আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজ ত্বকীর জন্মদিন

নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী গত ৬ মার্চ বিকেলে নিখোঁজ হন। ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর কাদাবালি থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। দুর্বৃত্তরা নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করে। আজ ৫ অক্টোবর ত্বকীর ১৮তম জন্মদিন। নিহত পুত্রকে নিয়ে লিখেছেন তার বাবা রফিউর রাব্বি ও মা রওনক রেহানা

৬ মার্চ ত্বকী নিখোঁজ হলে আমাদের অন্তরে কারবালার আলোড়ন শুরু হয়।

পরদিন ওর মা ওর বইয়ের তাক থেকে একটি খেরো খাতা নিয়ে আসেন। তাতে গণিত ও পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন সূত্র ও তত্ত্বের পাশাপাশি রয়েছে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা কয়েকটি কবিতা। কিছু কথা ও কাব্যময় বিক্ষিপ্ত ছত্রের সমাহার। একটি কবিতায় এসে চমকে উঠলাম—
আরও একবার আমি মানুষ হয়ে মরব,
উত্থিত হতে নিষ্কলঙ্ক ফেরেশতাদের পাশে—
তবে তা থেকেও উন্নীত হতে হবে আমাকে, কারণ
ঈশ্বর ছাড়া সকলেই যে ধ্বংস হবে—

যেদিন আমার স্বর্গ পবিত্র আত্মার বলি দিব,
আমি হব তাই,
যা ছিল না কখনো কারও কল্পনা চিন্তায়—
আমার যেন বিলুপ্তি ঘটে, কারণ
অনস্তিত্ব ইন্দ্রিয়ে সুর তুলে আমি তাঁর কাছে ফিরব—
এই ঝড়ের মধ্যেও চোখের সামনে ভেসে উঠল কাহিলল জিবরানের মুখ। সেদিনই ওর এ-লেভেল পরীক্ষার প্রথম বর্ষের ফল প্রকাশিত হলো।

পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে বিশ্বের সর্্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। ও-লেভেল পরীক্ষায়ও পদার্থবিদ্যায় দেশের সর্বোচ্চ নম্বর ছিল। কিন্তু ভালো ফলাফলে কোনো আগ্রহ ছিল না ওর। ওর চোখ ছিল অন্যখানে। জগৎ, মহাকাশ এবং এর সৃষ্টি নিয়ে ছিল অপার জিজ্ঞাসা।

সবকিছুর গভীরে যেতে চাইত। সাধারণ ভালো ওর কাছে ভালো ঠেকত না। চোখ ছিল হিমালয়ের চূড়ায়। আকাশছোঁয়া স্বপ্ন ছিল চোখে।
ও যখন ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছে, বাংলায় নম্বর ছিল ৬৭ কি ৬৮।

আমি বললাম, ‘দ্যাখো, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, তুমি আর যাই শেখো না কেন, নিজের ভাষাটা ভালো করে শিখতে হবে। জানতে হবে। একে অবহেলা করলে চলবে না। ’ সেদিন ও কিছুই বলল না। দুই দিন পর বলল, দেখো বাবা, আগামী বছরই বাংলায় আমি ভালো করব।

পরের বছর বাংলায় ওর নম্বর ছিল সম্ভবত ৮৩ কি ৮৪। ও নিজেকে বুঝতে পারত। নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ওর ছিল।
কৌতূহলী এক কিশোর
আক্ষরিক অর্থেই নিভৃতচারী বলতে যা বোঝায়, ত্বকী ছিল তা-ই। ওর ভালো নাম তানভীর মুহাম্মদ।

মগ্ন চৈতন্যে অন্তর্মুখী অথচ জগৎ ও চারপাশ সম্পর্কে উদাসীন নয়, কৌতূহলী এক কিশোর। আবৃত্তি ভালো করত। একবার শুনলেই কবিতার মূল সুরটি ধরতে পারত। দীর্ঘ কবিতা মুখস্থ করে ফেলত। ওর কণ্ঠের আবৃত্তি বাতাসে কান পাতলে এখনো শুনতে পাই—
মেঘের মধ্যে মাগো যারা থাকে
তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে—
ত্বকী এই আহ্বান প্রকৃতই শুনতে পেয়েছিল কি না, জানি না।

বন্ধুবান্ধব হইহুল্লোড় খুব একটা পছন্দ করত না। বন্ধু তেমন একটা ছিলও না। বন্ধু বলতে হয়তো আমিই ছিলাম। কারণ ওর যা বলার, যতটুকু বলার প্রয়োজন বোধ করত, আমার সাথেই করত। কারও বিরুদ্ধে কখনো অভিযোগ ছিল না।

বন্ধু, পরিজন, শিক্ষক কারও সম্পর্কে কখনো কোনো অভিযোগ করেনি। কেউ দুঃখ পাবে, এমন আচরণ ছিল ওর নীতি ও রীতিবিরুদ্ধ। দূরের বা অপছন্দের কেউ হলেও না। ছিল স্বল্প ও মৃদুভাষী। প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছে ছিল।

বলেছিলাম, এ-লেভেল শেষে দেশের বাইরে চলে যাও। পড়াশোনা শেষ করে ফিরে এসো। ও দেশের বাইরে যেতে চাইত না। মাকে বলত, দেশে থেকে কি লেখাপড়া হবে না? দেশের পড়াশোনা কি এতই খারাপ যে বাইরে যেতেই হবে? আমি শুনে বললাম, বাইরে যাওয়াটা দোষের কিছু না। আমাদের সামনের যে মানুষগুলো রয়েছেন, তাঁরা সবাই তো বাইরে গিয়েছেন, বিশ্ব ঘুরেছেন।

বাইরে না গেলে ভেতরটাকে ঠিক জানা যায় না। ভেতরটা ভালো করে জানার জন্য, বোঝার জন্য হলেও বাহিরটাকে জানার প্রয়োজন পড়ে। আমার সঙ্গে কিছুই বলল না। পরে মাকে বলল, তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাব না, থাকতে পারব না। আজ বড় জানতে ইচ্ছে করে, আমাদের চিরতরে ছেড়ে ওখানে কী করে আছ?
একজন শহীদের ময়নাতদন্ত
ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের বোর্ডপ্রধান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ত্বকীকে মাথার তিন দিক থেকে আঘাত করা হয়েছে।

এ আঘাতই তার মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু হত্যাকারীরা মৃত্যুটা ত্বরান্বিত করার জন্য গলা চেপে শ্বাসরোধে তাকে হত্যা করেছে। একটি চোখ উপড়ে এনে দেহের মধ্যভাগের একটি অঙ্গ থেঁতলে দিয়েছে। ’ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যাকারী এক ঘাতক বলেছে, গজারির লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করার পর ত্বকীর বুকের ওপর উঠে গলা টিপে শ্বাসরোধে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ঘাতকেরা যখন ওকে মাথায় আঘাত করেছে, আমি জানি না জোরে কথা বলতে না চাওয়া ত্বকী তখন চিৎকার করেছে কি না! কী বলেছে ওদের? কাউকেই কখনো কষ্ট দিতে না চাওয়া ছেলেটির কী আচরণ ছিল তখন? ঘাতকের শক্ত বাহু যখন ওর কণ্ঠ সজোরে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরেছিল, তখন মানুষ সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে, জগৎ সম্পর্কে মানবতা-মনুষ্যত্ব—এসব সম্পর্কে ওর নতুন কোনো ধারণা তৈরি হয়েছিল কি না।

এত দিন যে ধারণা ওর মধ্যে তিলে তিলে গড়ে উঠেছিল, তার কোনো বদল হয়েছিল কি না, আজ তা জানতে ইচ্ছে করে। ‘একজন শহীদের ময়নাতদন্ত’ শিরোনামে ইংরেজি একটি কবিতায় ত্বকী লিখেছে—
ওরা ছুরি ও
ধারালো অস্ত্র দিয়ে
দ্বিখণ্ডিত করে কণ্ঠনালি
ওরা উল্লাসে দেখে
কীভাবে শরীর থেকে
বৃষ্টির মতো রক্ত গড়ায়।
ধারালো অস্ত্র দিয়ে
শরীরের চামড়া ছিলে নেয়
এবং দেখে ভেতরের মাংসপেশি ও হাড়গোড়
ওরা টুকরো টুকরো করে হাড়গোড়
খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলে
বীভৎস উল্লাসে
এই সব হাড়গোড় শরীরে জড়িয়ে
জানান দেয় নিজেদের সাহসিকতা
স্মারক চিহ্ন করে
ঝুলিয়ে নেয় গলায়—
ওরা সেই সব মৃত মানুষের মাংস খায়
বর্বর অন্ধকার যুগে যেমনি মানুষখেকোরা
ভক্ষণ করেছে তাদের স্বজাতিকে
ত্বকীর শেষ দিনগুলো
ত্বকীর পছন্দের রং ছিল কালো। কালো জামা প্রিয় ছিল। ৬ মার্চ বিকেলে বাসা থেকে যখন বের হবে, পরনে কালো জিনস আর গায়ে সাদা টি-শার্ট।

আমি বললাল, জামাটা বদলে নাও। ও কালো একটা জামা পরে নিল। জীবনের সব ধকল ওই জামাটির ওপর দিয়ে গেল। ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যার পাড়ে যখন কাদা-বালুতে পড়ে ছিল, চেনার জো ছিল না। এ জামাটিই ত্বকীকে চিনতে সাহায্য করেছে।


ছোট থেকেই পাঠ্য তালিকার বাইরের বইয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল। ত্বকী যখন ক্লাস এইটে, তখন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা, চিলেকোঠার সেপাই, লিয়েভ তলস্তোয়ের ওয়্যার অ্যান্ড পিস পুরোটা পড়েছিল। ও-লেভেল পরীক্ষার শেষে এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজম, রিপ্রেজেন্টেশনস অব দি ইন্টেলেকচুয়াল পড়েছে। পরে দেখেছি জ্যাক দেরিদা মনোযোগ দিয়ে পড়তে। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি তুমি বুঝতে পারছ? উত্তর না দিয়ে শুধু হাসল।

নিখোঁজ হওয়ার মাস খানেক আগে থেকে দেখেছি ফ্রেডরিক নিটশের জড়থুস্ত্র বললেন গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, সঙ্গে তলস্তোয়ের ছোটগল্প। আইনস্টাইন ওর প্রিয় ছিল। প্লেটোর রিপাবলিক ও পড়েছে। লালনের প্রতি আকর্ষণ ছিল। আগ্রহ ছিল সুফিবাদে।

সুধীজন পাঠাগার থেকে আনা ওর বইয়ের তালিকায় মূলত ছিল গণিত ও পদার্থবিদ্যার বই।
১০ বছর বয়সে ত্বকী কোরআন শরিফ পাঠ শেষ করেছিল। রমজান মাসে পুরো ৩০টি রোজা রাখত। আমি মাঝেমধ্যে নিষেধ করতাম, কিন্তু জোর করতাম না। আমরা কখনোই ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে কিছু বলিনি।

বলার প্রয়োজন পড়েনি। ওর পড়াশোনার নিজস্ব একটা নিয়ম ও নিজেই তৈরি করে নিয়েছিল। স্কুল থেকে বিকেলে এসে ঘুম। রাতে উঠে খাবার সেরে পড়া শুরু করে টানা ভোর তিনটা-চারটা। কিন্তু সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে থাকাটা ওর স্বভাব ছিল না।

যতক্ষণই পড়ত মনোযোগ দিয়ে পড়ত। পড়াটাকে ও উপভোগ করত। স্কুলে বা বাইরে কখনো কোচিং করেনি। বিভিন্ন সময়ে কোচিং করার প্রয়োজন আছে কি না, জিজ্ঞেস করলে মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছে, প্রয়োজন নেই। ত্বকীর এ-লেভেল পরীক্ষার আগে ওর স্কুলের এক শিক্ষক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন, তাঁর কোচিং না নিলে ত্বকী পরীক্ষায় ভালো করতে পারবে না।

বিষয়টা ত্বকী বাসায় বলেনি। ফল প্রকাশের পর সেই শিক্ষক কেঁদে বলেছিলেন, ‘চ্যালেঞ্জে ত্বকী আমাকে হারিয়ে দিয়ে গেল। ’
এ-লেভেল পরীক্ষার পর ও একদিন বলল, আচ্ছা, পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের দরকারটা কী? আমাদের সামনের বড় বড় মানুষের কারোরই তো পরীক্ষায় ফল ভালো দেখছি না। বড় হতে তো ভালো ফলাফলের প্রয়োজন পড়ে না। বললাম, বড় হতে বা মানুষ হতে হলে ভালো ফলাফলের প্রয়োজন পড়ে না ঠিকই, তবে যে সময়টা তুমি এই পড়াশোনার জন্য ব্যয় করছ, তার সঠিক ব্যবহারটা নিশ্চিত হলো।


কখনো বাসায় ফিরতে দেরি হলে ফোনে জানিয়ে দিতাম খেয়ে নিতে। কিন্তু গিয়ে দেখতাম, সবাই খেয়ে নিলেও ত্বকী না খেয়েই বসে আছে। খাবারদাবারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না। খুব কম খেত। ওকে জোর করে খাবার দিতে হতো।

আমি ছাড়া অন্য কেউ দিলে আবার নিতে চাইত না। মুখ ফুটে কখনোই কিছু চাওয়া ওর স্বভাবে ছিল না। দাবা খেলতে ভালোবাসত। ক্রিকেট খেলাটা পছন্দ করত।

ত্বকীর খেরো খাতা
মৃত্যুর পর খেরো খাতায় দেখলাম, এক জায়গায় লিখেছে—‘হূদয়ে আজ নব বসন্তের গান/ পাখির ডাকের সাথে ধ্বনিত হচ্ছে শাহবাগের স্লোগান।

’ শাহবাগের জাগরণ মঞ্চের প্রতি ওর প্রবল আগ্রহ ছিল। নিজের ইচ্ছার কথা কখনোই সরাসরি বলত না। ঘুরিয়ে বলত। একদিন বলল, ওর সহপাঠীরা আগামী দিন সবাই শাহবাগে যাবে বলে ঠিক করেছে; ত্বকী তাদের সাথে যাবে কি না, তারা জানতে চেয়েছে। সেই দিনটিতে ছিল শাহবাগে জাগরণ মঞ্চের এক মহাসমাবেশ।

পাশাপাশি বিএনপি ও জামায়াতেরও একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি। চলমান সহিংস ও সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে অনিবার্য আশঙ্কা থেকে বলেছিলাম, আগামীকাল যেয়ো না; দু-চার দিন পর আমিই তোমাকে শাহবাগে নিয়ে যাব। আমাদের নারায়ণগঞ্জে গড়ে ওঠা জাগরণ মঞ্চের ব্যস্ততায় ত্বকীকে নিয়ে আর শাহবাগে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরে দেখলাম ত্বকী তার খাতায় লিখেছে, ‘লুকোচুরি খেলব বলে চলে এলাম তোমার আগে/ সংগ্রাম চলছে শাহবাগে। ’ শাহবাগ নিয়ে ইংরেজিতে ‘শাহবাগ সংগ্রাম’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছে।

রাজীব হায়দারকে নিয়ে লিখেছে—
ফুলের মতো দৃশ্যমান
রক্তমাখা রাজীবের চোখ
সবুজ পাতার সাথে
দৃশ্য জুড়ায়
লাল-সবুজের পতাকা-
যেন বলে ওঠে
এই তো স্বদেশ
লাল-সবুজের বাস যেখানে
প্রকৃতি ও সংগ্রামে-

এই পৃষ্ঠায়ই দুটি লাইন লিখেছে ‘কোকিলের পাশাপাশি উড়ে চলে/ শোকের কালো পতাকা’। লাইন দুটি আবার কেটে দিয়েছে। শোকের পতাকা হয়তো ত্বকী ওড়াতে চায়নি। অন্তহীন শোকের পূর্বাভাস হয়তো তার আগেই জানা ছিল। একটি কবিতায় লিখেছে—
সমগ্র মানব জাতি আজ
এক কাতারে দাঁড়াবে
...
জলাঞ্জলি দিয়ে হিসেব কষা
ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান
বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।

এটা বিশ্বাসের কথা; স্বপ্নের কথা। সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই সমগ্র মানব জাতিকে এক কাতারে দাঁড় করানোর সেই যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, তাতে আমাদের সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি—সব এরই দোহাই দিয়ে আজ অন্ধ গলিতে ঢুকে পড়ছে। আজকের কর্তব্যটি তারই বিরুদ্ধে। সে কাজ সম্পর্কে কতটা ধারণা ছিল ত্বকীর জানি না। তবে সে তার জন্য নিজেকে যে ধীরে ধীরে তৈরি করে চলেছিল, সেটি বোঝা যায়।

কিন্তু ত্বকী অবশেষে অঙ্কুরেই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোর সঙ্গে গিয়ে মিশে গেল, মিশে গেল ঝরা পাতাদের দলে।
‘ফিরে এসো বাংলাদেশ’ শিরোনামে ইংরেজিতে একটি কবিতায় লিখেছে—
যারা যুদ্ধের ডাক দিয়েছিল,
যারা অপেক্ষায় আছে আজও একটি বিচারের—
একটি বিচার
যা শেষ করার জন্য
তারা
যুদ্ধের সেই সব নায়কেরা
ডাক দিয়ে যায়—
জাতির জন্য, জেগে ওঠার জন্য
ওই জাতির জন্য; যারা ধ্বংসের মধ্যেও
নতুন জীবনের ডাক দিয়ে যায়;
তুমি কি শুনতে পাও
সেই সব শহীদের কণ্ঠস্বর?
কবিতা লেখার কথা ত্বকী বলেনি কখনো। এগুলো হয়তো নিখোঁজ হওয়ার আগের দু-তিন মাসের মধ্যে হবে। ইংরেজিতে লেখা কয়েকটা গল্প, নিবন্ধ ইতিপূর্বে সে দেখিয়েছে। খাতার এক জায়গায় লিখেছে, ‘ধ্যান, পড়াশোনা, গান, লেখালেখি, সমাজ’।

কোথাও লিখেছে, ‘প্রবন্ধ লিখব, গল্প লিখব, ভালো লিখব’। লেখালেখির ইচ্ছে ওর মধ্যে ছিল। একদিন জিজ্ঞেস করল, ভালো লিখতে হলে কী করতে হবে? বললাম, পড়তে হবে, চারপাশটা দেখতে হবে, তারপর লিখতে হবে। তারপর আবার পড়তে হবে, একে চারপাশের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে, পরে আবার লিখতে হবে; এভাবে করে করেই একসময় লেখা হয়ে যাবে। শৈশব থেকেই ত্বকী ছবি আঁকতে ভালোবাসত।

প্রথম আলোর ‘গোল্লাছুট’ পাতায় প্রায়ই ওর আঁকা ছবি ছাপা হতো। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ শিরোনামে ও একটি ছবি এঁকেছিল। ব্যানার-ফেস্টুন হাতে শিশুদের মিছিল। শান্তির মিছিল। যুদ্ধের বিপক্ষে ত্বকী ছিল শান্তিপ্রিয়।


গান শিখত। শাস্ত্রীয় সংগীত। মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রসংগীত গাইত। লালন ও হাসন রাজার গান ওর প্রিয় ছিল। সময় পেলেই লালনের গান শুনত।

ওর খেরো খাতায় দেখলাম, লালনকে নিয়ে ‘ফকির লালন সাঁই’ শিরোনামে ইংরেজিতে লেখা ছোট্ট একটি নিবন্ধ লিখেছে। সেখানে লিখেছে, ‘লালনের দর্শন গড়ে উঠেছে বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবদের সহজিয়া, ইসলামের সুফি ও লোকায়ত দর্শনের সমন্বয়ে। ... তাঁর গানের ভিত্তি বৈষ্ণববাদ হলেও তাঁকে শুদ্ধ বৈষ্ণববাদ বা শুদ্ধ সুফিবাদ কোনোটাতেই ফেলা যাবে না। ’ সুফিবাদের প্রতি আকর্ষণের কারণেই হয়তো এ বিষয়ে কিছু পড়াশোনা করেছে। মাঝেমধ্যে ও মেডিটেশন করত।

শেষ সময়টায় দেখতাম প্রায়ই মেডিটেশন করত। সৃষ্টি, স্থিতি, সত্য-অসত্য, জগৎ ও মহাকাশ নিয়ে কৌতূহলের সীমা ছিল না। কখনো প্রশ্ন ��

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।