আকাশ ভরা রোদ উপছে পড়ছে মাঠে। ফসলের ক্ষেতে, গাছের পাতায়, পথের পাশে ফুটে থাকা রাশি রাশি ফুলে উছলে পড়ছে রোদ। মন ভালো করা এমন রোদকে সঙ্গী করে চলেছি তাইন্দং।
তাইন্দং— পাহাড়ের চূড়ায় সবুজ বনানী ঘেরা প্রাণে নেশা ধরানো এক জনপদ। সেখানে উপত্যকায়, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ফুলের মত ফুটে আছে একেকজন জুম্ম নারী ও পুরুষ; গানের মত হয়ে সেখানে সারাক্ষণ কেমন একটা সুর অবিরাম বেজে চলেছে পাহাড়ী বাঁশের পাতায় পাতায়।
কিন্তু আমরা যে তাইন্দং-এ যাচ্ছি তা কেবলি সবুজ তাইন্দং নয়; কেবলি নয় প্রাকৃতিক গানের আবাসভূমি। কেবলি নয় প্রাণে খুশির রঙ ছড়ানো রাশি রাশি রক্তজবা ফুল। আমরা যাচ্ছি এক পোড়া তাইন্দং-এ। যাচ্ছি পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে থাকা সন্ত্রস্ত রক্তজবার কাছে। যাচ্ছি আক্রান্ত উপত্যকায়।
খাগড়াছড়ি শহর থেকে প্রায় চারঘন্টা গাড়ী চালিয়ে পৌঁছাতে হয় মাটিরাঙায়। এই চার ঘন্টায় কত রকম আকাশ, কত রকম রোদ, কত রকম পাখির গান, কত রকম পাহাড়ি জংলী ফুল, ছোটো বড় কত রকম ছড়া/ছড়ি, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মিশে থাকা কত রকম নীলচে কুয়াশা যে পথে পথে ছড়িয়ে থাকবে তার আর লেখা-জোখা নেই। এই অবর্ণনীয় সুন্দর পথে যেতে যেতে পাহাড়ের দূর্গমতা শিহরন জাগাবে মনে। আর বারে বারে মনে হবে, আহা! “এই পথ চলাতেই আনন্দ”।
কিন্তু এই পথ চলার আনন্দ-শিহরন থেকে থেকেই হারিয়ে গেছে মন থেকে আমার।
সবুজ বনানী এক অদ্ভুত বিষাদ হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে। এই রোদ, পথে পথে ছড়িয়ে থাকা এই ফুল চোখ ভারা প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি হতে চেয়েছে আমার। আর চকিতে মনে হয়েছে, যেনো আমি পলাতকা; শুধু রংটুকু মেখেছি মনে, বিষাদের ভার নিতে অপ্রস্তুত। আর এই ভাবনা মনে আসতেই একটা অদ্ভুত অপরাধবোধে অজান্তেই চুপসে গেছি নিজের ভেতর।
তারপর, মনে মনে নিজেকে পাহাড়ের এক জুম্ম তরুণী বা কোলবধূর জায়গায় বসিয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করেছি তাদের পরিস্থিতি।
যদি কেউ পুড়িয়ে দিত আমার ঘর; যদি বিনা দোষে কেউ এসে জ্বালিয়ে দিত আমার ধানের গোলা; যদি কেউ এসে আঘাত করে যেতো আমার বাবা, ভাই বা স্বামী বা প্রেমিককে, কী করতাম আমি!
ভাবতে ভাবতে একটা পর্যায়ে আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে— ভয়ে, রাগে, প্রতিবাদে। মনে হয়েছে, মাতা কালি হয়ে আমি হয়তো ত্রিশুল নিয়ে বেরিয়ে যেতাম তৎক্ষনাৎ; মনে হয়েছে, হয়তো সমস্ত নির্যাতিতার সমন্বিত রূপ ধরে আমি মাতা দূর্গা হয়ে বেরিয়ে যেতাম রাক্ষস নিধনের পথে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেনো আমি ফিরে গেছি ১৯৭১-এ। আমার ভূমিতে এসে, আমার ভাষাকে তাচ্ছিল্য করে, আমার সংস্কৃতিকে তাচ্ছিল্য করে সেই সময়ে যে আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে চেষ্টা করেছে, যে আমার প্রভু হবার চেষ্টা করেছে তাকে কি মেনে নিয়েছে আমার পূর্বপূরুষ? না! মেনে তো নেয় নি।
পৃথিবীর কোথাও কোনো ভূমিপুত্রই কখনই ছাড়ে নি তার ভূমির অধিকার।
তলোয়ারের সামনে বুক পেতে দিয়েছে; গিলোটিনে পেতে দিয়েছে নিজের শির। তবু, নিজের ভূমি সে জবরদখল হতে দেয় নি। দেয় নি আমার পূর্ব পূরুষেরা; দেয় নি তাদের পূর্ব পূরুষেরাও। আমার পূর্বপুরুষদেরই এক প্রজন্ম ব্রিটিশ তাড়িয়েছে, আরেক প্রজন্ম তাড়িয়েছে পাকিস্তানি।
এইসব বহু কথা ভাবতে ভাবতে, আনমনেই মাঝে মাঝে চুপসে যেতে যেতে, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সবুজ বনানীর গায়ে সূর্যালোক পড়ে যে অদ্ভুত আলোর নদী তৈরি হয়েছে স্থানে স্থানে তাই দেখতে দেখতে, কখনো আনমনেই গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে বা কখনো সমস্বরে একটা চেনা গানে সুর মেলাতে মেলাতে, বুভুক্ষুর মতন গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে দেখতেই একসময় তাইন্দং বাজারে এসে পৌঁছে গেলো আমাদের গাড়ি।
তাইন্দং বাজারে নিজেদের মাইক্রো বাস রেখে ৫/৭ মিনিট পায়ে হেঁটে পৌঁছুলাম বাগপাড়া গ্রামের কিয়াং প্রাঙ্গনে। কিয়াং মানে উপাসনালয়। বগাপাড়া কিয়াংটির নাম শান্তি নিকেতন বৌদ্ধ বিহার। সে বিহার প্রাঙ্গনে আগেই জড়ো ছিল মানুষ।
নাগরিক প্রতিনিধি দল-এর ছোট্ট দলটি গিয়ে সেখানে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আসতে থাকলো আরো আরো অনেক মানুষ।
একে একে তিরিশ চল্লিশ পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেলো মানুষের সংখ্যা।
নারী পুরুষ যারা এসে জড়ো হলেন এখানে এরা সকলেই কোনো না কোনো ভাবে আক্রান্ত। কারো পুড়েছে বসত ঘর, কারো বসত ঘরের সঙ্গে পুড়েছে রান্না ঘর, জমানো চাল, ধান, আসবাব, ঘটি-বাটি আর বুদ্ধের বিগ্রহটিও, কারো আবার লুট হয়ে গেছে সারাটি জীবন ধরে জমানো সকল সঞ্চয়।
অনেক দূরের পাহাড়ী পথ হেঁটে ঘামতে ঘামতে পঞ্চাশোর্ধ নারী এসেছেন ত্রানের অর্থ নিতে; ষাটোর্ধ পুরুষ লাঠিতে ভর দিয়ে পাহাড় পাড় হয়ে হেঁটে হেটেঁ এসেছেন। শুধু ত্রান নয়, তারা সাথে কিছু ভরসা চায়; চায় কিছু বিশ্বাস।
গত আগস্টের তিন তারিখে তাইন্দং এর জুম্ম অধ্যুষিত ১১টি গ্রামে লাঠি-সোটা ও অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে নির্বিচারে হামলা করেছে সেটলার বাঙালিরা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তাদের ওয়েবসাইটে (পিসিজেএসএস) তাইন্দং-এর হামলার উপরে করা রিপোর্টে বলেছে, সেদিনের ঘটনায় মোট ৩৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এদের মধ্য সর্বেশ্বর পাড়ায় বৌদ্ধ বিহারের ১টি ঘরসহ ১৯টি বাড়ী, বগা পাড়ায় ১২টি, তালুকদার পাড়ায় ২টি ও বান্দরসিং পাড়ায় (ভগবান টিলা) ৩টি বাড়ী পুড়েছে।
এছাড়া সর্বেশ্বর পাড়ায় জনশক্তি বৌদ্ধ বিহার ও মনুদাস পাড়া বৌদ্ধ বিহার নামে ২টি বৌদ্ধ মন্দিরসহ প্রায় ৪০০ ঘরবাড়ীতে লুঠপাট ও ভাঙচুর করা হয়।
প্রাণের তাগিদে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে ‘নো ম্যান’স ল্যান্ডে’ আশ্রয় গ্রহণ করে ৪৫৪ পরিবারের প্রায় ২০০০ জন জুম্ম ।
আর ৩৮০টি পরিবারের প্রায় ১,৫০০ জন ত্রিপুরা পার্শ্ববর্তী পানছড়ি উপজেলায় এবং অন্য আরো ৩৫টি পরিবার জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
হামলায় কমপক্ষে ১২ জন জুম্ম আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পিসিজেএসএস। জুম্মদের অভিযোগ রয়েছে এই বলে যে, সেদিনের ঘটনায় পুলিশ ও বিজিবি কোনো কার্যকর ব্যাবস্থা নেয় নি। তাছাড়া এমনও অভিযোগ আছে যে, কিছু পাহাড়ীকে বিজিবি সদস্যদের সামনে থেকে কেড়ে নিয়ে বিজিবি সদস্যদের সামনেই মার-ধর করেছে বাঙালীরা।
“এ হামলায় পুড়ে যাওয়া ৩৬টি ঘরাবাড়ীর মধ্যে ১৫টি ঘরবাড়ীর ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ পাওয়া গেছে ২৬ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা।
অন্যদিকে লুঠপাট ও ভাঙচুর হওয়া ৪০০ ঘরবাড়ীর মধ্যে ২৬২টি ঘরবাড়ীর ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ পাওয়া গেছে ১ কোটি ২৮ লক্ষ ৯৮ হাজার টাকা। আর পুড়ে যাওয়া অবশিষ্ট ২১টি বাড়ী এবং লুটপাট ও ভাঙচুর হওয়া অবশিষ্ট ১৩৮টি ঘরবাড়ীর ক্ষয়ক্ষতিসহ হিসেব করলে এ হামলায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২ কোটির টাকার অধিক” বলে জানিয়েছে পিসিজেএসএস।
যাদের ঘর পুড়ে গেছে, সর্বস্ব লুট হয়ে গেছে যাদের, তাদেরই একটি অংশ এসে জড়ো হয়েছে শান্তি নিকেতন বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গনে। আর এসেছে কয়েকজন স্থানীয় নেতা— কারবারী ও হেডম্যান।
নাগরিক প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে ঢাকা হতে সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া সহায়তার অর্থ তুলে দেয়া হয়েছে নাগরিক প্রতিনিধি দলের স্থানীয় প্রতিনিধিদের কাছে।
তারাই ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে সেই টাকা বিলি-বন্টন করবেন।
সেই হামলার পর থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্থ প্রতি পরিবারকে ৩০ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে প্রতিমাসে। সেই চালে টেনেটুনে চলছে কারো সংসার। কারো একপেট, কারো আধপেট, কারো আবার না খেয়েই কাটছে কোনো কোনো বেলা।
হ্যাঁ, এভাবেই খেয়ে না খেয়ে, নিজের পোড়া ভিটায়, ভয়ার্ত পরিবেশে দিন কাটাচ্ছে পীড়িত জুম্ম সমাজ।
শিশুরা এখনো স্কুলে যেতে ভয় পায়। পাহাড়ীরা নিজের ফলানো পেয়ারাটা, কলাটা, মিষ্টিকুমড়াটা বাজারে নিয়ে যেতে কেমন ভয়-ভয় পায়। রাতের বেলায় ঘরের মধ্যে শুয়ে কেমন বুকটা তাদের কেঁপে কেঁপে উঠে অজানা আশঙ্কায়। ভর দুপুরে পোড়া ভিটেতে বসে, পাহাড়ের ওপারে দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস হারানোর শোকে নিঃশব্দে কাঁদে কেউ কেউ।
ভয় যাদের নিত্য সঙ্গী, নিজ ভূমে যারা কাটাচ্ছে প্রায় নজরবন্দী জীবন, তারাই কি নয় নিজভূমে পরবাসী ভূমিপুত্রের দল? কী ছিল এইসব ভূমিপুত্রদের অপরাধ? কেন তারা নিজভূমে পরবাসী, পরাভূত আজ?
তাইন্দং ইউনিয়ন-এর বগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বিনয় চাকমা কারবারীর সঙ্গে কথা হয়।
তিনি বলেন, জুম্মদের যে ১১টি গ্রামে আগুন দেয়া হয়েছে সেই গ্রামগুলোই হচ্ছে মাটিরাঙার সবচেয়ে উর্বর জুমচাষ যোগ্য ভূমি। এখানে ফসল হয় সবচে বেশি, সবচেয়ে ভালো। আর এই ভালো ও উর্বর জমিগুলোও নিজেদের দখলে নেবার লোভেই করা হয়েছে হামলা ও নির্যাতন।
মানবেন্দ্র ত্রিপুরাও একই কথা জানালেন। জানালেন যে, জুম্মদের উচ্ছেদ করে তাদের জমিগুলো নিজেদের দখলে নেবার জন্যই এই হামলা করেছে সেটলাররা।
তাইন্দং মৌজা’র হেডম্যান প্রভাত কান্তি রোয়াজা-এর সাথে কথা হয়। তিনি এলাকার ভয়ার্ত পরিবেশের বর্ণনা দেন। পাহাড়ের সন্তানদের বুকের গহীনে যে কী একটা অদ্ভুত আশঙ্কা, অবিশ্বাস আর নিরাপত্তাহীনতা ঢুকে গছে সেই সব কথা তিনি জানান আমাদের।
খাগড়াছড়ি শহরের স্থানীয় নেতা দীপায়ন চাকমার সাথেও কথা হয়। তাইন্দংবাসীদের অনিশ্চয়তা, আর বেদনার কথা বলার পাশাপাশি তিনি এটাও জানান যে, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারের ভূমিকায় তারা আশাবাদী হয়েছেন।
কামাল নামের বাঙালী ছেলেটিকে অপহরন করা হয়েছে বলে মিথ্যে গল্প ফেঁদে যারা হামলা করেছিল জুম্মদের তাদের অনেককেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতার করেছে কামালকেও। তাই, বেরিয়ে এসেছে ষড়যন্ত্রের প্রকৃত গল্প।
অনেক অপরাধীই ধরা পড়েছে। সরকার ত্রান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে উৎপীড়িতদের।
নাগরিক প্রতিনিধি দল ঢাকা থেকে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের নিয়ে গিয়ে প্রকৃত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে, পাহাড়ীদের আশা ও ভরসা দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু তবু জুম্মদের চোখে মুখে থাকা ভয়ের ছায়া যেনো যাবার সাহস পায় না। তাদের চোখের দৃষ্টি দেখলে মনে হয়, যেনো এরা ঘর পোড়া গুরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই বুকে যার জেগে ওঠে আগুনের ভয়।
সেইরকমই আগুনের ভয় নিয়ে, অজানা আশঙ্কা নিয়ে পোড়া ভিটের পাশে ছোট্ট ডেরায় দিন কাটাচ্ছে অবিনীতা চাকমা।
তাইন্দং বাজার থেকে ৮/১০ মিনিটের পথ সামনে এগুলেই চোখে পড়বে অবিনীতার বাড়ি।
বাড়ির সামনে চারদিকে লাগানো গাছের কী সুন্দর সবুজ মায়া! সেই সবুজের মাঝখানে গাছ ভরা কী সুন্দর থোকা থোকা রক্তজবা ফুল!
সেই সবুজের আড়াল ও রক্তজবার সৌন্দর্য ছাপিয়ে আরেকটু সামনে গেলেই চোখে পড়বে পোড়া এক ঘরের কঙ্কাল। আর তার পাশেই দেখা যাবে একেবারে ছাই হয়ে যাওয়া ভিটে; যার গায়ে লেগে আছে পোড়া কালসিটে দাগ।
তিনটি ঘর ছিল অবিনীতা চাকমার। তিনটি ঘরের মধ্যে বড় দুইটি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এদের মধ্যে বড় ঘরটির চারটি দেয়াল যদিও বা পোড়ার চিহ্ন গায়ে নিয়ে খাড়া আছে, মাঝারি ঘরটার সেগুলোও নেই।
শুধু তিন কোনায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া তিনটি আহত খুঁটি আগুনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জুবুথুবু। এছাড়া, চাল, বেড়া, খুঁটি কিচ্ছু নেই।
ভাতের হাড়ি থেকে শুরু করে রান্নার চাল, ঘুমানোর চৌকি, কলস, সব পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে সেদিন। পোড়া কিছু টিন একত্রে স্তুপ করে জমা রাখা হয়েছে পোড়া দেয়ালটার এক পাশে।
আর ছোট্টো ডেরাটি, যেটিতে আগুন দেয়া হয় নি, সেটিতেই এখন থাকছে অবিনীতা চাকমা, তার স্বামী, তার ছেলে, ছেলের বউ, তাদের নবজাতক সন্তান সাবা।
অবিনীতা জানান, ঘটনার দিন তার দেবর তার (অবিনীতার) ছেলেকে ফোন করে পাশের এলাকা থেকে জানিয়েছে যে, পরিস্থিতি ভালো নয়। সতর্ক থাকো। মনে হয় হামলা হতে পারে।
সেই হামলা থেকে বাঁচতেই পুরো পরিবার আগস্টের তিন তারিখে দুপুর বেলায় বারটা, সাড়ে বারটার দিকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। আরো কয়েকশ মানুষের সঙ্গে তারাও হাঁটতে হাঁটতে সীমান্ত পারি দিয়ে নো ম্যন্সেল্যান্ডে নেয় আশ্রয়।
সেদিন প্রাণ বাঁচতে গিয়ে সেই হাঁটামিছিলে সামিল হয়েছিলেন অবিনীতার ছেলের বউ, প্রায় সাড়ে নয় মাসের গর্ভবর্তী তরূনী, সুবর্ণা চাকমা।
সুবর্ণার অবস্থা এমনই ছিল যে, যে কোনো দিন, যে কোনো সময় তার বাচ্চা প্রসব হয়ে যেতে পারে। সেই অবস্থাতেই সবার সঙ্গে হেঁটে সেও পৌঁছেছে নো ম্যান্সল্যান্ডে। সেখানেই কাটিয়েছে একরাত। তারপর দিন সকালে বাড়ি আসার পরপরই সুবর্ণার প্রসব বেদনা হয়।
তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় তাইন্দং বাজারে তাদের আটকায় একদল বাঙালী। তারপর সুবর্ণার অবস্থা দেখে বাঙালীরা তাদের ছেড়ে দেয় এবং হাসপাতালে জন্ম নেয় সুর্বাণার মেয়ে সাবা।
অবিনীতা চাকমা, বা সুর্বণা চাকমার মত আরো শত শত মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়েছে সেদিন। আর ফিরে এসে দেখেছে ভিটেতে ঘর নেই। ঘরের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ঘরের কঙ্কাল; পোড়া কাঠামো।
দেখেছে, বাতাসে উড়ছে ছাই। দেখেছে, পোড়া কাঠের খুঁটি, অ্যালুমিনিয়ামের পোড়া কলসি, পোড়া ভাতের হাড়ি থেকে পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি।
সেই কুণ্ডুলি থেমে গেছে। রোগ, শোক, ক্ষুধা, ভয় সব কিছুকে পাশে রেখে আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তাইন্দং। পোড়া ভিটেতে থেকেই পাহাড়ে নতুন ফসল ফলিয়ে আবারো নতুন করে বেঁচে ওঠবার স্বপ্ন দেখছে জুম্মরা।
তারা বারবার ভাবতে চাইছে, যা হবার হয়তো হয়ে গেছে; হয়তো আবারো আর কোনোদিন নতুন করে অস্থির হয়ে উঠবে না এই ছায়া-সুনিবিড়-শান্ত জীবন। ভাবতে চাইছে, তার যে পাহাড় আছে, যে ভূমি সে পেয়েছে পিতা, পিতামহ, প্রোপিতামহের পাহাড়ী জীবনের উত্তরাধিকার থেকে, সেই ভূমি কেড়ে নিতে পুনরায় উদ্যত হবে না কেউ।
তাদের মতই আমিও বার বার একই কথা ভাবতে চেয়েছি মনে প্রাণে। শান্তি নিকেতন বৌদ্ধ বিহারের প্রাঙ্গনে বানানো চারদিক খোলা ঘরের ভেতর বসে নবীন, প্রবীন ভূমিপুত্রদের দেখতে দেখতে, জুম্ম নারীদের পিঠে ও মাথায় করে সরকারের দেয়া ত্রানের চালের দয়া বয়ে নিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আমার ভেতরের ভূমিপুত্রটি কেঁদে ওঠেছে। বলেছে, এ আমার ভূমি।
আমি এ ভূমির ফুল; এ ভূমির গান; এই ভূমির দূর্গম জীবন আমার অহংকার।
জুমের চাল-এর ভাত এর সাথে শুটকি দিয়ে রাঁধা বাঁশকোড়-এর এক তরকারীর খাওয়া আমার রক্তের ডাক। এই ডাক-ই আমার ঐতিহ্য। আমাকে আমার মত এই সবুজ পাহাড়ের মায়ায়, রোদের অপূর্ব রং, বাঁশ পাতায় পাতায় বেজে ওঠা গানের ভেতর থাকতে দাও। আমি তোমাদের করুণ চাই না হে নগরের মানুষ।
ত্রান নয়, পরিত্রান চাই। চাই সহাবস্থান। চাই ভালোবাসা। চাই আমার ভূমিতে আমার গানের অধিকার।
০২.১০.১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।