এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় কারা থাকলে দেশে একযোগে সব জেলায় বোমা ফোটে, প্রকাশ্য জঙ্গীবাদের চর্চা হয়। আমরা এটাও দেখেছি যে, কারা এসবের প্রতিবাদে সোচ্চার ভুমিকা রাখেন, জঙ্গীবাদের উত্থান স্বমূলে উৎপাটন করেছেন এবং দেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। শেষোক্ত ধারাটির নেতৃত্বে শেখ হাসিনা। কাজেই শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এদেশ হারালে নিশ্চিতভাবেই দেশটি জঙ্গীবাদের চারনভুমিতে পরিনত হবে।

মুক্তিযুদ্ধের নাম-নিশানা মুছে যাবে। এজন্যই শেখ হাসিনার বেঁচে থাকা এবং নেতৃত্ব দেওয়া আমাদের জন্য জরুরী। পঁচাত্তরের পর থেকে আজ অব্দি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে হত্যার রাজনীতি শুরু হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার যে অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল সেই সময়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের মাধ্যমে জাতির নেতৃত্ব গ্রহন না করলে এদেশে শেখ মুজিব নামের মহান মানুষটি অন্ধকারেই হয়ত পড়ে থাকতো। আজ যারা বলেন যে, বঙ্গবন্ধু এদেশের সবার। তাঁরা হয়ত জানেন না যে, একদা শেখ মুজিবকে কিভাবে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই শেখ মুজিব ইতিহাসের চিরজাগরুক পুরুষরুপে আমরা দেখতে পাচ্ছি। যখন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার রহিতকরন আইন করে এদেশের সরকার বাহাদুর, তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই লন্ডনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও করনীয় নির্ধারণ করে আন্দোলন চালানো হয়েছিল। যখন সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে আওয়ামী লীগ স্পষ্টতই কয়েকভাগে বিভক্ত এবং অবশিষ্ট মূল ধারাটিও বিভক্তির চুড়ায় তখন শেখ হাসিনাই আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রেখেছে নেতৃত্বভার গ্রহন করে। গত ১/১১ এর সরকারের সময়ে গজিয়ে উঠা অনেক রথী-মহারথীরাই শেখ হাসিনার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। কিন্তু এদেশের আপামর জনসাধারন সেই ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়ে প্রমান করেছে এখনো পর্যন্ত শেখ হাসিনা অনিবার্য।

এরই ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা প্রাগ্রসর রেখে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কর্মপ্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ গুলোর জন্য মডেল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ৬৭তম জন্মদিনে শুভকামনা জানাই স্বশ্রদ্ধচিত্তে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।