মার্চের শেষের দিকের এই সময়টায় ধীরে ধীরে গরম বাড়তে শুরু করে। দূর থেকে রাস্তার ধারে দাড়িয়ে থাকা ঘামে চিকচিক করা মানুষগুলোকে দেখলে গরম যেনও আরও বেশী অনুভূত হয়। বেশ কিছুক্ষণ হলও জাহানারা বারান্দায় এদিকটায় এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রায় অনেকদিন ধরেই তারা এলিফ্যন্ট রোডের একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে ভাড়া থাকেন। তাদের বারান্দা থেকে ব্যস্ত শহরটার প্রায় অর্ধেকটাই খুব সহজে দেখা যায়।
মেইন রোডের এতো অসংখ্য মানুষের মধ্যে জাহানারা শুধু একজনকেই খুঁজেন প্রতিদিন। যদি হটাত দেখতে পারেন তূর্য হেটে আসছে নীলক্ষেত অথবা মোতালেব প্লাজার রাস্তার পাশ ঘেঁষে? তাই এভাবে প্রায় প্রতিদিন বারান্দায় জাহানারাকে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, প্রায় অনেকটা সময় ধরে। একটা সময় সকলের অগোচরেই মায়ের চোখে অশ্রু আসে। অন্ধকারে আচ্ছন্ন মায়ের মুখটা কেউ খেয়াল করেনা। জাহানারার চোখের সবটুকু অশ্রুর বিনিময়েও যদি আল্লাহ তার ছেলেটাকে ফেরত দিতেন তবে অনন্তকাল ধরে এভাবে সর্বশক্তিমানের নিকটা অশ্রু বিসর্জনে রাজি আছেন তিনি।
গত ডিসেম্বরের এক বিকেলে হটাত করেই জাহানারার জীবনটা একেবারে শূন্য হয়ে গেলো। সেদিনও বারান্দা থেকে ছেলেটাকে নীলক্ষেতের দিকে হেটে যেতে দেখেছিলেন তিনি। অনেক অচেনা মানুষের মধ্যে নিজের ছেলেকে চিনতে একটুও ভুল হচ্ছিলো না তার। হটাত করে কিভাবে জানি তূর্য একদিন বড় হয়ে গেলো। সে এখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র।
একদিন ক্লাস শেষে, ছেলে তার সাথে তার এক মেয়ে বান্ধবীকে নিয়ে উপস্থিত। তুর্যকে সেদিন খুব লাজুক দেখাচ্ছিলও। সেদিন প্রথমবারের মত জাহানারা বুঝতে পারলেন তার এই ছেলেটি আর সেদিনের ছোট্ট ছেলেটি নেই। সেই তুর্যকে আর কখনো দেখতে পাবেন না এমনটা কখনো ভাবতেই পারেননি তিনি। এরকম ভাবনা কোন মায়ের পক্ষেই ভাবা সম্ভব নয়।
তুর্য নিখোঁজ হয়েছে আজ প্রায় তিন মাস হলও। থানায় জিডি করা হয়েছে, শুরুর দিকে বেশ কয়েকবার পত্রিকায় ছবিও ছাপানো হয়েছিলো। এ পর্যন্ত কারো কাছ থেকেই কোন খবর আসেনি।
জাহানারার স্বামী ইকবাল সাহেব ছিলেন পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তার মৃত্যু হয় আজ থেকে প্রায় একবছর আগে।
স্বামীর মৃত্যুতেও এতোটা ভেঙে পড়েননি তিনি। মারা যাওয়ার আগে, ইকবাল তার স্ত্রী এবং সন্তানের জন্য বিশাল সম্পদের পাহাড় রেখে গিয়েছিলেন। সেদিন স্বামীকে হারিয়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাহানারা। তার স্বামী ইকবালের রেখে যাওয়া এই অর্থই হয়তো তূর্যকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো। ছেলের বিনিময়ে কেউ অবশ্য এখন পর্যন্ত কোন মুক্তিপণ দাবি করে নি।
ছেলেটা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে এইটিও জাহানারার জানা নেই। ওদের কাছে তার একটাই আকুতি ছেলেটাকে ফেরত দিক তারা মায়ের কাছে।
এই ভর-দুপুরে বারান্দার দাঁড়িয়ে মায়ের চোখ থেকে তার সন্তানের জন্য ঝরে পরা এক একটা অশ্রুবিন্দু যেনও প্রচণ্ড অভিশাপ দিতে চায়। হটাত করেই জাহানারা লক্ষ করলেন তার পায়ের ঠিক পাশেই ফুলের টবটিতে থাকা ফুল গাছটার আজ কি মৃতপ্রায় অবস্থা ! তুর্য খুব যত্ন করতো এই ফুল গাছটার। প্রতিদিন সকালে ছেলেকে গাছটায় পানি দিতে দেখতেন তিনি।
তুর্যের বিদায়ের দিন গাছটায় একটি ছোট্ট নীল ফুল ফুটে থাকতে দেখেছিলেন। জাহানারা খেয়াল করলেন আজ তার চোখের সব অশ্রু নিজের অজান্তেই গাছটার উপর গিয়ে পরেছে। হয়তো প্রতিদিনই এমনটা হয়। ফুলগাছটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি। একমুহুর্তের জন্য তার মনে হতে লাগলো এই গাছটা হচ্ছেন তিনি নিজে।
সময়ের সাথে ফুল গাছটির সেই ফুলটা যেমন ঝড়ে পরেছে তার কাছ থেকে তুর্য নামের ফুলটিও হারিয়ে গেছে ঠিক এভাবেই। ছেলেটা বড় অভিমানী ছিলও তার, মায়ের কাছেই শুধু ছিলও তার সকল আবদার। আজ প্রায় তিন মাস হলও তুর্য ঘরে ফেরেনি। একদিন হয়তো এই গাছটিতে আবার নতুন ফুল ফুটবে। জাহানারার প্রতিদিনের অশ্রুগুলোই হয়তো বাঁচিয়ে তুলবে মৃতপ্রায় এই ফুল গাছটিকে।
নিজেকেই নিজে জিজ্ঞাস করলেন তিনি, তাকে কে বাঁচাবে? তিনি কি নিয়ে বাঁচবেন? তুর্য ফিরে আসবেতো?
এসব প্রশ্নের একটির উত্তরও তার জানা নেই। তিনি তাকিয়ে আছেন মৃতপ্রায় গাছটির দিকে। তার মনে হতে লাগলো গাছটিও তার দিকে তাকিয়ে আছে!
Sazzad chowdhury
Email:
Facebook : https://www.facebook.com/ThePrimeSaZZAd
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।