জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার তিন দফা দেখা হয়েছে। তবে কোনোটিই আনুষ্ঠানিক আলোচনা নয়। ২৩ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ড অব অ্যাস্টোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্টলেডি বিশ্ব নেতাদের সম্মানে যে ডিনার দিয়েছিলেন তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন সপরিবারে। ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এরই মধ্যে সেই ডিনারে প্রেসিডেন্ট ওবামা ও ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামার আতিথেয়তায় মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন ফেসবুক স্ট্যাটাসে। যা নিয়ে খবরও প্রকাশিত হয়েছে।
তবে জয়কে নিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কী ভাবলেন তা জানা গেলো পরের দিন।
মঙ্গলবার সকালে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের উন্নয়ন বির্তক শুরুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। নর্থ লন বিল্ডিংয়ে সাধারণ অধিবেশনের যে অস্থায়ী কক্ষ এবার সাজানো হয়েছে তাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসনটির ঠিক সামনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আসন। সাধারণ অধিবেশন কক্ষেই দেখা হয়ে গেলো দুই নেতার। প্রথম সুযোগেই প্রেসিডেন্ট ওবামা শেখ হাসিনাকে বললেন, ‘ইওর সান ইজ ভেরি স্মার্ট এন্ড ইনটেলিজেন্ট।
’ কেন সে কথাটি বারাক ওবামা বললেন তা জানতে চাননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর ওবামাও বিস্তারিত বলেননি। দুজনই স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসলেন। (ভোরের কাগজ- ২৬/৯/০১৩)।
বিশ্ব ক্ষমতাধর এক নরপতি আমাদের এক তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে প্রশংসা করেছেন বলে আমরা আহ্লাদে আটখান হয়ে যাবো, এমন দুর্মতিতে যেন আমাদের পেয়ে না বসে।
বরং শেরে বাংলার কথাটি মনে রাখা দরকার সব সময়, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা আমার প্রশংসা করলে চিন্তিত হয়ে পড়ি নিশ্চয়ই কোথাও ভুল করেছি, আর সমালোচনা করলে নিশ্চিত হই যে আমি ভুল করিনি। ’ যে দেশটি সর্বদা বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসি এবং যারা জামাত-হেফাজতকেও ‘মডারেট’ বলতে পারে, জামাতের সঙ্গে আলাপে বসার পরামর্শ দিতে পারে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জিএসপি বন্ধ করে দিতে পারে, মানি লন্ডারিংয়ের নায়কের সঙ্গেও গোপন পরামর্শে বসতে পারে, তাদের প্রশংসা হিসেবে না ধরারই পরামর্শ দেবো। কিছুদিন আগে বরং জনপ্রিয় কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দৈনিক জনকণ্ঠে জয়ের ওপর যে গুরুত্বপুর্ণ কলামটি লিখেছেন, আমরা ওই লেখারই গুরুত্ব দেবো বেশি। এখনো পর্যন্ত জয় ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে দূরে আছেন, এখনো তিনি আওয়ামী লীগের অকালপক্ব কর্ণধার হবার চেষ্টা করেননি, দলের সিনিয়র নেতাদের বিরক্তিভাজন হননি, ‘সিনিয়র’, ‘যুগ্ম’, ‘মহা’ জাতীয় কোনো পদে তিনি অভিষিক্ত হননি, এ ব্যাপারটি মানুষের দৃষ্টিগোচর না হয়ে পারেনি। পুঁথিগত বিদ্যাকে বড় করে দেখতে চাই না, দেখতে চাই কালচার।
আমাদের একজন মনীষী-লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘মানুষের লক্ষ্য ও উপায় এক নয়, শিক্ষা হচ্ছে উপায় আর কালচার হচ্ছে লক্ষ্য। ’ যে ব্যক্তি এক বোঝা বিদ্যা মাথায় নিয়ে, কাঁধে ডক্টরেট ঝুলিয়ে ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা আর হীনমন্যতায় ভোগে তার বিদ্যার কী মূল্য আছে?
জয় এখনো যে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে দূরে আছেন এবং একই সঙ্গে দলের সহযোগিতার দৃষ্টিতে ইতোমধ্যে যে সব বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তাতে সত্যি সত্যি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার তারিফের সত্যতা ধরা পড়েছে। তার বক্তৃতার মধ্যে স্মার্টনেস ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা তার বক্তৃতায় প্রকাশ পেয়েছে। স্বভাবতই তিনি তার দলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কথা বলবেন এবং বলেছেনও, পাশাপাশি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপির নেতিবাচক দিকটি তুলে ধরবেন এটাও স্বাভাবিক, তা ধরেছেনও ।
এর মধ্যেও ধরা পড়েছে তিনি ধীর, স্থির, অনুত্তেজিত, পরিচ্ছন্ন শব্দ চয়ন করেছেন, ডাটা ব্যবহার করেছেন, যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন এবং দলের লক্ষ-কোটি কর্মীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। হতাশার অন্ধকার পায়ে ঠেলে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে কথা বলেছেন। বিগত পাঁচ বছরে মহাজোট সরকারের উন্নয়নের তথ্যভিত্তিক চিত্র তুলে ধরেছেন, ২০০১ সালের চারদলীয় জোট সরকারের অধঃপতনের দালিলিক চিত্র তুলে ধরেছেন। একটি কথাও অনুমান নির্ভর করে বলেননি। নিজের দল সম্পর্কে অনৈতিহাসিক তথ্য বিবর্জিত ঢালাও, গালভরা প্রশংসা করেননি।
মাপা মাপা ও প্র¯‘তিমূলক কথা বলেছেন। তাতেও আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল, দৃঢ়প্রত্যয় ছিল, সাবলীলতা ছিল, মুখস্থ-শুকনো পুঁথির কেতাবি বা লেফাফা-দুরস্ত কথা তা ছিল না। প্রতিদ্বন্দ্বীকে অভিযোগের ভাষাও ছিল তথ্যভিত্তিক। বলেছেন, ‘তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেননি, দিয়েছেন শুধু খাম্বা। ’ সত্য নয় কথাটা?
চারদলীয় জোটের এমপি সালাহউদ্দীনকে কেন ‘দৌড় সালাহউদ্দীন’ বলা হয়? বিদ্যুৎ নিয়ে কেলেঙ্কারি করেছেন তার পর এলাকার গণমানুষ জুতা-স্যান্ডেল-ঝাড়ু নিয়ে ধাওয়া করেছে, দৌড়ে পালিয়েছিলেন এমপি সালাহউদ্দীন।
তাই তিনি ‘দৌড় সালাহউদ্দীন। ’ মনে নেই কানসাটের কথা? সেখানে বিদ্যুৎ নিয়ে জঘন্য কেলেঙ্কারি করেছিল চারদলীয় জোটের কুশীলবরা, সেখানে বিদ্যুৎ বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন জনাব গোলাম রব্বানী। খাম্বা বিক্রির কোটি কোটি টাকা জমা হয়েছিল হাওয়া ভবনে। অবশ্য এতো কাসুন্দি জয় ঘাঁটতে যাননি, ইঙ্গিতে বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর ছবি তুলে ধরেছেন। এতেই তার রুচিবোধের পরিচয় ফুটে উঠেছে।
জয় বলেছেন তার মা, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে তারেকের হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততা আছে। ’ কথাটি আজ অস্বীকারের পর্যায়ে নেই। বিভিন্ন তদন্তে তারেক ও বাবরের নীলনকশা বের হয়ে এসেছে। এরপর তিনি বিনয়ের সঙ্গে আহ্বান জানিয়েছেন জাতিকে, ‘আওয়ামী লীগকে আবারো সুযোগ দিন। ’ কেন? তার যুক্তি হিসেবে বলেছেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের সামনে ‘রাইজিং স্টার’।
এটা স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি করেছে। এটা মাথায় রেখে আমি আপনাদের অনুরোধ করবো, মানুষকে আপনারা বলবেন অসমাপ্ত বিপ্লব আমাদের সমাপ্ত করতে হবে। এজন্য আওয়ামী লীগকে সুযোগ দিতে হবে। ’ (বর্তমান- ১৪/৯/০১৩)। তিনি বলেছেন, ‘পাঁচ বছরে দেশে মারাত্মক পরিবর্তন হয়েছে।
দুর্নীতি অর্ধেকে নেমে এসেছে। ভেবে দেখুন, আমরা কোথায় ছিলাম আর এখন কোথায় আছি। ’
একটা সাংঘাতিক কথা বলেছেন জয় যা দেশের মানুষের ভাববার মতো, ‘আওয়ামী লীগ যদি পাঁচ বছরে দেশকে এরকম এগিয়ে আনতে পারে তাহলে কল্পনা করে দেখুন, আরো পাঁচ বছরে আমরা দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারবো। ধারাবাহিকতার প্রয়োজন এজন্যই। ক্রিকেটে জয় পাচ্ছি, এভারেস্টে বিজয় হয়েছে।
আমরা চাই বাংলাদেশের মানুষ যেন বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। আগে পাঁচ বছর নানা কারণে বিশ্বের কাছে লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকতে হতো। জঙ্গিবাদ, দুর্নীতিবাজ এবং শেষমেশ স্বৈরাচার ক্ষমতায় আসে। মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর এগিয়েছে। কারণ যারা স্বাধীনতা এনেছিল তারাই দেশের উন্নয়ন করেছে।
’ (ঐ)। আমাদের দেশের রাঘব বোয়ালরা টিভি টকশোতে যেখানে উসকানিমূলক, পক্ষপাতমূলক বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন লাগামছাড়া, সেখানে অল্পবয়সী জয় সংযমের সীমায় দাঁড়িয়ে পরিসংখ্যানমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। তাই বারাক ওবামার প্রশংসা অতিশয়োক্তি নয় জয়ের ক্ষেত্রে। সংগৃহীত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।