আসন্ন জাতীয় নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে কিনা সেই প্রশ্নে সমগ্র জাতি যখন উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত এবং দুশ্চিন্তার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, দেশের ১৬ কোটি মানুষের লালিত আকাঙ্ক্ষা যখন অনিশ্চয়তার সাগরে নিমজ্জিত ঠিক সেই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী পরস্পরের সম্পর্কে দুটি মারাত্দক অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ এনেছেন। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেত্রী অভিযোগ উত্থাপন করেছেন_ এটি নাস্তিকতার দল, এটি মুরতাদের দল। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী সংসদের অভ্যন্তরে এবং বাইরে ক্রমাগত বলেই চলেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী জঙ্গিবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চান এবং তালেবানদের কাছ থেকে তিনি সরাসরি মদদ পাচ্ছেন। কথাটি নির্জলা মিথ্যা এটি বলার দুঃসাহস আমার নেই, কিন্তু জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য এ দেশটির যে ভাবমূর্তি সারা বিশ্বে গড়ে উঠেছিল তার প্রতি এই দুটি মন্তব্যই ভয়ঙ্কর।
বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। এদেশ সম্বন্ধে মুসলিম বিশ্বে যদি ধারণা হয়, এই দেশটির মধ্যে ধর্মের প্রতি আনুগত্য নেই, বিশ্বাস নেই, ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে আমরা ধর্মহীনতায় বিশ্বাস করি_ তাহলে মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশ থেকে যেমন মুখ ফিরিয়ে নেবে, ঠিক তেমনি আমাদের অর্থনৈতিক বিনির্মাণে মুসলিম বিশ্বের যে সমর্থন, সাহায্য এবং সহমর্মিতা তার ওপর যে নিদারুণ আঘাত আসবে এটি যে কোনো বিবেকপ্রসূত ব্যক্তি নিঃসন্দেহে অনুভব করতে পারেন। বিরোধী দলের নেত্রীর এ ধরনের কোনো উক্তির আগে বিষয়টি অবশ্যই তার মননশীলতার মধ্যে, চেতনা ও উপলব্ধির মধ্যেও রাখা উচিত ছিল।
অন্যদিকে যে কোনো বিশ্বস্ত মুসলমান যে আল্লাহ ও কোরআনে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর রাসূলকে (সা.) অনুসরণ করে তারা জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করে। কিন্তু আজকে জঙ্গিবাদের যে বীভৎস চিত্র পৃথিবীতে প্রতিভাত হয়েছে, সামগ্রিকভাবে ইসলামের প্রতি যে অপপ্রচার চলছে, পৃথিবীর বিভিন্ন মিডিয়া যেভাবে আজকে ইসলামের সঙ্গে জঙ্গিবাদকে একই রাখিবন্ধনে বেঁধে অপপ্রচার করছে সেটির প্রতি নিঃসন্দেহে এটি একটি ইঙ্গিত নয়, এটি বাংলাদেশের প্রতি বিশ্ব জনমতের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির উপকরণ মাত্র।
আমরা যারা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি, আমাদের বিশ্বাসের আঙ্গিক হলো এদেশের সব নাগরিকের ধর্ম পালনের অধিকার সমান। আমরা ধর্মহীনতাকে ধর্মনিরপেক্ষতার নামান্তর হিসেবে মানি না।
আমরা মনে করি, এ দেশে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু বলে কোনো কথা নেই, আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। 'এ মাটি আমার সোনা/ আমি করি তার জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা'_ শাশ্বতভাবে এই সত্যটি সবার জন্যই প্রযোজ্য। ঠিক তেমনিভাবে আমরা শুধু স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি হিসেবে নয়, একজন মুসলমান হিসেবেও আমরা ধর্মান্ধতা এবং জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরোধী।
আমরা সম্প্রতি রাজনৈতিক পথপরিক্রমণের মধ্যে যে কথাটি ক্রমান্বয়ে উপলব্ধি করছি_ দেশটিকে দুটি আঙ্গিকে, দুটি চেতনার ধারায় বিভক্ত করার জন্য বোধহয় সুপরিকল্পিতভাবে দুই নেত্রী এগিয়ে চলেছেন। এটি জাতির জন্য শুধু ভয়ঙ্কর পরিণতিই টেনে আনবে না, একটি গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও তৈরি করছে। এটি জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের গড়ে ওঠা সম্প্রীতি নষ্ট করছে। স্বাধীন হওয়ার পরে কমপক্ষে ৬০০ বার ভারতে দাঙ্গা হয়েছে, কিন্তু কখনোই তারা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিভাত করার কোনো চেষ্টা করেনি, বরং ব্যাপারটিকে নিজেদের মধ্যে সমাধান করার চেষ্টা করেছে এবং এটি যেন আন্তর্জাতিক মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা না পায় তার সর্বোত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
আমাদের দেশ দুর্ভাগ্যের অধিকারী।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে আমি বলতে চাই, পাকিস্তান আমলেও আমি লক্ষ করেছি, আমরা যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত ছিলাম_ এদেশের ভাষা, সংস্কৃতি, মননশীলতা এবং দেশের মানুষের উপলব্ধিকে অন্তর দিয়ে আমরা যারা উপলব্ধি করতাম, মানুষের হৃদয়ের অনুরণকে আমরা যারা জাতীয় রাজনীতির আঙ্গিকে জাতীয় চেতনার অংশে সংশ্লিষ্ট করার চেষ্টায় ব্যাপৃত ছিলাম তারা সব সময়ই ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-মননশীলতায় বাঙালি এবং ইমানের আকিদায় মুসলমান। হিন্দুরা তাদের ধর্ম যথাযথভাবে পালন করবে; কিন্তু সম্রাট আকবরের মতো সব ধর্মের থেকে কিছু কিছু নিয়ে 'দীন-ই-ইলাহি'র মতো একটি অভিনব রাজনৈতিক চেতনা তৈরি করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের একইভাবে লড়াই করতে হয়েছে।
আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। আমি রবীন্দ্রভক্ত। আমার মুসলমানিত্বে এটি কোনো আঘাত হানেনি।
কিন্তু যারা রবীন্দ্রসংগীত বা রবীন্দ্র সাহিত্যকে ভালোবাসেন, যারা শান্তি নিকেতনকে তীর্থস্থান বলেন তারাই এসে আজকে ক্ষমতাসীন দলকে চারদিক থেকে বাস্তিল দুর্গের মতো অবরুদ্ধ করেছেন। তারা যখন শান্তি নিকেতনকে তীর্থস্থান বলেন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে আমি বলি, শান্তি নিকেতন তীর্থস্থান নয়, এটা পীঠস্থান। কাশী, গয়া, বৃন্দাবন_ এগুলো হিন্দুদের তীর্থস্থান এবং মুসলমানদের তীর্থস্থান হচ্ছে মক্কা ও মদিনা। কিন্তু শান্তি নিকেতনের সঙ্গে তাকে তুলনা করে কিংবা শান্তি নিকেতনের বিকল্প ধরে যারা কথা বলেন তারা না বাঙালি, না মানবতাবাদী; তারা হচ্ছেন পারিষদবর্গ, তারা হচ্ছেন জ্ঞানপাপী; তারা বাঙালি চেতনার স্ফূরণের পরিপন্থী।
আজকে এই মারাত্দক যুগসন্ধিক্ষণে ১৪০ জনের বিরাট বহর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকা সফর ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় যন্ত্রে এবং দলের ভেতরে এ বিষয়টির নেতিবাচক দিক নিয়ে ভাবার এবং প্রধানমন্ত্রীকে তা অবহিত করার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। দেশের অর্থনীতি যখন প্রচণ্ড নাজুক অবস্থার মুখোমুখি তখন দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানিখাত পোশাকশিল্পে যে প্রচণ্ড বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চলছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে মন্ত্রিপরিষদের শক্তিশালী সদস্যও এতে অংশগ্রহণ করছেন তখন অর্থনৈতিক সিডর বা সুনামি তো বটেই, সামাজিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা বিমুক্ত আমরা হব কীভাবে?
ড. ইউনূসকে নিয়ে বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্কের যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে নির্বাচনের প্রশ্নে নয়, জাতীয় স্বার্থেই তা সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। আমি প্রায়শ বলেই চলেছি, তাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে ভ্রাম্যমাণ দূত বানিয়ে এ সমস্যাটি সমাধানে সচেষ্ট হলে শুধু দেশ ও জাতির সংকট নিরসন হবে না, প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টা সমাদৃত হবে। প্রসঙ্গক্রমে অতি বিনীতভাবে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসকে অনুরোধ করতে চাই_ আমরা মহাসংকটের যুগসন্ধিক্ষণে অবস্থান করছি। আপনি কোনো রাজনৈতিক চক্রান্তে পা দেবেন না।
কেবল রাজনৈতিক নিরপেক্ষতাই আপনার অর্জিত সম্মানকে সমুন্নত রাখতে পারবে।
সাম্প্রতিককালে সিরিয়া সংকটে বারাক ওবামা কংগ্রেসের সমর্থন না পাওয়ার আশঙ্কায় যে সমঝোতার উদ্যোগটি গ্রহণ করেন সেটি তাকে গৌরবান্বিত করেছে এবং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও যে ক্ষমতার ভারসাম্যের আওতায় তা প্রমাণ করেছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিবেশটি একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী। সংগঠনের অভ্যন্তরে, সংসদে, কার্যনির্বাহী পরিষদে এবং দুটি দলের প্রেসিডিয়াম এবং স্ট্যান্ডিং কমিটিতে কোনো বিষয়েই পর্যালোচনা, আলোচনা হয় না। সব প্রশ্নেই দুই নেত্রীর ইচ্ছাই শেষ কথা এবং সেটিই সিদ্ধান্ত।
তাদের যে প্রতিহিংসাপরায়ণতা, অপরিশীলিত, অমার্জিত মানসিকতা এবং ক্ষমতার প্রতি নির্লজ্জ আকর্ষণ আজ রাজনীতির শেষ কথা। শাসনতান্ত্রিকভাবে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোথাও এ রকম ব্যক্তিতান্ত্রিক রাজনীতি আছে বলে আমাদের জানা নেই। এটা মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের চেয়েও বীভৎস। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় সুশীল সমাজের পক্ষ হতে বিবেকবান সাংবাদিক, শিক্ষক, নিষ্কলুষ বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, সাধারণ মানুষকে অকুতোভয়ে সরব হতে হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেশের সব মানুষের শাশ্বত দাবি।
সব আলেম, মাশায়েখ জামায়াতকে ইসলামের পরিপন্থী শক্তি মনে করে। হেফাজত ইসলামও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের কিছু অনভিপ্রেত বাড়াবাড়ির কারণে হেফাজতে ইসলাম ৪৮ ঘণ্টার মহাসমাবেশ ও অবস্থান ধর্মঘটের ঘোষণা দেয় এবং সেই সুযোগে বেগম খালেদা জিয়া একটা আলটিমেটাম দিয়ে বসেন। ফলে সমাবেশটি সরিয়ে দেওয়া সরকারের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই অবস্থান ধর্মঘটটি অপসারিত হলে বেগম খালেদা জিয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যায়, কিন্তু হতাহতের সংখ্যা নিয়ে যে অলীক অপপ্রচার শুরু হয় সেটাকে রোধ করার জন্য বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে অবারিত তদন্তের সুযোগ দিলে এই অপপ্রচারের হাত থেকে আওয়ামী লীগ রক্ষা পেত।
দূরদর্শিতার অভাবেই সেটি হয়নি। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত সমালোচনার শিকার হতে হয় দলটিকে। এত বড় একটি বিষয়ে দলের মধ্যে অথবা নীতিনির্ধারকদের মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ হলে অবশ্যই এর একটি সমাধান তৈরি হতো। তা না হওয়ার কারণে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে, বিশেষ করে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে মারাত্দক খেসারত দিতে হয়েছে। বিএনপির আলটিমেটাম ব্যর্থ হওয়ার পর ক্ষমতাশ্রিত দলটি যখন ইনটেনসিভ কেয়ারে অবরুদ্ধ হলো তখন আওয়ামী লীগের ওপর নেতিবাচক মনোভাবের কারণেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারের নিদারুণ পরাজয়।
বিরোধী দলকে ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে বের করে এনে রাজনৈতিক অঙ্গনে আস্ফালনে মাতিয়ে তুলল। সরকার এবং বিরোধী দলের কোনো স্তরেই গণতন্ত্রের চর্চা না থাকার কারণে শুধু নির্বাচনের প্রশ্নেই সংশয় নয়, দেশ দ্রুত গতিতে সংঘাত ও গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হছে। এটি এমন বিপদের অশনি সংকেত যা সিডরের মতো প্রলয়ংকরী আঘাতে দেশ, জাতি, সরকার, বিরোধী দলকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে। যারা নেতৃত্বের শীর্ষে অবস্থান করছেন অবশ্যই তাদের বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।