সখা, নয়নে শুধু জানাবে প্রেম, নীরবে দিবে প্রাণ, রচিয়া ললিতমধুর বাণী আড়ালে গাবে গান। গোপনে তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া রেখে যাবে মালাগাছি। এই ব্লগের©শান্তির দেবদূত।
এক.
চোখে চোখে তাকিয়ে আছি সমানে সমান; মাঝেমাঝে ভ্রুজোড়া একটু কুঁচকে যাচ্ছে আমার, তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হচ্ছে দৃষ্টি, কিন্তু তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, শুধু পায়ে পা ঘসে যাচ্ছে; দশ সেকেন্ড, বিশ সেকেন্ড, এক মিনিট, দুই মিনিট, পাক্কা তিন মিনিটের টানটান স্নায়ু যুদ্ধের পর রণে ভঙ্গ দিয়ে আমি চিৎকার করে ডাকলাম, “কবুল, এই কবুল! কবুইল্লা! ঐ কবুইল্লা!”। আশ্চর্য ব্যাপার হলো যদিও নাম তার কবুল কিন্তু ‘কবুইল্লা’ না ডাকা পর্যন্ত তার সারা পাওয়া দুষ্কর! আর একটা মানুষের নাম কবুল রাখে কোন আবুলে! অদ্ভুত!
- “জ্বী বস্?” হন্তদন্ত হয়ে আসে কবুল যথারীতি।
তোমাকে কতদিন বলেছি আমাকে চা দিবে চিনি ছাড়া?
- বস্ কি চা এ চুম্মুক দিছেন? চুম্মুক ছাড়া কেমনে বুঝলেন চিনি দিছি কি দেই নাই? খানিকটা তেজের সাথেই বলে কবুল।
“চিনি ছাড়াই যদি হবে তাহলে কোন গুপ্তধনের আশায় এই মাছি খানা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তুমি কাপ রেখে যাওয়ার সাথেসাথেই? চা খাওয়ার আশায়? এইটা কি তবে চৌ-মাছি? হ্যাঁ?”, ভ্রু নাচিয়ে কিঞ্চিৎ নাটকিয় ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করি তাকে, হারার পাত্র নই আমি।
বেরসিক মোবাইলটা আর বেজে উঠার সময় পেল না, অদ্ভুত ব্যাপার; যখনই জরুরী কাজে থাকি তখনই বেজে উঠে, যখনই বসের সামনে থাকি তখনই বেজে উঠে, যখনই প্রাতকাজে আসনে বসা তখনই শুনতে পাই উনি বেজে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই; এসে নির্ঘাৎ দেখব বস্ জরুরী কোন কাজে ফোন করেছিল, কল ব্যাক করার পর, প্রথমে যে কথা শুনতে হবে, “তোমাকে তো কাজের সময় কখনোই পাওয়া যায় না! কি ব্যাপার শুনি?” তখন কী আর বলা যায় এই অধম ত্যাগের উল্লাসে মত্ত ছিল!
- “হ্যালো?” অপরিচিত নাম্বার, বেশ আয়েশের সাথেই ধরলাম ফোনটা।
খাস্তগীর আপনার কে হয়?
- অপরিচিত নারী কণ্ঠ, কণ্ঠে যেমন তেজ তেমনি কর্তৃত্ব ঝরে পড়ছে, খানিকটা রোমান্টিকতার ছোঁয়াও পেলাম। কিন্তু খাস্তগীরের শুনে অবচেতন মন আমার রোমান্টিকতার লাগাম টেনে ধরল।
“হ্যাঁ, খাস্তগীর আমার বাল্যবন্ধু। ”, মনে মনে ভাবছি, “কি ব্যাপার? পাত্র-পাত্রী ঘটিত কোন কেস না তো!” খানিকটা স্বপ্রণোদিত হয়ে বললাম, “ছেলে হিসাবে সে কিন্তু যাকে বলে, একেবারে অসাধারণ”
“জ্বি, ছেলে হিসাবে কেমন সেটা জানার জন্যেই ফোন দিয়েছি”।
- সুরেলা কণ্ঠে কানে যেন মউ বর্ষণ হচ্ছে আমার, তার উপর এমন অর্জুনের ন্যায় লক্ষ্যভেদ! খানিকটা উত্তেজনার বশবর্তি হয়ে গদগদ হয়ে বললাম, “আমরা খুব ভাল বাল্যবন্ধু, সে আমার পরামর্শ ছাড়া এক পা ও নড়ে না”
জ্বি, সেটাই অনুমান করতে পারছি; আমি ডিবির এ.এস.পি রোকসানা পারভীন বলছি, আপনাকে এক্ষণি আমাদের কার্যালয়ে আসতে হবে।
- কোকিলিয়ার কাকীতে রুপান্তর! কর্কশ পুলিশি স্বরে মউ বর্ষণ মুহূর্তেই রূপ নেয় তীক্ষ্ণ অম্লে; কয়েকটা স্পন্দন ফসকিয়ে যায় বেচারা হার্টের। পরিস্থিতির এমন দৈবৎ পরিবর্তনে হতভম্ব হয়ে কখন যে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে, “জ্বী! জ্বী ম্যাডাম! জ্বী ম্যাডাম!! আপনি যেখানে আসতে বলবেন সেখানেই হাজির হয়ে যাবো, ম্যাডাম।
না! না!! কোন ফোর্স পাঠাতে হবে না, খামাখা কেন কষ্ট করবেন, আমি নিজেই চলে আসছি, জ্বী, এক্ষণি আসছি, এক্ষণি, জ্বী। ” বলে যাচ্ছি সেদিকে আমার কোন খেয়ালই নেই। ফোনটা রেখে দেখি বদমাইশটা চোখে ফেঁড়ে আমাকে দেখছে আর হাসি যেন কেউ ক্লিপ দিয়ে টেনে আটকিয়ে রেখেছে দুই কান অবধি! সার্টের হাতা দিয়ে কপালে জমে উঠা বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা মুছে চেয়ারটায় বসে পড়লাম ধপাস করে। মাথার মধ্যে অসংখ্য সম্ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু কোনটার ব্যাপারেই নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, হাজার হলেও খাস্তগীর হারামজাদাটা জড়িত বলে কথা! তাই বলে ডিবির খপ্পরে! শালা মরার আর জায়গা পেলি না! মরলে মরবি কিন্তু তার মধ্যে আমাকে জড়ালি কেন? একবার এ থেকে বের হয়ে নেই, তোর চৌদ্দগুষ্টির ধারের কাছেও ঘেষবো না; আপন মনে খিস্তিখেউর করতে করতে অফিস থেকে বের হলাম, তার আগে প্রকৃতিকে একটু হালকা করতে ভুলিনি।
দুই.
“হারামখোরের বাচ্চা! আমারে চিনস না, নাহ? এইবার চিন্না রাখ! কত্ত বড় সাহস, আমারে চোখ মারছ? তোর জিব্বা টাইন্না ছিঁড়া ফালামু লগে তোর বাপের কইলজাও”, দশাসই নিতম্ব দুলিয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করতে করতে ঘরে প্রবেশ করে বিশালদেহী এক ললনা! বুকের উপর নেমপ্লেট জ্বলজ্বল করছে, “রোকসানা পারভীন”; আমার কলিজায় কাপন ধরে গেল মুহূর্তেই; কার না কার জিহ্বা বেচারা! চোখের দোষের আজ মরতে বসেছে।
শব্দ করে চেয়ারটা টেনে বসার আগে টেবিল থেকে নোংরা তোয়ালেটা তুলে হাতের মধ্যে লেগে থাকে রক্ত মুছে নেয়; নিশ্চয় থার্ড ডিগ্রী প্রয়োগ হয়েছে কারও উপর। নিজের ঢোক গিলার শব্দ নিজের কানে শুনতে পেলাম, পেটও গুড়মুড় করে ডেকে যাচ্ছে; আর আমি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি, “রিলাক্স ম্যান, রিলাক্স”। জীবনে যত দোয়া শিখেছিলাম একে একে সব পড়া শুরু করলাম, আশ্চর্য সবচেয়ে আবশ্যক দোয়া ‘আয়াতুল কুরসী’টাই মনে করতে পারছি না! ওদিকে পাশে বসে আপন মনে বিড়বিড় করছে খাস্তগীর। হঠাৎ অফিসার রোকসানা ড্রয়ার খুলে ছোট পকেট-আয়না বের করে লিপস্টিক ঠিক করতে লেগে গেল! টর্চার কি লিপের মাধ্যমে করেছে না কী? জিহ্বা ছিড়ে ফেলার কথা বলছিল! আতঙ্ক এবার তুঙ্গে আমার, ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করছি আপন মনে; হঠাৎ বাঁ হাতে তুড়ি বাজিয়ে তর্জনীর ইশারায় আমাদের কাছে ডাকে ডিবির এ.এস.পি রোকসানা পারভীন।
- “কি মিশনে খাস্তগীরকে বালিকা স্কুল, মহিলা কলেজ ও লেডিস হোস্টেলে হোস্টেলে পাঠানো হয়েছে?”, কোন ভুমিকা না করে সরাসরি এমন প্রশ্ন! তাও রক্ষে প্রথমেই দু’ঘা লাগিয়ে দেয়নি।
“উদ্দেশ্য কী, শুনি? কোন নাশকতার বা অপহরনের পরিকল্পনা না তো?”।
এখনো কোন সম্মোধনে আসেনি, ভাব বাচ্যে কথা বলছে, মুখের ভাষায়ও বেশ ভদ্রতা ফিরে এসেছে; লক্ষণ ভালো না খারাপ বুঝতে পারছিনা। গলা হালকা খাকাড়ি দিয়ে বললাম, “খাস্তগীর আমার বাল্যবন্ধু, এর বাইরে আর কোন সম্পর্ক নেই। একটু পাগলামি ভাব আছে ছোট বেলা থেকেই। এ ছাড়া আর কোন সমস্যা নেই।
”, গলার স্বর নিজের কানেই কেমন কিম্ভুতকিমাকার লাগছিল!
- কিন্তু ফোনে তো আপনি অন্য রকম কথা বলেছিলেন?
‘আপনি’ সম্মোধন পেয়ে ধরে একটু প্রাণ ফিরে এলো; ফোনে আমি কি ভেবে কি বলতে চেয়েছি সেটা খুলে বললে পরিস্থিতি কি দাঁড়াতে পারে সেটা চিন্তা করে ঐ পথ আর না মাড়িয়ে বললাম, “স্কুল থেকেই অসম্ভব বিজ্ঞানমনষ্ক, সারাক্ষণ বিজ্ঞানের বিভিন্ন থিউরি, সূত্র নিয়ে থাকতে থাকতে মাথার স্ক্রু ঠিলে হয়ে শুধু আলতো করে ঝুলে আছে, যে কোন সময় খসে পড়তে পারে; এমনিতে...”, ওষ্ঠাগ্রে ‘ছেলে’ প্রায় চলে এসেছিল মুহূর্তেই সংশোধন করে বললাম, “এমনিতে মানুষ হিসাবে অসাধারন। কোন স্ক্যান্ডাল নেই, ক্রিমিলান রেকর্ড নেই, পাড়া-প্রতিবেশিরাও ভাল জানে”
- হুমম, আমাদের এমনি ধারনা হয়েছিল। বেশ কয়েকদিন ধরে আমাদের ইনফর্মাররা ওনাকে ফলো করে মেয়েদের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও হোস্টেলে সামনে হাতে এই যন্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে; টেবিলে উপর রাখা ছোট রেডিও মত দেখতে একটা কিছুকে ইঙ্গিত করে বলেন তিনি, আর এখানে ধরে আনার পর থেকে কোন কথাই বলছেন না, শুধু বিড়বিড় করছে আর গো-গো-গো শব্দ করছেন। শেষে উনার মোবাইল ঘেটে আপনার নাম্বার পেয়ে যোগাযোগ করেছি।
“খাস্তগীরের আসলে পুলিশোফোবিয়া আছে।
”, অনেক কষ্টে ঠোঁটের কোণে প্রায় চলে আসা হাসিটা আটকিয়ে বলি। কি কান্ডটাই না ঘটেছিল সেদিন, মনে পড়লে এখনো পেটে খিল লেগে যায়।
- ঠিক আছে, আজকের মত মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি; তবে ভবিষ্যতে চোখে চোখে রাখবেন আপনার এই বন্ধুকে।
ভয়ংকর বিধ্বংসী যন্ত্র সন্দেহে পুলিশ যেটা জব্দ করেছিল, সেটা গুছিয়ে ডিবি কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় তা দূর থেকে রোকসানা পারভীনের দিকে তাক করে খাস্তগীর; একটা লিভার ঘুরিয়ে বাটন চাপ দিতেই টুটুত টুটুত করে বেজে উঠে সেটা মৃদু শব্দ করে, ডিসপ্লেতে ভেসে উঠে “৬ সপ্তাহ”। খাস্তগীর মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলে রোকসানা পারভীন মা হতে চলেছে।
এতক্ষণে তার যন্ত্রের কার্যকারীতা সম্বন্ধে কিছুটা ধারনা পেলাম। ভয়ংকর বিধ্বংসী যন্ত্রই বটে! হারামজাদা রিমোট-প্রেগনেন্সি টেস্টার নিয়ে মেয়েদের কলেজে কলেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কষে লাথ্থি মারার অদম্য ইচ্ছাটাকে চাপা দিয়ে কটমট করে তাকিয়ে বললাম, “তোর মতলবটা কি খুলে বল তো”
কিছুটা অবাক হয়ে মুহূর্তক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে খাস্তগীর, যেন মহা বিরক্ত এমন ভাব করে বলে, “অদ্ভুত তোদের সাধারন জ্ঞান! আশ্চর্য, আমি এই এই যন্ত্র নিয়ে কি করছি এটা এতক্ষণেও বুঝতে পারিস নি, তোদের আসলে ঘাড়ের উপর শুধু এই খুলিটাই আছে, ভিতরটা স্ট্যাডিয়াম। আরে এটা দিয়ে আমি স্টুডেন্ট খুঁজে বেড়াচ্ছি, এটাও এতক্ষণে বুঝতে পারিস নাই!”
এমনভাবে বলল যেন মেয়েদের হলে হলে, স্কুলে কলেজে রিমোট-প্রেগনেন্সি টেস্টার নিয়ে ঘুরে ঘুরে স্টুডেন্ট খুঁজে বেড়ানো খুবই সাধারন ঘটনা, নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার; আশেপাশে অনেকেই এমনি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার চোখের তীব্র ক্রোধকে বাঁহাত হাওয়ায় নাড়িয়ে বাউন্ডারির বাইরে ছুড়ে ফেলে বলল, “বুঝেছি, তোকে প্রেকটিক্যালি দেখাতে হবে, না হলে বুঝতে পারবি না। তবে দোস্ত তোকে কথা দিতে হবে আমার এই আইডিয়া প্যাটেন্ট না করা পর্যন্ত মুখ বন্ধ রাখবি”
রাগ হচ্ছিল ভীষণ, দিনটাই মাটি করে দিয়েছে হতচ্ছড়াটা; পিন্ডি চটকাতে চটকাতে নিজের অজান্তেই কখন যে তার ল্যাব হাউজে হাজির হলাম টেরই পাইনি।
ঢুকতেই বোটকা একটা গন্ধের বিরাশি সিক্কার ঘুষি এসে লাগল নাকে। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কাগজের টুকরো, গুড়ো খাবার, গামছা, টিনের কৌটা, কাঠের তক্তা, আরও কত কী! তিনটি বিশাল আকৃতির কাঁচের ইনকিউবেটর টাইপের যন্ত্রে ঠাসা ঘরটা। তার ভিতরে শ’খানের মত ইঁদুর খাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে, কাঁচের দেয়ালে হাত তুলে অবাক পৃথিবী দেখছে, কয়েকটা আবার ব্যায়াম করছে! চোখ ছানা ভরা হয়ে গেল আমার! হাতের উলটা পিঠ দিয়ে দুই দুইবার চোখ কচলে আবার তাকালাম! ঠিকই দেখছি। ব্যায়াম! বুকডন দিচ্ছে, ছোট আকৃতির ভার উত্তোলন করছে। কয়েকটা আবার ছোট মার্বেল দিয়ে ফুটবলও খেলছে! চোখ তুলে উপরের দিকে তাকালাম, ইনকিউবেটরের মাথায় জ্বলজ্বল করছে, “জিনিয়াস প্রজন্ম”
“কি হচ্ছে এখানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”, হতবিহ্বলতা কাটিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললাম।
- এইজন্যেই তুই কেরানী আর আমি বিজ্ঞানী, তুই বুঝতে পারবি না এটাই স্বাভাবিক, বলেই হো হো হো করে হেসে উঠলো।
খোঁচাটা হজম করে জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে থাকি খাস্তগীরের দিকে। জানি ভেতরে তার পারমানবিক চেইন রিএকশন শুরু হয়ে গেছে সব কিছু খুলে বলার জন্য, দেরী হলে পাকা বাঙ্গির মত ফেটে যেতে পারে যে কোন মুহূর্তে।
- আচ্ছা, তার আগে বল তো এটা কিসে যুগ?
কিসের যুগ? উম! টেকনোলজি? না না, দাঁড়া আরও নির্দিষ্ট করে বললে, এটা কম্পিউটারের যুগ? ইন্টারনেটের যুগ?
- আরে ধুর! তোদের দেখছি সাধারন জ্ঞানটা পর্যন্ত নেই! আরে এটা হল কম্পিটিশনের যুগ। আশেপাশে যেখানে তাকাবি দেখবি কম্পিটিশন আর কম্পিটিশন।
স্কুলে কম্পিটিশন, মাঠে কম্পিটিশন, চাকুরিতে কম্পিটিশন, মিডিয়াতে কম্পিটিশন, গবেষণায় কম্পিটিশন; শুধু কম্পিটিশন আর কম্পিটিশন। আর এই কম্পিটিশনের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা প্রতিদিন দৌড়াচ্ছি নিজেকে যোগ্য থেকে যোগ্যতর করে গড়ে তোলার জন্য। ঠিক কি না বল? জবাবের অপেক্ষায় না থেকে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আমার দিকে, “আচ্ছা বল তো, তুই কোন ক্লাস থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিস?”
যতটুকু মনে আছে একদিন বাবা পাড়ার স্কুলে নিয়ে গিয়ে ক্লাস থ্রী’তে ভর্তি করিয়ে দেয়।
- বিজয়ের হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে খাস্তগীরের। আর এখন দেখ তিন চার বছরের ছোট ছোট শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে পিঠে বড় বড় ব্যাগ ঝুলিয়ে।
তাদের বলা হচ্ছে শিশু-শ্রেণী, তারও আগের শ্রেণীকে বলা হচ্ছে প্লে-গ্রুপ। বাচ্চারা না কী স্কুলে গিয়ে প্লে করবে! আরে প্লে করবে ভাল কথা স্কুলে গিয়ে কেন? স্কুল কি প্লেয়িং এর জায়গা? আসল কথা হচ্ছে কম্পিটিশন, সবই কম্পিটিশনের খেলা। একবার চিন্তার করে দেখ আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন কি আজকালকার বাচ্চাদের মত এত মেধাবী আর এডভান্স ছিলাম?
আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না, ওর কর্মযজ্ঞ দেখে নিউরনে অনুরণন শুরু হয়ে গেছে, “বুঝলাম, কিন্তু তোর পরিকল্পনাটা কি?”
যেন খুব গোপন কথা বলছে এভাবে প্রায় ফিস্ফিস্ করে বলল, “আমি প্লে-গ্রুপের আগের আরও কয়েকটি ক্লাস উদ্ভাবন করেছি। বাচ্চাদের লার্নিং ক্যাপাসিটি কল্পনাতীত, আমাদের বয়স যত বাড়ে অভিজ্ঞতার ঝাপি ভারী হতে থাকে, সেই সাথে কমতে থাকে লার্নিং ক্যাপাসিটি। বলেই সে কাগজ টেনে কি সব আঁকিবুঁকি করতে থাকে, বয়সকে যদি A আর লার্নিং ক্যাপাসিটিকে L ধরি তাহলে সমীকরণটা দাঁড়ায়
A α 1/ L
খুব বুঝতে পেরেছি এমন ভাব নিয়ে মুখটা গম্ভীর করে মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বিজ্ঞের মত বললাম, “ও তাহলে তুই কিন্টার-গার্ডেন স্কুল দিতে চাচ্ছিস? গুড, ভেরি গুড।
সত্যি বলতে কী এই প্রথম তোর কোন পরিকল্পনা আমার পছন্দ হয়েছে। ”
- আশ্চর্য! কাকে কি বোঝাচ্ছি! এত কম ঘিলু নিয়ে চাকুরী করিস কিভাবে? আরে হাদারাম, তোর থেকে তো আমার ঐ ইনকিউবেটরের ইঁদুরগুলো বেশি বুদ্ধিমান! শোন, মেডিক্যাল সাইন্স বলে ১৮ সপ্তাহ পর মায়ের গর্ভে শিশুর শ্রবণশক্তির বিকাশ ঘটে; এই আনুমানিক ৪ মাসের পর থেকে প্রতিমাসকে আমি গর্ভ-১, গর্ভ-২, গর্ভ-৩, গর্ভ-৪, গর্ভ-৫, এভাবে ভাগ করেছি। আর শিশু জন্ম নেয়ার পর থেকে জন্ম-১,জন্ম-২, জন্ম-৩ এভাবে শ্রেণীবিভাগ করেছি। তারপর থেকে আমাদের গতানুগতীক প্লে-গ্রুপ, কেজি ওয়ান, ক্লাস ওয়ান এভাবে চলতে থাকবে। আমি মায়ের গর্ভের শিশুদের জন্য স্কুল খোলার পরিকল্পনা করছি।
আমার স্কুলের শিশুরা বাদবাকী শিশুদের চেয়ে কম করে হলেও ১৫ বছর এগিয়ে থাকবে পড়াশুনায়। তুই চিন্তা করতে পারছিস শিক্ষা খাতে আমি কি বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসছি? ইউনেসস্কোর নোমা লিটারেসি প্রাইজ, সাইন্স প্রাইজ, ক্যালিংগা প্রাইজ এমন কি নোবেলও পেয়ে যেতে পারি।
খাস্তগীরের চোখ চকচক করে উঠে লালায়িত স্বপ্নে, হঠাৎ হাতের মাঝের দুই আঙ্গুল বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে কনিষ্ঠা ও তর্জনি তেড়ছা করে কিম্ভুতকিমাকার ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দুই হাত মাথা কাছে নিয়ে এসে। অবাক হয়ে বললাম, “এটা কি জিনিস?”
- “আরে ছবির জন্য প্রেকটিস পোজ দিচ্ছি; তুই ইচ্ছা করলে এখনি আমার সাথে একটা ছবি তুলে রাখতে পারিস, তোর ভবিষ্যতের রেফারেন্সের জন্য”, বলেই অদ্ভুত ভাবে হাসল সে।
তোর এই এক্সপেরিমেন্ট তো অনেক সময় লেগে যাবে?
- আরে কি বলিস! অলরেডি সব এক্সপেরিমেন্ট শেষ।
বিভিন্ন ধরনের টিচিং মেথড বানিয়ে ফেলেছি। এগুলোকে ক্লাস অনুসারে ভাগ করে ডিজিটাল ফ্রিকোয়েন্সিতে রুপান্তরের কাজ শেষ। এই দেখ, এই ইনকিউবেটরের ইঁদুরগুলো একেবারেই স্বাভাবিক, কোন এক্সপেরিমেন্ট করা হয়নি। এদের নলেজ-গ্রোথ দেখ একদমই সাধারন। আর এই ইনকিউবেটরের ইঁদুরগুলোকে শুধু মাত্র জন্মের পরপরই ডিজিটাল ফ্রিকোয়েন্সিতে টেনিং ক্লাস করানো হয়েছে।
সাধারন ইঁদুরের চেয়ে এদের নলেজ-গ্রোথ অনেক বেশি। এর শেষের এই ইনকিউবেটরের ইঁদুরগুলো মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় মা-ইঁদুরকে ক্লাস করানো হয়েছে। আর এদের নলেজ-গ্রোথ কল্পনাতীত! প্রতিটা ইঁদুরই দারুন মেধাবী!
উপরে তাকিয়ে দেখি শেষ ইনকিউবেটরের উপর লাল সাইনবোর্ড জ্বলজ্বল করছে, “জিনিয়াস প্রজন্ম”। আমার গাঁ গুলিয়ে উঠলো। এগিয়ে থাকার প্রতিযোগীতার নামে আমাদের শিশুদের নামিয়ে দিয়েছে ভয়ংকর অমানবিক এক যুদ্ধে।
নষ্ট করে দিচ্ছি তাদের শৈশব অসম বোঝা চাপিয়ে দিয়ে, শৈশবের দূরন্তপনা জলাঞ্জলি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিক্ষকদের দ্বার থেকে দ্বারে! আর এই পাগল এখন এক না কয়েকশ ধাপ এগিয়ে নষ্ট করার প্লান করছে সদ্যভুমিষ্ট শিশুর জীবন! নাহ, এতো গর্ভবতী মায়েদেরও নামিয়ে দিচ্ছে এই প্রতিযোগীতায়!
- “দোস্ত, আগামী ২০/২৫ বছরের মধ্যে আমি বাংলাদেশের সব মানুষরে এক্কেবারে ‘জিনিয়াস’ বানায়া ফালামু। ”, আনন্দের অতিশয্যে ভাষার খেই হারিয়ে ফেলেছে মনে হল খাস্তগীর।
আমার চোখের ভাসছে গর্ভবতী মায়েরা দলে দলে খাস্তগীরের পাঠশালায় আসছে, আর ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লাস-থারাপি নিচ্ছে; উফ, আমি আর চিন্তা করতে পারছি না। খাস্তগীরের কাছ থেকে মোবাইলটা চেয়ে নিয়ে আমার নাম্বারটা ডিলিট করে বললাম, “খবরদার আজকের পর থেকে আমার সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না। ”, বলেই হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে যাই।
পেছেনে খাস্তগীর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে; হয়ত ভাবছে, “আরে, আমি সারা দেশের মানুষকে জিনিয়াস বানানোর পরিকল্পনা করছি এটা তো খুশি হওয়ার কথা, রাগ করার কি হলো! গভীর কোন ষড়যন্ত্র না তো?”
তিন.
অনেক দিন খাস্তগীরের সাথে কোন যোগাযোগ নেই, মাঝে বেশ কিছুদিন বউকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বলে পাগলটার কথা ভুলেই ছিলাম। ডাক্তার বলেছিল প্রথম তিনমাস ক্রিটিক্যাল, তারপর আর তেমন দূশ্চিন্তা না করলেও চলবে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বউকে সাথে করে ডাক্তারের চেম্বারে এসেছি, রুটিন চেকাপে। ওয়েটিং রুমে বসে ঝিমুচ্ছি বউ এর গুতো খেয়ে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, “কি হয়েছে, শান্তিতে একটু ঝিমুতেও দিবে না!”।
বউ একটা লিফলেট এগিয়ে দিয়ে মুচকি মুচকি আসতে থাকল।
পাঠশালা - “ভিশন ২০৪০”
*আপনি কি চান আপনার অনাগত সন্তান জিনিয়াস হয়ে জন্মাক?
*আপনি কি চান আপনার অনাগত সন্তান হয়ে উঠুক নিউটন,
আইনস্টাইন কিংবা হকিং এর উত্তরসূরী?
*আপনি কি চান আপনার অনাগত সন্তান হয়ে উঠুক বিশ্বের অন্যতম সফল সেলেব্রেটি?
*আপনি কি চান আপনার অনাগত সন্তান হয়ে উঠুক ব্রায়ান লারা, শচীন, ব্র্যাডম্যানের কিংবা মুরালীর আতঙ্ক?
তাহলে আমাকেই খুজঁছেন আপনি।
তারপর নিচে যোগাযোগের ঠিকানা। কোন নাম নেই শুধু একটি ইমেইল এড্রেস আর একটা মোবাইল নাম্বার। লিফলেটের চার দিকে বিভিন্ন যন্ত্রের ছবি, গাণিতিক সমীকরন E=mc2 এটা শুধু চিনতে পারলাম, আর কয়েকজন চুল বড় পাগলাটের বৈজ্ঞানীকের ছবি। তবে আমার বুঝতে আর বাকি থাকলো না যে এটা খাস্তগীরের কাজ।
বউকে দেখলাম খুব উত্তেজিত হয়ে বলছে, “এই নাম্বারটা মোবাইলে সেভ করে রাখ, আজই ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার সময় ঐখানে যোগাযোগ করে যাব। ”
উপায় না দেখে একে একে বউকে সব কিছু খুলে বলছি, হঠাৎ পিছন থেকে ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি মেরে বাজখাই গলায় কে যেন বলে উঠল, “কিরে, শালা! খুব দূর্নাম করছিস ভাবীর কাছে আমার!”
চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে বললাম, আরে তুই এখানে?
- আরে আমি তো এখানেই থাকব! আগের বার তো মহিলা স্কুল, কলেজে ঘুরে বেড়িয়েছি সেটা ছিল বিশাল বড় ভুল। আসলে আমার উচিৎ ছিল গাইনি ডাক্তারদের চেম্বারে চেম্বারে ঘুরা!”
হুম বুঝলাম, এখন তোর বেশ বুদ্ধির পাখা গজিয়েছে। পাঠশালাও শুরু করে দিয়েছিস দেখছি?
- আরে নাহ, এখনও খুলতে পারিনি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই খুলে ফেলব, এখন আপাতত ছাত্র খুঁব্জে বেড়াচ্ছি।
স্কুলের নাম “পাঠশালার ভিশন ২০৪০” কেন?
- আরে এটা বুঝিস নি? গলাটা একটু নামিয়ে বলল, “আমি ২০৪০ সালে মধ্যে পরবর্তী প্রজন্মকে জিনিয়াসে রুপান্তরিত করব। যদি ৪০ সালের মধ্যে না পারি তাহলে ৮০ সালের মধ্যে হয়ে যাবে, সেইক্ষেত্রে নামও চেঞ্জ করতে হবে না। সবাই বুঝবে সালটা ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। ”, বলেই চক্রান্তকারীর মত একচোখ টিপে কি বুঝাতে চাইল তা আমার বোধগম্য হয়নি।
যদিও জানি যেকোন সময় সবকিছু বাদ দিয়ে খাস্তগীর আবার নতুন কোন যুগান্তকারী পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে, তবু কোন প্রভাবক দিয়ে তার এই ‘ভীষণ’-২০৪০” পরিকল্পনা ভন্ডুল করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
মৃদু কাশি দিয়ে গলাটা পরিস্কার করে বললাম, “দোস্ত তুই তো এই পাঠশালা শুরুই করতে পারবি না”
- কেন! কেন? কিছুটা অবাক হয়ে চোখ পিটপিট করে তাকায় খাস্তগীর।
প্রথমত, যেহেতু স্কুল খুলবি তাই প্রথমেই তোকে “শিক্ষামন্ত্রনালয়” থেকে অনুমতি নিতে হবে, তারপর যেহেতু সদ্য ভুমিষ্ট শিশুদের নিয়ে স্কুল তাই “নারী ও শিশু মন্ত্রনালয়” থেকে অনুমতি নিতে হবে, যেহেতু গর্ভবতী মায়েরা স্কুলে ক্লাস করবে তাই “স্বাস্থমন্ত্রনালয়” থেকে অনুমতি নিতে হবে, যেহেতু মানব কল্যাণ জড়িত সেহেতু “সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয়” এর অনুমতি নিতে হবে, যেহেতু বিজ্ঞান ও গবেষণা জড়িত তাই “বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়” এর অনুমতি নিতে হবে, এভাবে একে একে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, কৃষি মন্ত্রনালয়, অর্থ মন্ত্রনালয়, ধর্ম মন্ত্রনালয়, ভূমি মন্ত্রনালয়; কম করে হলেও পঞ্চাশ ষাটটা মন্ত্রনালয়ের অনুমতি লাগবে শুধু মাত্র শুরু করতেই। তারপর কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি আদালতে রীট করে বসে তাহলে জেলা কোর্ট, জর্জকোর্ট, হাই কোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, আপিল বিভাগ তারপর আবার রাইট টু আপি, লেফট টু আপিল; দুনিয়ার হেপা। এগুলো পার হতে হতে তোর দুই পা না হোক, এক পা কবরে চলে যাবে নিশ্চিত। আবার যেকোন সময় রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলায়ও ফেঁসে যেতে পারিস।
নিদের পক্ষে আদালত অবমাননার মামলায় যে পড়বি সেটা মাথায় রেখেই কাজে নামা উচিৎ। আর যেকোন সময় সপ্তাখানেকের জন্য রিমান্ড! আর রোকসানা পারভীনের কথা মনে আছে তো?
- তাহলে কি করতে বলিস? কণ্ঠে কিছুটা উৎকন্ঠা ঝরে পরে তার। মারটা জায়গা মতই পড়েছে। তার পুলিশোফোবিয়া যে এভাবে ম্যাজিকের মত কাজ করবে আমি নিজেও অতোটা আশাবাদী ছিলাম না।
এইসব পাগলামো বাদ দিয়ে সত্যিকারের জনহিতকর কোন কাজে হাত দে, তোরও ভালো লাগবে দেশেরও উপকার হবে।
ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল আমাদের খাস্তগীরের। তার এই হাসির সাথে আমি পরিচিত, এ যাত্রায় মনে হয়ে সমগ্র জাতিকে জিনিয়াস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেই ফেললাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।