দীর্ঘদিন পর আবার তারা একসঙ্গে। সুতরাং, মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘কিছু আশা কিছু ভালোবাসা’ সিনেমাটি একটু গুরুত্ব দাবি করেই বসল। আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল এ কারণে যে, দুজনই এ সিনেমায় মূল নায়িকার চরিত্র ছেড়ে দিয়েছেন; তবে মূল আকর্ষণ কিন্তু তারাই। সঙ্গে আরও ছিলেন ফেরদৌস; দুজনের যৌথ-নায়ক হিসেবে।
মৌসুমী ও শাবনূর একসঙ্গে যে সিনেমায় দেখা দিলেন, সেই সিনেমাটা কেমন হল? গল্পটা মন্দ নয়; রাজনীতিবিদ দামিনী রায়হান ওরফে মৌসুমী ও ব্যবসায়ী কামিনী খান ওরফে শাবনূরের দ্ব›দ্ব বেশ উপভোগ্য।
বিশেষ করে সিনেমার শুরুতে দুজনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্যারালাল ন্যারেশনটাও বেশ। তবে প্যারালাল ন্যারেশন একই টেকনিকে বারবার ব্যবহার করায় শেষ পর্যন্ত তা একটু একঘেয়েই হয়ে গেছে; পরবর্তীতে এই প্যারালাল ন্যারেশনের ব্যবহারে আরেকটু বৈচিত্র্য বোধহয় আনা যেত।
এদিকে আবার সিনেমা যত এগোতে লাগল, গল্পের ফাঁকফোকড়ও তত বেরিয়ে পড়তে লাগল, রীতিমতো মুখব্যাদান করে। বিশেষ করে গল্পের কন্টিনিউটির অভাব খুবই প্রকট। কিছু কিছু জায়গায় অবশ্য বেশ কন্টিনিউটি রক্ষা করা হয়েছে; যেমন খলনায়ক ইলিয়াস কোবরার অন্যের গলার স্বর নকল করতে পারার ক্ষমতার কথা আগেই জানিয়ে দেওয়া।
কিন্তু বিপরীত উদাহরণের পাল্লাটা একটু বেশি ভারি। বিশেষ করে বড় খলনায়ক ইলিয়াস কোবরার সঙ্গে ছোট খলনায়ক শিমুল খানের পরিচয়ের সূত্রটা কিন্তু সিনেমার শেষেও জানা যায়নি।
সিনেমার গল্পকথনে পয়েন্ট অফ ভিউ বা দৃষ্টিকোণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কখন কার দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প বলা হচ্ছে এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পে কোন কোন অংশ দেখানো যাবে, কোন অংশ দেখানো যাবে না, তা ঠিকঠাক রাখা স্ক্রিপ্টিংয়ের একেবারে বেসিক। ‘কিছু আশা কিছু ভালোবাসা’য় এই পয়েন্ট অফ ভিউ বজায় রাখার ব্যাপারে স্খলন ঘটেছে।
সবচেয়ে বড় স্খলনটি ঘটেছে মৌসুমী-শাবনূরের যৌথ ফ্ল্যাশব্যাক বা স্মৃতিতর্পণে। তারা দুজন মিলে কীভাবে একত্রে ফ্ল্যাশব্যাকে গেলেন, এক্ষেত্রে সেটা গৌণ প্রশ্ন। মুখ্য আপত্তি হল, তাদের যৌথ ফ্ল্যাশব্যাকে, তাদের যৌথ-অজানা তথ্যগুলো কীভাবে বলতে পারলেন, যেটা কেবল পরিচালকের দৃষ্টিকোণ থেকেই জানা সম্ভব? সমস্যাটা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে, যখন জানা যায়, সেই তথ্যগুলোই তাদের দ্বন্দ্বের গোড়া।
আবার গল্পের ফাঁকফোকড় বুজিয়ে দেওয়ার জন্য পরিচালকের যে বিশেষ মুন্সিয়ানা দেখাতে হয়, তাও অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। বিশেষ করে কিছু ক্লিনিক্যাল মোমেন্টে এই মুন্সিয়ানা দেখানো খুবই জরুরি ছিল।
যেমন নায়িকা হ্যাপির প্রতি প্রেম-ভালোবাসা-নারীতে বিশেষ বিদ্বেষপরায়ণ নায়ক আবিরের মনোভাব পরিবর্তনের পর্যায়টি একেবারেই আচমকা তো বটেই, খুবই হালকাভাবে ঘটে যায়; প্রেম জিনিসটা হওয়ার জন্য বোধহয় আরেকটু আয়াসের প্রয়োজন।
দুর্বলতা শুধু কাহিনিতেই নয়, সংলাপেও ছিল। কিছু কিছু জায়গায় সংলাপ রীতিমতো বিরক্তিকর। কিছু কিছু সংলাপ বেশ চটকদার তথা উপভোগ্যও বটে। যেমন ছোট খলনায়ক, যদিও উচ্চতায় বেঢপ লম্বা, শিমুল খান যখন খানিক বেঁকে অদ্ভুত উচ্চারণে বারবার তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বলছিলেন, “এই ধর”...!
দর্শকরা বেশ মজাই পাচ্ছিল।
আর নায়কের আইডেন্টিকাল সংলাপ রাখার আইডিয়াটা ভালো; আইডেন্টিকাল সংলাপটাও চটুল-- “আবির আমার নাম। আমি যখন আসি, তুফানের মতো আসি। আর যখন চলে যাই, কেউ আমার অস্তিত্ব খুঁজে পায় না। ”
তবে সংলাপ রচনার সময় একটু খেয়াল রাখা দরকার ছিল, বড় ধরনের কোনো তথ্যগত ত্রুটি থেকে গেল কি না। ‘বিসিএস’ পাস মৌসুমী-শাবনূর যখন একসঙ্গে কলেজে পড়তেন, তখন তারা বিসিএস-পার্টনার ছিলেন কীভাবে, তা নিয়ে বেশ গবেষণাই করতে হবে দর্শকদের।
অনেক দর্শকই হয়তো শেষ পর্যন্ত সে গবেষণা ফলাফলহীন রেখেই ইস্তফা দেবেন; কেউ কেউ আবার বিসিএস যে বিএসসি, সেই অনুসিদ্ধান্তেও পৌঁছে যেতে পারেন।
সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফিতেও বেশ বড় ধরনের স্খলন হয়েছে; অনেক ফ্রেমই ছিল ডিফোকাসড। বেশ কিছু সিকোয়েন্সে লাইটিংয়েও বেশ ঝামেলা ছিল।
তবে সিনেমার টাইটেল অংশটি বেশ মার্জিত। পুরো টাইটেল জুড়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে একই নকশা ব্যবহার করাটা এবং সেই নকশা-- উভয়ই ছিল দৃষ্টিসুখকর।
তবে নকশার সঙ্গে সিনেমার কিংবা আমাদের ঐতিহ্যের কোনো যোগ থাকলে মন্দ হত না। পাশাপাশি টাইটেলে পদবিগুলোতে নতুনত্ব আনার প্রচেষ্টা বেশ আনন্দ দিয়েছে; যেমন ‘অ্যাকশন সিন’ বা ‘অ্যাকশন ডিরেক্টর’-এর বদলে টাইটেলে ব্যবহৃত হয়েছে ‘মারপিট দৃশ্য’। পদবিগুলো উপভোগ্যও ছিল। তবে বানানের প্রতি আরেকটু মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল।
চলচ্চিত্রটিতে মৌসুমী-শাবনূর-ফেরদৌসের পাশাপাশি আরও অভিনয় করেছেন-- নায়ক-নায়িকা চরিত্রে আবির-হ্যাপি, বড় খলনায়ক ইলিয়াস কোবরা ও ছোট খলনায়ক হিসেবে শিমুল খান।
মৌসুমী ও শাবনূরের অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই; তাদের অভিনয় যথারীতি দুর্দান্ত। তবে মৌসুমী একটু বেশি নজর কেড়েছেন। ফেরদৌস তার স্বল্পায়তন উপস্থিতিতে একেবারে হতাশ করেননি; বিশেষ করে তার আবির্ভাবটা বেশ নাটকীয় হয়েছে।
ইলিয়াস কোবরা বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথাগত খলনায়কের অভিনয় চালিয়ে গেছেন। শিমুল খান কিছুটা নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়েছে, তা ধন্যবাদার্হও বটে; তবে শেষ পর্যন্ত তা কতটা সফল হল, তাও বিবেচনা করার অনুরোধ রইল।
বাকি রইল নতুন নায়ক-নায়িকা আবির-হ্যাপি। এখানে একটা প্রশ্ন জাগে-- চলচ্চিত্রটিতে নায়ক-নায়িকা নির্বাচনের মাপকাঠি কী ছিল? স্বীকার্য, তাদের নাচে আড়ষ্টতা নেই; তবে নায়ক-নায়িকাকে তো ভালো অভিনয় করতে হবে। আর নায়কের চেহারাটাও বোধহয় আরেকটু নায়কোচিত হওয়া উচিত; অন্তত নায়ক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হলে, তার চেহারাতেও তার প্রতিফলন থাকা উচিত। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানকে বস্তির নেতা-গোছের ছেলে মনে হওয়াটা খুবই অসঙ্গত।
সিনেমাটিতে কিছু বিষয় পৌনঃপুনিকভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে; এগুলোকে ‘কিছু আশা কিছু ভালোবাসা’র আইডেন্টিকাল উপাদান বলা যেতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইডেন্টিকাল উপাদান অ্যাকশন দৃশ্যের লাফ; অ্যাকশন দৃশ্যে বারবার নায়কের (মূলত আবিরের, একবার ফেরদৌসের) আবির্ভাব ঘটেছে জিমন্যাস্টিক লাফ দিয়ে। শুধু তাই না, মারামারির ভেতরেও লাফ বারবারই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এমনি আইডেন্টিকাল উপাদান আরও আছে; যেমন-- ফুল ছিটানো ও ফিতা কাটা। আর সিনেমার নাম ‘কিছু আশা কিছু ভালোবাসা’ হওয়ায়, সংলাপে বারবার এই শব্দবন্ধ বা শব্দগুলো ঘুরেফিরে এসেছে। টেকনিক হিসেবে তা বেশ উপাদেয়; তবে ব্যবহার সর্বত্র লাগসই হয়েছে, এ দাবি করা যাচ্ছে না।
সিনেমার গানগুলো মন্দ নয়; সমস্যা হল, কোনো গানই ‘মন্দ নয়’ বা ‘ভালোই’-এর ট্যাগ ঝেড়ে ‘অসাধারণ’ হয়ে উঠতে পারেনি। গানগুলোর কোরিওগ্রাফি অসাধারণ না হলেও, নায়ক-নায়িকা নেচেছেন ভালো; বিশেষত তাদের নাচে কোনো আড়ষ্টতা নেই। একমাত্র আইটেম গানটির কোরিওগ্রাফি ও নাচ বেশ ভালো। তবে তাদের নাচে বলিউডি-টালিউডি প্রভাব একটু বেশি মাত্রায় বিদ্যমান।
তবে বড় ধরনের ত্রুটি আছে সিনেমাটির সাউন্ড ডিজাইনিংয়ে।
বিশেষ করে একসঙ্গে ৬-৭টা গাড়ি ছুটে চলার দৃশ্যে ব্রেক কষার শব্দ বেশ পীড়াদায়কই ছিল।
সিনেমার ইনডোর শুটিং হয়েছে যথারীতি এফডিসিতে। গানগুলোর দৃশ্যায়ন হয়েছে মূলত কক্সবাজারে। তবে মারপিট দৃশ্যগুলো বারবার একই লোকেশনে শুট করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা একটু ভেবে দেখা উচিত ছিল। আর ইনডোরের সেট নিয়ে আরও কাজ করা যেত।
বিশেষ করে কতজন বাসার দেয়ালে নিজেদের ঢাউস সাইজের পোর্ট্রটে ঝুলিয়ে রাখে, তাও এক রহস্য; কেবল এজে তার ছবিতে এ কাজ করেছেন বলে সবাইকে করতে হবে, বোধহয় এখনও সে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। আর সেটে কৃত্রিম যে বস্তি বানানো হয়েছিল, তা কতটুকু বস্তি হয়ে উঠেছে, সে বিষয়েও বিষম সন্দেহ পোষণ করা যায়।
সিনেমাটির পোশাক পরিকল্পনায় সাফল্য মৌসুমীর পোশাকে; ব্যর্থতা শাবনূর এবং আবিরের পোশাকে। বিশেষত, খানিকটা মুটিয়ে যাওয়া শাবনূরের জন্য সেই পোশাক নির্বাচন বুদ্ধিমানের কাজ নয়, যে পোশাকে তা আরও প্রকটভাবে চোখে পড়ে। আর আবির যে এক ধনাঢ্য নারীর একমাত্র ছোট ভাই, তার প্রতিফলন তার পোশাকে-সাজসজ্জায় হওয়াটা বিশেষ জরুরি ছিল।
আর মূল নায়িকা হ্যাপির পোশাক নির্বাচন ভালো তো বটেই; কিছু কিছু গানের দৃশ্যে বেশ সাহসীও। তবে একটা গানের দৃশ্যায়নে সমতল সবুজ মাঠে হঠাৎ করেই নায়িকাকে স্যুইমস্যুট-সদৃশ পোশাক পরাটা কতটুকু প্রাসঙ্গিক, তা চিন্তার বিষয়; ওই পোশাকে নায়িকাকে বঙ্গোপসাগরের তীরে নিয়ে গেলে বরং ভালো হত।
হ্যাপি কেবল পোশাকেই সাহস প্রদর্শন করেননি, চুম্বন দৃশ্যায়ন করেও সাহস প্রদর্শন করেছেন। চুম্বনটিও বেশ; কেবল চুম্বনটি ঠিক প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেনি। সিনেমায় নায়ক-নায়িকার চুমু খাওয়ার জন্য যে রোমান্টিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা দরকার, কিংবা যে বেপরোয়া পরিস্থিতির প্রয়োজন, সে সব ছাড়াই, একরকম হঠাৎ করেই নায়ক-নায়িকা চুম্বন করে বসেন।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত একটি অশ্লীলতা-সৃষ্টির-চেষ্টা-রহিত চুম্বন-দৃশ্যের জন্য পরিচালককে ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে।
তবে আরেকটি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের জন্য শেষ পর্যন্ত পরিচালককে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত কি না, তা রীতিমতো চিন্তার বিষয়। ছোট খলনায়ক শিমুল খান এক দৃশ্যে, সে যে ‘বিশ্বহারামি’ সম্ভবত তা প্রমাণের জন্যই, ফুচকা খেয়ে জাতীয় পতাকায় হাত মুছে ফেলে। আর তাই দেখে নায়ক এসে ‘তুই রাজাকার’ বলে তাকে রীতিমতো ছুড়ে ফেলে দেয়। খলনায়ককে ‘রাজাকার’ বলে ‘রাজাকার’ গালিটাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা অবশ্যই উত্তম, কিন্তু তার প্রেক্ষাপট সৃষ্টির জন্য ফুচকার দোকানে তেরছাভাবে জাতীয় পতাকা লাগানো এবং তাতে খলনায়ককে দিয়ে হাত মোছানো কেন গর্হিত কাজ নয়, তার জন্য এমনকি সমনও জারি করা যেতে পারে।
শেষ পর্যন্ত তাই মৌসুমী-শাবনূর অভিনীত এই চলচ্চিত্র দেখে মৌসুমী-শাবনূরের পুরনো দিনের কথা মনে করে যেমন নস্টালজিক হয়ে যেতে হয়, তাদের সেই পুরনো ঝলক দেখে চমৎকৃত হতে হয়, তেমনি পুরনো একটি প্রশ্ন আবারও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, সেন্সর বোর্ড আসলে কোন মাপকাঠিতে চলচ্চিত্র সেন্সর করে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।