Don't Ever Be Lonely (A Poor Little Fool Like Me)
দ্বিতীয় সান্দাকফু ফালুট ট্রেকিং
---------------------
শুরুতেই বলে রাখি যে এটি হচ্ছে আমার সান্দাকফুতে দ্বিতীয় ট্যুরের বর্ণনা এবং প্রথম ট্যুরের যাবতীয় বর্ণনা ছবি সহ এই লিংকে পাবেন।
Click This Link
যেহেতু প্রথম ট্যুরের বর্ণনায় আমি যতটুকু জানি ততটুকু তথ্য বিস্তারিত দেয়ার চেষ্টা করেছি তাই এই দ্বিতীয় ট্যুরের বর্ণনায় তথ্য থাকবে কম এবং কাহিনি থাকবে বেশি। এই বর্ণনা পড়ে কারও যদি ট্যুরের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে আমি অনুরোধ করব যে আগে প্রথম ট্যুরের পোস্টটা পড়ে নিন তাহলে অনেক প্রশ্নের উত্তর এমনিতেই পেয়ে যাবেন এবং এর পরও যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে এই পোস্টের কমেন্টে অথবা আমার ইমেইল অথবা আমার ফেইসবুকে ইনবক্স করতে পারেন
Email –
Facebook – https://www.facebook.com/farooqueoldies
প্রথম সান্দাকফু ভ্রমণ শেষ করেই আমার ট্রেকিং পার্টনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কোরবানির ঈদের পরে আমরা আবার যাব সান্দাকফু, কারন কুয়াশা আর খারাপ আবহাওয়ার জন্য অনেক কিছুই দেখতে পারিনি আর অক্টোবারের শেষে সম্ভবত আবহাওয়া পরিস্কার থাকবে। যথারিতি রুবেল ভাই আমাদের ফেইসবুকের সান্দাকফু পেইজ থেকে একটি ইভেন্ট করলেন। প্রথমে ইভেন্টটি আমাদের চেনা জানা শোনার ভিতরে ছিল অর্থাৎ আমরা শুধু যাদের সাথে ট্রেকিং করতে আগ্রহী ছিলাম তাদেরই শুধু ইনভাইটেশান পাঠিয়েছিলাম।
ধীরে ধীরে সময় বয়ে যায় এবং দুমাস আগে আমি ইভেন্টে পোস্টিং দিতে থাকলাম যে যারা যারা যাবেন তারা যেন এক্ষুনি ভিসার জন্য এপ্লাই করে ফেলেন। যাই হোক শেষে যাবার জন্য রেডি হোল মোট চার জন – আমি, বাবলা, ইরাজ এবং শুভ, রুবেল ভাই এর ভিসা হয়নি এবার কারন উনি ১০ দিনের ব্যাবধানেই অফিসের কাজে ইন্ডিয়া ঘুরে এসেছিলেন এবং খুব ইমারজেন্সি না হলে নাকি এত দ্রুত পুনঃ ভিসা দেয় না। দুর্ভাগ্য – যিনি ইভেন্ট করেলেন প্ল্যান করলেন তিনিই যেতে পারলেন নাহ – এবং পরবর্তীতে ট্যুরে গিয়ে আমার নিজেরই অনেক আফসোস হোল যে আজ রুবেল ভাই থাকলে দেখতে পেতেন চিত্রে থেকেই কাঞ্চন দেখা যায়!
ঈদের পরের দিন অর্থাৎ ২৮শে অক্টবার রাতে আমাদের গাড়ি। এবার আর সরাসরি শ্যামলির টিকিট কাটিনি কারন সিট পাইনি আর আমি নিজেও ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম দেখি ব্যাপারটা আসলে কেমন এবং এই ঝামেলাটা আমি পড়তে খুব বিরক্তিকর হলেও খুব বেশি বর্ণনা দিয়ে লিখছি কারন আমার মত কেউ যাতে সাফার না করে।
আটটা তিরিশ মিনিটের হানিফ পরিবহন বুড়িমাড়ী বর্ডার গিয়ে পৌঁছুল ভোর সাড়ে চারটায়, পৌছা মাত্র আমি কাউন্টারে গিয়ে দেখি সবাই পাসপোর্ট জমা দিচ্ছে এবং পাসপোর্ট প্রতি ২০০টাকা করে হানিফের কাউন্টার থেকে নিচ্ছে।
আমি ভাবলাম এত ভোরে যখন পৌঁছে গিয়েছি তখন বোধয় তারাতারিই বর্ডার পার হয়ে যাব। কিচ্ছুক্ষন পরেই বুঝতে পারলাম যে কি ভুল করেছি – আমাদের আগে আরও ৪টা পরিবহনের গাড়ি আছে যার প্রত্যেকটিতে নুন্যতম ৪৫ জন করে যাত্রী। কথাটা শুনে আমি মুষড়ে পড়লাম, শেষে শুভ ভাই এর এক পরিচিত লোকের মারফতে কোন রকম ঝামেলা চেকিং ছাড়াই বর্ডার পার হয়ে গেলাম এবং শ্যামলির আগেই। এর পর আমি যদি বর্ডার ক্রস করি তাহলে কোন পরিবহন কে টাকা দিব না – সোজা লোকাল দালাল ধরব, ৯টা বাজলে সরাসরি দালাল মারফত ডিরেক্ট পগার পাড়।
@বুড়িমাড়ি বর্ডার
এবার যেহেতু শ্যামলিতে যাইনি তাই বর্ডারের ওপারে গাড়ি ভাড়া করতেই হল এবং আমার মনের একটি সুপ্ত বাসনা ছিল যে এম্বাসিডর গারিতে উঠা এবং একটি আমরা ভাড়াও করে ফেললাম ১৩০০/- রুপিতে শিলিগুরি।
এম্বাসিডর স্টার্ট হয়া মাত্র মনে হল বনেটের ভিতরে কোন স্যালো – ইয়ানমার ইঞ্জিন চালু হল, এমন বিকট আওয়াজ যে আমি নিজেকে গালি আর অভিশাপ দিতে থাকলাম কিন্তু চেহারায় অনুভূতিটুকু লুকিয়ে রাখলাম যাতে বাকি তিনজন আবার বিচলিত না হয়। কিছুক্ষন চলার পরে দেখলাম আমাদের ড্রাইভার একটি শর্টকাট দিয়ে তিতাস ব্রিজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং ততক্ষণে সেই স্যালো ইঞ্জিনের আওয়াজ সহ্য হয়ে গিয়েছে এবং পথের মাঝখানে আমরা গেন্ডারি/আখ কিনে কামড়ে কামড়ে-ছিড়ে খেতে খেতে চললাম সবুজ ফসলের ভিতরে বিরান এক রাস্তা দিয়ে। এটা পুজোর সিজন ছিল তাই আমাদের দেশে যেমন মাদ্রাসা মাসজিদের জন্য রাস্তা আটকায় তেমনি গ্রামের ভিতরে রাস্তার পাশে দেখলাম পুজোর জন্য, আমাদের ড্রাইভার অবশ্য সব জায়গাতেই নিজের পকেট থেকে কিছু দিয়ে গেল। তিতাস ব্রিজ পার হবার পরে বুঝলাম এম্বাসিডর কেন এম্বাসিডর – এর সাস্পেনশান এতই আরামদায়ক যে আমার মনে হচ্ছিল ভাঙ্গা আসে না ক্যান একটু দুলে নেই- দুলুনিটা সত্যি মজার ছিল। আড়াই ঘন্টায় শিলিগুড়ি পৌঁছে সোজা দিলিপ দা কে খুজলাম মানেভাঞ্জান যাবার গাড়ি রিজারভেশানের জন্য।
উনি দেখি আমাকে দেখেই চিনে ফেললেন – মনে হয় উনার গাড়ী দিয়ে আমরাই একমাত্র মানেভাঞ্জান গিয়েছিলাম। এবার আমাদেরকে উনি একটি টাটা সুমো দিলেন ২৫০০ রুপিতে। গাড়ীতে ব্যাগ ভরেই সোজা চলে গেলাম উল্টা দিকের ঢাকা হোটেলে। ইচ্ছে মত খেয়ে দেয়ে শুরু করলাম মানেভাঞ্জানের উদ্দেশ্যে যাত্রা।
@ঢাকা হোটেল - শিলিগুড়ি
আমি জানি না আর কারো ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য কিনা তবে সেই চেনা রাস্তা আর চেনা স্মৃতি দিয়ে যেতে যেতে আমার যে কি পরিমান আনন্দ হচ্ছিল তা বলে বোঝাবার নয়।
সেই ক্যান্টমেন্টের ভিতর দিয়ে রাস্তা সেই পরিচিত পাথুরে নদী। যাবার সময় একটি বিড়াল কে রাস্তা পার হতে দেখে দেখি আমাদের ড্রাইভার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে বসে রইল – আমি ঘটনাটা কি জিজ্ঞেস করার আগেই উনি আবার গাড়ি চালু করলেন – বলা বাহুল্য এইবার আমাদের ড্রাইভার নিখাদ বাঙালি আর আগের ড্রাইভারটা ছিল নেপালি যিনি বাংলা বলা আর বোঝা তে একটু আটকে যেতেন। যাই হোক বিড়ালকে গার্ড অফ অরনার দিয়ে আমারা পর্বতের ঢাল বেয়ে উঠা শুরু করলাম।
চা বাগানের ভিতর দিয়ে যখন গাড়ি চলছে সাথে নস্টালজিক গান – আহ এই অনুভুতি বলে বোঝাবার নয়। সবাই গানের কোরাস গাইতে গাইতে ঘন পাইন বন আর চা বাগানের ভিতর দিয়ে মিরিক পৌঁছে গেলাম।
গতবার পন করেছিলাম মিরিকে একটু বেশি সময় দিব, কিন্ত মিরিক এসে পুরাই হতবাক – মিরিক লেকের মাঠটায় বোধয় কোন অনুষ্ঠান হয়েছিল – চেয়ার প্যান্ডেল আর ধুলা বালুতে পুরা এলাকা একাকার আর কোথা থেকে যেন খালি ট্যুরিস্ট আর ট্যুরিস্ট এসে পুরো এলাকা গিজ গিজ করছে। যথারিতি লোকাল চা খেয়ে আর মুড়ি ভর্তা নিয়ে আবার গাড়ীতে উঠলাম।
@মিরিক লেক
@মিরিকের চা
ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার আবছা অবছায়া আর চাদের সোডিয়াম আলোতে আমরা অনন্ত পথ ধরে চলছি আর সাথে কিছু নস্টালজিক গান। একটু পরে মাথা ঘুড়িয়ে দেখি সবাই ঘুমে কাতর। গান শুনতে শুনতে আমিও কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই কিন্ত শুকিয়াপোখারি তে এসে ড্রাইভার যখন আশে পাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করা শুরু করল মানেভাঞ্জানের রাস্তা কোনদিকে তখন বুঝলাম এই বান্দা কখনও মানেভাঞ্জান আসেনি, ঘুম উবে গেল।
কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না, গাড়ি গাড়ির মত চলছে ত চলছেই, মাঝে মাঝে দেখি ড্রাইভার লাইট দিয়ে তেলের লেভেল দেখছে। একসময় সে পুরোপুরি সন্দিহান হয়ে আমাকে জিগেস করল এটাই মানেভাঞ্জানের রাস্তা কি না, আমি বললাম শুকিয়া থেকে বামে এই একটাই রাস্তা আর সেটা সোজা মানেভাঞ্জানের দিয়েই গিয়েছে – কিন্ত রাস্তার অবস্থা এত খারাপ কিছুকিছু জায়গার যে আমি নিজেই সন্দিহান হয়ে উঠলাম আসলেই কি আমরা ঠিক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি কিনা। অন্ধকারে যা হয় – হাল্কা অতঙ্ক এসে ভর করে এবং তখন নিজের ডাইনিংরুমও ক্যাসেল ট্রান্সিলভিনিয়া হয়ে যায়।
মানেভাঞ্জানঃ-
সন্দেহ – অতঙ্ক আর তেলের লেভেল দেখতে দেখতে কিছুটা চুরান্ত পর্যায়ে এসে আমারা শেষে মানেভাঞ্জান পৌছুলাম। আহ আবার সেই হোটেল এক্সটিকা – দৌড়ে উপরে উঠলাম জীবন দা’র সাথে দেখা করার জন্য।
জিবনদা আমাকে দেখেই চিনে ফেললেন এবং সাথে সাথেই বললেন যে আমাদের দিদি গিয়েছেন শিলিগুরি বেড়াতে। এর একটাই অর্থ যে রাতে ডিনার বাইরে করতে হবে। আর এখানকার লোকাল রেস্টুরেন্টক গুলো সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে যায় সেখানে পৌনে আটটা’ত গভীর রাত, কথাটা গোপন করে সবাইকে নিয়ে বাইরে এলাম, এসে নিচের দোকান থেকে ইচ্ছামত চকলেট আর বাদাম কিনলাম। রুমে এসে বললাম এগুলো দিয়েই আমাদের ডিনার করতে হবে। হঠাৎ দেখি হুড়মুড় করে আর একটা গ্রুপ এসে ঢুকল হটেলে – হ্যা এরাই নয়ন ভাই এর গ্রুপ।
ঘটনার শুরু আরও অনেক আগে থেকে... আমাদের ইভেন্ট থেকে নয়ন ভাই এর সাথে পরিচয় এবং উনি বললেন উনারা যাবেন ১৮ তারিখে এবং আমাদের ও যেতে বললেন তাদের সাথে। আমি বাংলাদেশ থেকেই জীবন দা’র সাথে যোগাযোগ করেছিলাম এবং তিনি বলেছিলেন যে আমরা যদি ৩১তারিখে সান্দাকফু উঠি তাহলে সমস্যা হবে না – জিজ্ঞেস করেছিলাম সমস্যাটা কি – উনি বললেন প্রতি বছর এই সময় একটি ট্রাভেল গ্রুপ একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট করে দৌড়ে সান্দাকফু উঠা আর নামার এবং এর জন্য ওরা পথের সব লজ অগ্রিম বুকিং করে ফেলে, ফলে সাধারন ট্যুরিস্টদের থাকার চরম সমস্যা হয়। নয়ন ভাই কে ব্যাপারটা জীবনদা বলেছিলেন কিন্ত নয়নভাইয়ের কিছু করার ছিল না, ছুটি নিয়ে নেয়া হয়ে গিয়েছিল তাই ‘যা আছে কপালে’ টাইপের অবস্থা মাথায় নিয়েই গিয়েছিলেন। উনাদের কাছে শুনলাম ট্রেকিং করে উনারা সান্দাকফু উঠে এই প্রচন্ড শীতে কোন কটেজে থাকার যায়গা পাননি – কোনমতে অভিশাপ দিতে দিতে নাকি রাত পার করেছিলেন এবং পরেরদিন গাড়ী দিয়ে সোজা মানেভাঞ্জান এবং এসেই আমাদের সাথে দেখা। আমি একটু মজা করে উনাদের মনভাব পরিবর্তন করার চেষ্টা করলাম।
এদিকে একটি ক্ষীণ আশায় আবার জীবন দার কাছে গিয়ে দেখি উনি আমাদের চার জনের জন্য আলু ভর্তা ভাত আর ডিম ভাজি করছেন – আমাকে দেখেই বললেন বাকি সেই নয়নদের টিমের সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে খেতে আমাদের আপত্তি আছে কিনা। আহ সাথে সাথে সব্বাইকে ডেকে জীবন দার ডাইনিং এ জম্পেশ পুরো ডাইনিং গম গম আর হাউকাউ করে ভাত-ডাল-আলুভরতা-ঘি দিয়ে ডিনার শেষ করলাম। আমি যদিও কিছুটা ডায়েটীং এ ছিলাম তাও গরম গরম ঘি হাতের সামনে পেলে ছাড়ি কি করে, ঘি আর আলু ভর্তা মেখে মনেনেই কয় প্লেট খেয়েছিলাম, অবশ্য আমাদের সবারই খুব খিদে পেয়েছিল। জীবন’দার প্রতি আমরা সবাই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে ঘুমুতে গেলাম।
যাত্রা শুরুঃ-
খুব ভোরে উঠে আমার রেডিহয়ে আমাদের হোটেলের ঠিক উল্টা দিকে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে রুটি – আলুর দম আর ডিম দিয়ে নাস্তা করে নিলাম।
দ্বিতীয়বার ট্রেকিং এর অভিজ্ঞতা থেকে বলছি পাঠককে যে অবশ্যই মানেভাঞ্জান থেকে ভরপেট নাস্তা করে যাবেন কারন এর পরে আর কোথাও রেডিমেইড নাস্তা পাবেন নাহ, আর কিছু খেতে গেলে রান্না করার সময় পর্যন্ত আপনাকে বসে থাকতে হবে যা শ্রেফ সময়ের অপচয়।
খেয়ে দেয়ে চিত্রের দিকে হাটা শুরু করলাম, চিত্রের দিকে যে রাস্তাটা উঠেগিয়েছে সেখানে একটি তিন রাস্তার মোড় রয়েছে – একটি মানেভাঞ্জানের দিকে – একটি চিত্রের দিকে আর একটি রামাম থেকে গুরদুম হয়ে মানেভাঞ্জানের সাথে এসে মিশেছে। এই মোড়েই রয়েছে সিঙ্গারিলা পার্কের চেকপোস্ট এবং এখান থেকেই টিকেট কিনে নিতে হয়।
গতবার আমরা যে গাইড কে নিয়ে গিয়েছিলাম সেই ‘নিমাহ’ এইবার অন্য গ্রুপের সাথে ট্যুর দিচ্ছে তাই গাইড এসোসিয়েশান আমাদের একটি ভাঙ্গাকুলা টাইপের গাইড দিল, বয়স খুব বেশি হলে ১৪ অথবা ১৬, সাথে কোন মোবাইল নেই ঘড়িও নেই। আমি অবশ্য এটায় বিচলিত হইনি কারন রাস্তা যেহেতু চিনিই তাই নিয়ম রক্ষার জন্য এই গাইড নেয়া।
বাকি সব গাইড নাকি সেই ম্যারাথন প্রতিযোগিতার রিজারভেশানে আছে তাদের সাথে। গাইড এসসিয়েশানের লোকটা আমাকে প্রথম দেখেই চিনে ফেলল, যার ফলে গাইড প্রতি ৫০০ রুপি প্রতিদিনের টাকাটা জোর করে ৪০০ তে নামিয়ে আনলাম, অবশ্য আর একটু জোরাজোরি করলে ৩৫০ এই নেয়া যেত কিন্ত নিজেকে আর তৈলাক্ত করতে মন চাচ্ছিলনা তদুপরি সকালের রোদ ও উঠেগিয়েছে যেতে হবে তারাতারি।
মানেভাঞ্জান থেকে চিত্রে যেতে যেই রাস্তা সেটির সাথে আবার আরএকটি রাস্তা নিচে দিয়ে এসে মিশেছে গুরদুম থেকে রিম্বিক হয়ে আরএকটি আমরা যেদিক দিয়ে আসলাম শুকিয়াপোখারি থেকে, অনেকটা Y জংশান টাইপের, আর এই জংশানের কোনায় আছে সিঙ্গারিলা চেকপোস্ট যেখান থেকে টিকিট কেটে নিতে হয়।
সিঙ্গারিলা পার্কের টিকিট কাটতে গাইড বুদ্ধা রায় কে পাঠালাম, কিন্ত সে যাবার পরে ভিতর থেকে দেখি আমাদের ডাকছে, একটি লগে নাম দেশ লিখতে গিয়ে দেশটা যখন বাংলাদেশ লিখলাম তখন কাউন্টারের লোকটা আর একটি লগ বের করে দিল, বলল এটা আন্তর্জাতিক ট্যুরিস্টদের জন্য। দেশি ট্যুরিস্টদের জন্য প্রতি জন ১০০ রুপি আর ক্যামেরা ৫০ রুপি আর বিদেশিদের জন্য দিগুন – আমি চাইছিলাম ৪x১০০ + ৩x৫০ টাকা বাঁচাতে কিন্ত লগ বুকে নিজের দেশের নাম কোনভাবেই ইন্ডিয়া লিখতে পারলাম নাহ – দুই সেকেন্ড ইতস্থত করে জোর করে লিখতে চাইলাম কিন্ত আমার তিন-আঙ্গুলের মাথা সেই বাংলাদেশ ই লিখল।
টিকেট নিয়ে যখন বের হয়ে আসি তখন নিজের ভিতরে একটি অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করছিল, না আমি টাকা দিয়ে দেশ প্রেম দেখাইনি – আমার নিজের ভিতরে যে একটি স্বত্বা রয়েছে যা সব সময়ই সঠিক কাজটি করতে আমাকে বাধ্য করে এমনকি আমার মস্তিষ্কের নির্দেশ অমান্য করে হলেও, এই বিষয়টা আমার ভিতরে একটি চরম আনন্দের একটি অনুভুতি এনে দিল
চিত্রেঃ-
সান্দাকফু ট্যুরের সবচেয়ে নয়নাভিরাম রাস্তা হচ্ছে মানেভাঞ্জান থেকে চিত্রে যাবার রাস্তা, আমার মাঝে মাঝে মনেহয় যে আমি যেন হলিউডের কোন মুভির সেটের ভিতর দিয়ে হাঁটছি। জায়গাটা এত বেশি সুন্দর যে ভাষা অথবা ছবি কিছু দিয়েই এর বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। ঘন পাইন বনের ভিতর দিয়ে এঁকে বেঁকে উঠেগিয়েছে পিচে ঢালা পথ। উপরে উঠতে উঠেতে হঠাৎ ইরাজ ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন উত্তরে পিছনে যেই বরফওয়ালা পর্বতটা দেখা যাচ্ছে সেটিই কাঞ্চনঝঙ্গা কিনা! আমি দেখে পুরাই টাশকি! কারন মার্চের ট্যুরে একমাত্র সান্দাকফু থেকেই কাঞ্চন দেখেছিলাম তাই বিস্ময় আর হতবিহব্বল হয়ে শ্রেফ বোবা হয়ে গেলাম। শেষে যুক্তি বুদ্ধি আর দৃষ্টির বাস্তবতা কে মেনে নিয়েই বললাম হ্যা এটাই সেই কাঞ্চনঝঙ্গা, সত্যি আমি রাস্তার সেই কোনায় স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে দেখছি কাঞ্চনঝঙ্গা কে।
আমার ট্যুর পার্টনাররা দেখি আমাকে রেখে অনেক উপরে উঠেগিয়েছে আর চিত্রে পর্যন্ত যাওয়া ত দূরে থাক, চিত্রে উঠার রাস্তা থেকেই কাঞ্চন দেখা যাচ্ছে এটা তাদের মোটেই বিচলিত করছে না কারন এরা ত প্রথম এলো তাই হয়ত মনে করছে এইটাই স্বাভাবিক! আর আমি চিন্তা করছি মার্চে আমি আর রুবেল ভাই কিছু কিছু রাস্তায় কাঞ্চন দেখব ত দুরের কথা ১০ফিট দুরের কিছুই দেখতে পারছিলাম না কুয়াশার জন্য।
@চিত্রে যাবার পথে
@চিত্রে বৌদ্ধ মনেস্ট্রি
অবশেষে চিত্রে এসে পৌছুলাম – পিচ্চি গাইডটা দেখি সোজা ওদের কটেজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ... আমি ডেকে থামালাম বললাম এই বৌদ্ধ মনেস্ট্রিটাতে দেখার অনেক কিছু আছে, আসলে আমি মনেস্ট্রির বাগানের ফ্রেঞ্চ মেরিগোল্ড আর কসমস ফুলের ছবি তোলার উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। পুরা মনেস্ট্রি চক্কর দিয়ে সেই দোলমা দিদির লজে গিয়ে উঠলাম। মজার বিষয় হচ্ছে এই লজেই আমাদের যাদের সাথে দেখা হয় তাদের সাথেই ট্যুর শেষ হয় ... গতবার তাই হয়েছিল, যে জানত এবার ও তাই হবে।
লজের ভিতরে কফি নিয়ে একটা পোজ দিয়ে বারান্দার কাচের জানালার আধা আলো আধা ছায়ার ইফেক্টে ছবি তোলা শুরু করলাম।
গতবার রুবেল ভাই আমারটা তুলে দিয়েছিল এবার মনে নেই কাকে বলেছিলাম হয়ত শুভ ভাইই তুলে দিয়েছিলেন অথবা ইরাজ ভাই। কফি শেষ করে দোলমা দিদি কে ডেকে একটা গ্রুপ ছবি তুললাম। লজের বারান্দায় গিয়ে দেখলাম এক ফ্রেঞ্চ ট্রেকার পৌঁছুল, মহিলা বার বার জিজ্ঞেস করছে চা পাওয়া যাবে কিনা, আমি একটু আগ বাড়িয়ে বললাম এখানে ইয়াক এর মিল্কের সাথে পাঙ্খা কফি বানায় – প্রত্যুতরে সে বলল কফি কোনটা কারন নেসকফি হলে উনি খাবেন নাহ। এই একটা জিনিস কমন দেখলাম – ইউরোপিয়ানরা কেন জানি নেসকফি দেখতেই পারে নাহ। যাই হোক চিত্রে ছেড়ে আমরা লামেধুরার দিকে যাত্রা শুরু করলাম।
লামেধুরাঃ-
প্রথমবার যখন এই রাস্তায় যাই অর্থাৎ চিত্রে থেকে লামেধুরা তখন আমার যে সমস্যা হয়েছিল তা লিখেছি প্রথম অভিজ্ঞতার পোস্টে, কিন্ত এইবারও যে নিস্তার নেই তা যদি জানতাম! এখানে আমি ছাড়া আর বাকি তিনজনের ব্যাপারে একটু না বললেই নয়। এদের তিনজনের ভিতরে একজনের তিনবার কেউক্রাডং উঠার অভিজ্ঞতা আছে আর একজনের বগালেক পর্যন্ত আর বাকি একজনের জিবনের প্রথম ট্রেকিং তাও আবার সান্দাকফু! আমার প্রতিটি ট্যুরেই এমন হয়, যাকে মনেকরি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং একটু নির্ভর করা যায় সে ই সবার আগে পল্টি খায় এবং এবার ও ব্যাতিক্রম হয়নি। চিত্রে থেকে একটু উপরে উঠে আমি থেমে কাঞ্চনঝঙ্গার ছবি তুলতে তুলতে টাইয়ারড তখন খেয়াল করলাম আমার পিছে কেউ নেই, আর আমার সাধারন অনুমানে এদের এতক্ষনে চলে আসার কথা যত আস্তেই আসুক। পরিস্থিতি বুঝে ব্যাক-ট্রেইল করার জন্য পা বাড়াতেই দেখি মিঃ কেউক্রাডং ইহাই জিবনের শেষ যাত্রা বডি ল্যাঙ্গুয়েজে ধিরে ধিরে উঠে আসছে। কাছে আসার পরে জিজ্ঞেস করলাম ঘটনা কি, বলে পাহাড়ে উঠলে নাকি তার মাথা ঘুরে।
ভাল কথা, এধরনের পরিস্থিতির কথা প্ল্যানেই রেখেছিলাম, তাই বুদ্ধা কে বললাম ওর ব্যাগটা নিতে আর ট্রাইপডটা দিয়ে দিতে। ওমা পীঠ থেকে ব্যাগ সরে যেতেই সে দেখি ফটাফট ছবি তোলা শুরু করল। মনে মনে ভাবলাম যাক সিভিয়ার কিছু না।
@মেঘমা যাবার পথে
আমি আমার প্রথম অভিজ্ঞতার পোস্টে লিখেছিলাম যে আমার ট্রেকিং এর হাতে খড়ি আনোয়ার ভাই এর হাতে এবং তিনি যেভাবে হাত ধরে পাশে পাশে হেটে উচু পাহাড়ে উঠা শিখিয়েছেন তা আমার রক্তে মিছে গিয়েছে অর্থাৎ এখন আর মনে করে হাটার স্ট্রেটেজি চেঞ্জ করতে হয় না, আমার দেহে এটি অটম্যাটিক চলে এসেছে যে উপরে উঠার সময় একভাবে, নামার সময় এক আর সমতলে একরকম হাটা এবং আনোয়ার ভাই এর একটা কথা বড় কানে বাজে – উনি বলেছিলেন একজন ট্রেকারের পক্ষে সবচাইতে কষ্টকর আর কঠিন কাজ হচ্ছে টিমের কারো জন্য বাধ্য হয়ে তার স্বাভাবিক হাটার গতি কমিয়ে থেমে থেমে হাটা। হ্যা আমিই আনোয়ার কে সেই পেইন ইন দ্যা **** দিয়েছি আর তার প্রতিদান ‘কারমা’ এসে পরেছে আমার ঘাড়ে।
পিঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে দেয়ার পরেও দেখি মিঃএক্স লামেধুরার রাস্তায় খাবি খাচ্ছে উঠতে গিয়ে, আমার পূর্বের পোস্টে পরে থাকবেন যে প্রথমবার এখানে আমার ও একই অবস্থা হয়েছিল এবং আনোয়ার ভাই এর ট্রেইনিং এ সফলভাবেই কোনরকম সাহায্য ছাড়াই রিকভার করতে পেরেছিলাম। তাই মিঃএক্স কে ট্রেইনিং দেয়া শুরু করলাম – পাশা পাশি হেটে উঠার সময় কিভাবে উঠতে হবে কিভাবে কতটুকু দূরত্বে পা ফেলতে হবে কিভাবে দম নিতে হবে এর সাথে তার ফোকাস আর চিন্তা অন্য দিকে ডাইভারট করে মোটিভেশান ইত্যাদি সব করে যাচ্ছি আর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমি আনোয়ারকে কি পরিমান পেইন দিয়েছিলাম আর আজ নিজেকে কে মিঃএক্স এর জায়গায় কল্পনা করছি।
কিছুক্ষন এভাবে চলার পর আমি নিজেই নিজের উপরে এত বিরক্ত হয়ে গেলাম যে তা আর ভাষায় প্রকাশ করার কোন উপায় নেই। তার পরেও চিন্তা করলাম আজ যদি আমি ট্যুর না করে ব্যাবসা করতাম তাহলে এই পেইনটা সহ্য হয়ে যেত, আমার ও ত মন চায় একটু উঠে ছবি তুলতে একটু স্বাভাবিক ভাবে হাটি। জানি না কিভাবে পারলাম আমি একটা লোকের সাথে জোঁকের মত আঠা লেগে লেফট-রাইট করতে করতে চুরান্ত ধীর গতিতে হাটা আর দাঁত কামড়ে নিজেকে সংবরন করে অভিব্যক্তি লুকিয়ে মিঃএক্স এর সাথে ট্রেকিং করতে থাকা।
এই পেইন থেকে নিজেকে উদ্ধার করার মানসিক উপায় খুজতে থাকলাম, কয়েকটা এসেও গেল মনে
১. এর পর থেকে ইকুয়েল-শেয়ারড ট্যুর আর করব না
২. মিঃএক্স আমার ছোট ভাই – ভাই কখনও ভাই কে রেখে যেতে পারে না, আমি ওর বড় ভাই তাই শাসন করে ধাপকি দিয়ে টেনে ধরে হলেও ওকে সান্দাকফু উঠাব
...
কেন জানি দ্বিতীয় অপশানটাই পছন্দ হল। দুজন লেফট-রাইট করতে করতে লামেধুরা এসে পৌঁছুলাম, বাকি দুজন আর বুদ্ধা অবশ্য অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছে।
মেঘমা + তুমলিং + গাইরিবাস
কোনপ্রকার ঝামেলা ছাড়াই আমারা লামেধুরা থেকে মেঘমা পৌছুলাম, অবশ্যই মিঃএক্স এর সাথে লেফট-রাইট করতে করতে। মনেপড়ে গত মার্চে এখানে কুয়াশার জন্য ১০ ফিট দুরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না, কিন্ত এখন তংলু’র মাথা’র উপরে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। যদিও লাঞ্চ করিনি এখনও তবুও ক্ষুধা ছিল খুব কম, কেমন মনে ক্ষুধার জন্য এখানে ন্যুডুলস আর স্যুপ খেলাম।
সময় নষ্ট না করে তারাতারি রওনা দিয়ে দিলাম কারন দিন ছোট। মনে চাচ্ছিল তংলুর রাস্তা দিয়ে উপরে উঠে যাই, কিন্ত টীমের দুজনের পা’এর অবস্থা চিন্তা করে ইচ্ছেটার গলা টিপে দিলাম। হাতের বাম দিক দিয়ে তুমলিং এর দিকে রওনা দিলেও আমার মন হাতের ডান দিক দিয়ে তংলুর দিকে উঠে যাচ্ছিল, তংলুর রাস্তাটা খুব সুন্দর একে বেকে উপরের দিকে উঠে যাওয়া।
মেঘমা থেকে নিরবিঘ্নে তুমলিং পর্যন্ত এলাম, এখানে শিখর লজের বাইরে পাতা একটি বেঞ্চে বসে কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে আবার গাইরিবাসের দিকে যাত্রা। এখানে সেই ফ্রেঞ্চ মহিলা কে দেখলাম, শিখর লজে উনি হল্ট করেছেন আর চুটিয়ে বিকালে রোদ উপভোগ করছেন।
তুমলিং ছেড়ে কিছুদুর যাবার পর আবার সেই কাঞ্চন দেখে দেখে থেমে থেমে ছবি তুলে হেটে যাওয়া। বিকালের রোদটা খুবই মিষ্টি লাগছিল কিন্ত আশংকা করছিলাম দিনের আলোতে হয়ত গাইরিবাস পৌছুতে পারব না। গাইরিবাসের ঠিক আগে একটি টাওয়ার ওলা সেটেল্মেন্ট আছে – নাম টা ঠিক মনে নেই, এখানে মার্চে যখন এসেছিলাম তখন ছিল ঘন কুয়াশা, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না আর আজ দেখলাম আশে পাশের কত কিছু, পুরো উপত্যকাটাই রসিয়ে রসিয়ে দেখলাম। এখানে একটু জিরিয়ে নিতে গিয়েই দেখলাম সূর্য ডুবে গিয়ে লালিমা ছড়াচ্ছে। পাশের একটি লজের ওয়াশরুম ব্যাবহার করতে গিয়ে দেখলাম ডানে বামে সারি সারি রুম আর কম্বল লেপ মোড়ানো রোল করে রাখা বিছানার উপরে যেন আমাকে ডাকছে আয় আয় আয় ... আমি তড়িঘড়ি কাজ সেরে সবাইকে তাড়া দিলাম যাবার জন্য।
এদিকে মিঃএক্স ওয়াশরুমে হানা দিল – আমি ত মনে মনে হায় হায় যদি এই ছেলে সেই বিছানা গুলো দেখে তাহলে নির্ঘাত আর যেতে চাইবে না, এখানেই রাতে থেকে যেতে চাইবে। পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রনে নেবার জন্য বাকি তিন জনকে গাইরিবাসের দিকে নামিয়ে দিলাম, আমি আর বুদ্ধা দাঁড়িয়ে রইলাম ওর জন্য। লজ থেকে বের হবার পরে দেখি তার কোন প্রতিক্রিয়াই নেই ... যাক বাঁচলাম বেচারা প্রাকৃতিক চাপে আশে পাশের কিছুই দেখেনি।
@সেই ট্রান্সিলভিনিয়ার মত - সূর্য ডুবে যাচ্ছে কিন্ত তারাতারি যেতে হবে
সন্ধ্যায় গাইরিবাস নামার দুটো চ্যালেঞ্জ ছিল – এক অন্ধকার যদিও টর্চ ছিল আর দুই এই রাস্তার পাথর গুলো সব ছড়ানো ছিটানো এবং পাড়া দিলেই গড়াগড়ি খায় যেটা পা মচকে যাবার জন্য যথেষ্ট আর এই জায়গায় পা মচকে যাওয়া মানে না ঘরকা না ঘটকা সিচুয়েশান।
বিপদ থাকা সত্তেও আমি এই নতুন দের নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে গাইরিবাস যাচ্ছিলাম দুটো কারনে – এক যদি এখন আজ গাইরিবাস না পৌছাই তাহলে আমরা সান্দাকফুর সূর্যাস্ত মিস করব কারন নতুনদের জন্য বিখেভাঞ্জান খুবই কষ্টদায়ক হবে এবং হয়েছিল আর দ্বিতীয় কারন হচ্ছে আমাকে যেমন আমার ট্রেকিং গুরু স্ট্যামিনার শেষে মানসিক শক্তির শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেত ঠিক সেই আচরন টাও আমার ভিতরে চলে এসেছে অর্থাৎ যতক্ষন পা এর উপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারা যায় ততক্ষন ট্রেকিং।
মজার বিষয় হচ্ছে যে মিঃএক্স এতক্ষন হাটতে খাবি খাচ্ছিল সেই মিঃএক্স এখন ধুপ ধাপ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে আলগা পাথর গুলো সাবধানে এড়িয়ে, কিছুক্ষন পরে ত আমাকেই অভারটেইক করে নেমে গেল ... আমি ত হতবাক যেই লোক দিনে দুপুরে সমতলে ট্রেকিং করতে খাবি খায় সেই কিনা অন্ধকারে ঝাপসা আলোতে এভাবে নেমে যাচ্ছে ! আসলেই মানুষের এবিলিটি সম্পরকে মানুষ নিজেই অবগত নয় যদি সে সেইরকম অবস্থায় না পরে।
আমি মনে করে ছিলাম ভরা পুরনিমায় চাদের আলোতে ট্রেকিং করব কিন্ত প্ল্যানে একটু ভুল ছিল, চাঁদ উঠে পুব দিক থেকে আর আমরা যাচ্ছি পশ্চিমে এবং একটি পর্বতের ঢাল বেয়ে পর্বতটাকে ডান দিকে রেখে। যার কারনে একটু পরে দেখলাম অনামিশা জোছনায় পুরা উপত্যকা ভেসে যাচ্ছে কিন্ত আমরাই একমাত্র অন্ধকারে কারন আমরা আছি পর্বতের চুড়ার ঢালে চাদের ছায়াতে।
যাইহোক কোনমতে পা হড়কে আছাড় খেয়ে অনেক কষ্টে গাইরিবাস পৌছুলাম, লজে ঢুকে দেখি সবাই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, মানে আমিই সবার শেষে পৌঁছেছি।
@খুব ভোরে গাইরিবাস লজের পাশের থেকে তোলা - ভোরের চাঁদ
কালাপোখারিঃ
গাইরিবাস থেকে সকালে যথারিতি নাস্তা না করে সময়ের অপচয় না করে কাইয়াকাঠা’র দিকে রওনা দিলাম।
পথে মিঃএক্স ছাড়া আরেকজনের পায়ে ব্যাথা শুরু হল, বুদ্ধা এমনিতেই মিঃএক্স এর ব্যাকপ্যাক ক্যারি করছে ... পরিস্থিতি বুঝে শুভ ভাই ইরাজ ভাই এর ব্যাকপ্যাক নিয়ে নিলেন – নিজের টা পিছনে ইরাজেরটা সামনে – সত্যি এভাবে সেচ্ছায় ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ায় আমার খুব ভাল লাগছিল কারন এরা একদম নতুন ট্রেকার কিন্ত পরিস্থিতি এদের সঠিক কাজটি করাতেই শিখিয়েছে।
কাইয়াকাঠা থেকে নাস্তা করে কালাপোখারির দিকে যাবার রাস্তাটা প্রায় সমতলই বলা চলে তাই ঝামেলা কম হাটা জোরে। কালাপোখারি এসে শুধু একটু চা খেয়ে আবার বিখের দিকে রওনা দিলাম। টিম ট্রেকিং এ সাধারনত যে ধিরে হাটে তাকে আগে পাঠানো হয় যাতে সে পিছেনা পড়ে আর পিছনের দাবড়ি খেয়ে আগে আগে চলে। কালাপোখারি থেকে বুদ্ধাকে সাথে দিয়ে মিঃএক্স কে আগে পাঠিয়ে দিলাম।
আমরা বাকিরা বিখেভাঞ্জান এসে দেখি সাদা শার্ট পরা মিঃএক্স তখন সান্দাকফুর দিকে উঠে যাচ্ছে অনেক উপরে। আমরাও ধীরে ধিরে উঠা শুরু করলাম।
@কালাপোখারি
@কালাপোখারি থেকে দেখা যাচ্ছে সান্দাকফু
সান্দাকফুঃ-
বিখে থেকে সান্দাকফু উঠার আর বিশেষ কিছু বলার নেই শুধু এইটুকুই বলব যে মার্চে সান্দাকফু না দেখে শুধু রাস্তা দেখে দেখে উঠেছি আর এবার সান্দাকফুর সেই নিল রঙের লজটা দেখে দেখে উঠছি। কিছুক্ষন পর পর অবশ্য মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছিল আমাদের। উঠার আর বিশেষ কোন বর্ণনা নেই ... ঠিক নেই তা না কিন্ত প্রথম বার আমার যেমন কষ্ট হয়েছিল এবার নতুনদের ও হচ্ছে এই যা।
@এই সেই বিখেভাঞ্জান - মার্চে যার ৫ফিট দুরের জিনিস দেখতে পারিনি কুয়াশায়
সান্দাকফুর চুড়ায় পৌঁছে দেখলাম ঠিক মার্চে যেই লজে উঠেছিলাম সরকারি সি ক্যাটাগরির ঠিক সেই লজটিতেই বুদ্ধা নিয়ে গেল, আমি অবশ্য চেয়েছিলাম অন্য একটা লজে উঠতে এবার কিন্ত সবার লাগেজ অলরেডি ভিতরে তাই কি আর করা ঢুকে গেলাম সেই চেনা কিচেনে আর কেয়ারটেইকার কে হিন্দি-ইংরেজিতে মনে করিয়ে দিলাম আমাকে চিনে কিনা – অবাক করে দিয়ে লোকটা বলল হ্যা আপনি নিমার সাথে এসেছিলেন আর তার বউটা বলল আপনি না আমাদের ছবি তুলেছিলেন সেই ছবি কৈ? ব্যাপক লজ্জায় পরে গেলাম এই অই বলে কাটিয়ে তাদের সাথে চুটিয়ে ‘মম’ খেতে খেতে আড্ডায় মশগুল হয়ে গেলাম।
একটুপরে আমরা সান্দাকফুর কোনায় উঠে শাটা শাট স্ন্যাপ নেয়া শুরু করলাম কাঞ্চন আর এভারেস্টের লালিমার। এখানে একটি মজার বিষয় না বললেই নয়, যেই ফ্রেঞ্চ মহিলা কে চিত্রে তে দেখেছিলাম পরে লামেধুরা তাকে আমরা পেয়েছি আবার মেঘমাতে সেখানে অবশ্য তার সাথে কিছু বাত চিত করে নাম কেন আসা ইত্যাদি জেনে নিয়েছিলাম, তাকে আমরা তুমলিং এর শিখর লজে ফেলে এসে ছিলাম । । মানে উনি হল্ট করে ছিলেন তুমলিং এ আর আমরা গাইরিবাস এ।
এর পরে তাকে আমরা আমাদের ক্রস করতে দেখিনি কিন্ত বিকেলের শেষ লালিমায় ছবি তোলার সময় দেখি সে এসে হাজির। ট্রেকিং এ পরিচয়ে কুশল বিনিময়ের এক অদ্ভুত আনন্দ আছে সেটা যারা গিয়েছেন তারা জানেন। ইজরায়েলি একটি টিমের সাথে সে এসেছে এবগ্ন একজন কে ত দেখলাম পাথরের উচু এক ঢিবিতে বসে এক মেয়ে অস্তগামি সূর্যের দিএক চেয়ে মেডিটেশানে ব্যাস্ত। বলা বাহুল্য সান্দাকফু তে পারা দিয়েই রামাকান্ত দা’র সাথে পরিচয়, মানে বামে মোড় টা ঘুরেই দেখি উনি দাড়িয়ে – সবার আগে উনার সাথেই করমর্দন করেছি এবং পরিচিত হলাম – উনি বললেন এখানে সবাই জানে যে বাংলাদেশ থেকে নাকি ৪জনের এক টীম আসছে (মনে মনে জীবন’দা কে ধন্যবাদ দিলাম)। সেই সুন্দর বিকেলটা কাটালাম রামাকান্ত’দার টিম আর বিদেশি আরো কিছু ট্রেকারস দের সাথে।
মজার বিষয় হচ্ছে মার্চে যেখানে দারিয়েই থাকতে পারছিলাম না সেখানে এখন ছবি তুলছি খালি হাতে আর সানন্দে আড্ডাও দিচ্ছি – সময়টা সত্যি সত্যি ভালো কেটেছিল। সূর্য ডুবে যাওয়ায় পুরো আকাশটা লাল হয়ে কি এক অদ্ভুত অনুভুতি এসে দিচ্ছিল যা ভাষায় প্রকাশ করার কাব্যিক মহিমা আমার থাকলে একটি কাব্য লিখে ফেলতাম।
সন্ধায় আবার কিচেনে হানা দিলাম, অবশ্য কিচেনে যাবার আগে রুমেও একটা ঢু মেরেছিলাম; গিয়ে দেখি মিঃএক্স বিছানায় শীতের বুড়ী ক্রিমরোল হয়ে শুয়ে আছে আর গোঙ্গাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম এর সাথে একজন কে দিয়ে কাল গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দেব বাংলাদেশে চলে যাবে আর আমি আর একজন কে নিয়ে ফালুট ঘুরে আসব। আমার মনের কথা যেন সে পড়ে নিল এবং বলে উঠল ভাই – আমাকে কাল গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দিন।
কিচেনে এসে গাড়ি রিজারভ করলাম আর আগুন তাপাতে তাপাতে আড্ডা দেয়া শুরু করলাম সাথে আদা চা।
হঠাৎ শুভ ভাই এসে বললেন যে যে কারনে ট্রাইপড তা ক্যারি করেছি সেটার সদব্যাবহার করতে, অর্থাৎ রাতে সান্দাকফু থেকে কাঞ্চনের ছবি তুলতে। ট্রাইপড আর ক্যামেরা নিয়ে বের হয়ে পরলাম, ঠিক যেখান থেকে ছবি তোলার প্ল্যান করছি ঠিক সেখানেই দেখি রামাকান্ত দা রা দাঁড়িয়ে আছে । এখানে বলে রাখা ভাল যে ট্রাইপড সেই মার্চেও নিয়ে ছিলাম কিন্ত তখন বিকেলেই যেখানে কাঞ্চন দেখতে পারিনি সেখানে রাতে দেখা অবান্তর ... প্ল্যান করেছিলাম এবারও সুযোগ নিব এবং সৌভাগ্য যে চিত্রে থেকেই কাঞ্চন দেখা যাচ্ছিল আর সান্দাকফুতে ত রাতেও খালি চোখে দেখা যাচ্ছে কারন আকাশ ভরা জোছনা। জায়গা মত ট্রাইপড সেট করে ম্যানুয়াল ফোকাস এডজাস্ট শুরু করলাম কিন্ত ঠাণ্ডায় সব কিছু জমে যাচ্ছিল – গ্লাভস থেকে হাত ই বের করা যাচ্ছিল না, কয়েকটা স্ন্যাপ নেবার পরে ঠাণ্ডায় হাল ছেড়ে দিচ্ছি এমন সময় রামাকন্ত দা আসলেন ।
। আমাকে ইন্সপাইয়ারড করলেন আর সাথে কেউ থাকলে সাহস একটু বেড়ে যায় বইকি। আবার ছবি তোলা শুরু করলাম। যেহেতু ম্যানুয়াল ফোকাস তাই পুরা আন্দাজের উপরে ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে ফোকাস একবার একদিকে ঘুরিয়ে একটা ছবি তুলে প্রিভিউ দেখি আবার ফোকাস আর এক দিকে একটু ঘুরিয়ে আর একটা তুলে প্রিভিউ দেখি এভাবে আন্দাজের উপরে প্রিভিউ দেখতে দেখতে ২৩ নাম্বার ছবিটা তে শার্পনেস পেলাম।
ততক্ষনে আমাদের হাত পা সব বরফ হএয় গিয়েছে, কিন্ত ছবি পাওয়ার আনন্দে সবাই দেখি বিড়ি টানা শুরু করেছে।
যদিও ছবিটা আমার ক্যামেরায় তোলা কিন্ত সেই ২৪নাম্বার ছবিটার আনন্দ সেখানে সবাই হাউকাউ করে উপভোগ করলাম। সত্যি সেই ছবিটাতে শাটার একজনই চেপেছে কিন্ত এতে উপস্থিত সবার হাত ছিল এবং এটাই ছিল আমার জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কারন একটি স্বপ্নের যখন পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হয় নিজের চোখের সামনে তখন তার অনুভুতি সত্যিই আসাধারন।
ছবি তুলে লজের দিকে হেটে যেতে যেতে রামাকান্ত দা তাদের কটেজে ইনভাইট করল, ওখানে গিয়ে রামাকান্ত দার মোবাইল ইমেইল নিয়ে আর এক দফা চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে নিজের লজে এসে দেখি দরজা বন্ধ। আজ যদি আমি নতুন কেউ হতাম তাহলে চিৎকার শুরু করতাম কারন এই ঠাণ্ডায় যেখানে প্যান্ট গ্লাভস ভেদ করে ঠান্ডা শত সহস্র সুই দিয়ে চিমটি কাটছে সেখানে খোলা যায়গায় কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকা আত্মহত্যার সামিল। গত মার্চে আসার অভিজ্ঞতা কাজে দ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।