বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন আজ ১১ অক্টোবর ৭১ বছরে পা রাখলেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বলিউডের অনেক তারকা হারিয়ে গেলেও, এ ক্ষেত্রে বিরল নজিরই গড়েছেন অমিতাভ। চার দশকের বেশি সময় ধরে বলিউডে তাঁর রাজত্ব। অনেক আগেই জনপ্রিয়তার চূড়া স্পর্শ করেছেন বর্ষীয়ান এ তারকা। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিলেও আজও তাঁর জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাটা পড়েনি।
বরং দিনকে দিন বেড়েই চলেছে তাঁর জনপ্রিয়তা। ৭১তম জন্মদিনে অমিতাভ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, শরীর যতদিন সাঁয় দেবে, ততদিন পর্যন্ত কাজ করে যাবেন তিনি।
বড় পর্দার পাশাপাশি ছোট পর্দা এবং পণ্যের দূতিয়ালিতেও শক্ত একটি অবস্থান ধরে রেখেছেন অমিতাভ। তাঁর অনবদ্য উপস্থাপনার কল্যাণে ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ অনুষ্ঠানটি বছরের পর বছর ধরে ভারতের অন্যতম সেরা রিয়েলিটি শো হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তিনি দেড় শতাধিক ছবি উপহার দিয়েছেন।
এখন পর্যন্ত বহু ধরনের চরিত্রে দেখা গেছে অমিতাভকে। এখনো প্রতিনিয়ত তিনি চরিত্র নিয়ে নিরীক্ষা করে চলেছেন। চরিত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বয়সের সঙ্গে মানানসই চরিত্রের ওপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন তিনি।
আজও কোনো ছবিতে অমিতাভের অন্তর্ভুক্তি ছবিটির সাফল্যের সম্ভাবনা বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। এজন্য বিশাল অঙ্কের পারিশ্রমিক দেওয়ার পাশাপাশি যেকোনো উপায়ে অমিতাভকে পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন নির্মাতারা।
অসাধারণ অভিনয়শৈলী, ভরাট কণ্ঠ, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মানসিকতা এবং সর্বোপরি তীক্ষ মেধার সর্বোত্তম ব্যবহারই অমিতাভকে সাফল্যের চূড়া থেকে ছিটকে পড়তে দেয়নি। দশকের পর দশক ধরে অগণিত ভক্তের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চলেছেন বলিউডের এই ‘শাহেনশাহ’ তারকা।
জন্মদিন উপলক্ষে মিডিয়ার সঙ্গে আলাপচারিতার সময় অমিতাভ বলেন, ‘সব সময় আমি প্রত্যাশা করি, প্রতিদিন চ্যালেঞ্জিং কিছু করার সুযোগ আসুক আমার জীবনে। শরীর যতদিন সাঁয় দেবে, ততদিন পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই আমি। ’
এবারের জন্মদিনে দুই বছর বয়সী নাতনি আরাধ্য বচ্চনের মুখে ‘শুভ জন্মদিন’ শব্দটি শুনে অভিভূত হয়ে যান অমিতাভ।
এ প্রসঙ্গে অমিতাভ তাঁর ব্লগে লিখেছেন, ‘ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১২টা। পরিবারের সদস্য ও কাছের কয়েকজন মানুষ আমায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল। ছোট্ট আরাধ্যর কণ্ঠে ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে ‘‘হ্যাপি বার্থডে” গানটি শুনে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। ছোট্ট এই মুহূর্তটি আমার জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্তে পরিণত হলো, আমার জন্মদিনকে সার্থক করে তুলল। ’ এক খবরে এমনটিই জানিয়েছে জিনিউজ।
আগের তুলনায় সময় অনেক দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার উপলব্ধির কথা জানিয়ে অমিতাভ তাঁর ব্লগে লিখেছেন, ‘এখন আমার বয়স ৭১। কিন্তু গত বছর বা মাত্র এক দিন আগেই আমার বয়স ছিল ৭০। মনে হচ্ছে, সময় যেন আগের চেয়ে অনেক দ্রুত বয়ে চলেছে। আমি জানি, একটা বয়সে পৌঁছে আমাকে হাল ছেড়ে দিতে হবে। প্রকৃতির নিয়মে সবার জীবনেই সেই মুহূর্ত আসবে।
আমি সানন্দেই এই সত্যটাকে মেনে নিয়েছি। ’
১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। তাঁর বাবা প্রখ্যাত কবি হরিবংশ রাই বচ্চন এবং মা তেজি বচ্চন। ১৯৬৯ সালে ‘সাত হিন্দুস্তানি’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে যাত্রা শুরু করেন অমিতাভ। আজ কোটি কোটি রুপির মালিক হলেও, জীবনের প্রথম ওই সাদা-কালো ছবিটিতে অভিনয়ের বিনিময়ে তিনি পেয়েছিলেন মাত্র এক হাজার রুপি।
পরবর্তী সময়ে ‘আনন্দ’, ‘গুড্ডি’, ‘বাবুর্চি’, ‘জঞ্জির’, ‘সওদাগর’, ‘দিওয়ার’, ‘শোলে’, ‘দো আনজানে’, ‘অমর আকবর অ্যান্থনি’, ‘ডন’, ‘সুহাগ’, ‘লাওয়ারিশ’, ‘সিলসিলা’, ‘শাহেনশাহ’, ‘অগ্নিপথ’, ‘বুম’, ‘বাগবান’, ‘ব্ল্যাক’, ‘সরকার’, ‘নিঃশব্দ’, ‘পা’, ‘অরক্ষণ’, ‘সত্যাগ্রহ’সহ অসংখ্য ব্যবসা সফল ছবি উপহার দিয়েছেন বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম সফল এ অভিনেতা।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার, আইফা, স্টারডাস্ট, জি সিনে, পিপলস চয়েজসহ অসংখ্য পুরস্কার ঘরে তুলেছেন গুণী এ অভিনয়শিল্পী।
নব্বইয়ের দশকে চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে মন্দা দেখা দিলে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অমিতাভ। তখন বড় পর্দা ছেড়ে ছোট পর্দায় মনোযোগী হন তিনি। ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে তিনি ছোট পর্দায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান।
অথচ শুরুর দিকে কাজটি করতে অনেকেই বাধা দিয়েছিলেন তাঁকে। কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করে কেবল তাঁর অর্থনৈতিক দৈন্যদশাই ঘোচাননি, দর্শকদের মাঝেও তাঁকে নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।
ছোট পর্দায় সাফল্যের রেশ ধরে বলিউডে সাফল্যের সঙ্গে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেন অমিতাভ। ‘মোহাব্বাতে’, ‘কাভি খুশি কাভি গাম’, ‘বাগবান’সহ একের পর এক বড় বাজেটের ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ আসতে থাকে তাঁর কাছে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
প্রতিটি ছবিতে অমিতাভ যেন নিজেকে ভেঙে নতুনরূপে গড়েছেন। তাঁর বহুমাত্রিক অভিনয় প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন অগণিত দর্শক। প্রশংসা কুড়িয়েছেন চলচ্চিত্র সমালোচকসহ বিভিন্ন মহলের।
অমিতাভের সাফল্যযাত্রাটা মোটেও সহজ ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাফল্যের শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছেন তিনি।
কলকাতার একটি জাহাজ কোম্পানিতে চাকরির মাধ্যমে পেশাজীবন শুরু করেছিলেন অমিতাভ। তাঁর প্রথম বেতন ছিল মাত্র ৫০০ রুপি। অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য একটা সময়ে চাকরি ছেড়ে মুম্বাই শহরে পাড়ি জমান অমিতাভ। শুরুর দিকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। কয়েক রাত মুম্বাইয়ের মেরিন ড্রাইভ এলাকায় বেঞ্চে শুয়ে রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন অমিতাভের মা তেজি বচ্চনের বান্ধবী। অমিতাভ তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ‘রেশম অর শেরা’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর কারণেই। ছবিটিতে অমিতাভকে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে নির্মাতাদের একটি চিঠি লিখেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
ভরাট কণ্ঠের জন্য সুপরিচিত অমিতাভ বচ্চন। অথচ এই ভরাট কণ্ঠের কারণেই অল ইন্ডিয়া রেডিওর অডিশন পর্ব থেকে দু-দুবার বাদ পড়েছিলেন অমিতাভ।
একটা সময়ে অ্যাজমা এবং মায়াস্থেনিয়া গ্রেভিস নামের বিরল এক ধরনের পেশির রোগে ভুগেছেন অমিতাভ। স্বাস্থ্যসচেতনতার জন্য সুপরিচিত তিনি। সব সময় চেষ্টা করেন ঘরের রান্না করা খাবার খেতে। পরিমিত পরিমাণে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণেই অভ্যস্ত তিনি। তিনি সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী।
রিচার্ড গিয়ার, ডাস্টিন হপম্যান, ব্রায়ান অ্যাডামস এবং পল ম্যাকার্টনির মতো তারকাদের পেছনে ফেলে সেরা নিরামিষভোজী তারকা নির্বাচিত হয়েছিলেন অমিতাভ।
অমিতাভ বচ্চন বই পড়তে এবং লেখালেখি করতে দারুণ পছন্দ করেন। হরেক রকম কলম সংগ্রহ করা তাঁর শখ। তাঁর সংগ্রহে হাজারেরও বেশি কলম আছে। জার্মানির ঐতিহ্যবাহী কলম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মন্ট ব্ল্যাঙ্ক প্রতিবছর অমিতাভের জন্মদিনে কলম উপহার দেয়।
ঘড়ি, গাড়ি ও স্যুটের প্রতি অমিতাভের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। এক ডজনেরও বেশি গাড়ি রয়েছে তাঁর। অমিতাভের একটি গাড়িতে রেডিয়াল টায়ার লাগানো আছে। সাধারণত ফর্মুলা ওয়ান রেসের গাড়িতে এই টায়ার থাকে। প্রতিটি টায়ারের দাম আড়াই লাখ রুপি।
অমিতাভের সংগ্রহে এত বেশি ঘড়ি আছে যে, একটি ঘড়ি একবারের বেশি পরেন না তিনি।
নিজের জীবনের আফসোসের কথা জানাতে গিয়ে একবার অমিতাভ বলেছিলেন, ‘আমার সন্তানদের বেড়ে ওঠার সময়টাতে আমি তাঁদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারিনি, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস। অভিষেক ও শ্বেতার শৈশবে আমি কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত থেকেছি। আমি যখন কাজের জন্য ঘর থেকে বের হতাম, তখন তারা ঘুমাত। আবার কাজ শেষে বাড়ি ফিরে তাঁদের ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেতাম।
এমনকি তাঁদের স্কুলেও যেতে পারিনি আমি। অবশ্য তারাই আমাকে বারন করেছিল। কারণ আমি তাদের স্কুলে গেলে প্রচুর মানুষের সমাগম হতো এবং হট্টগোল পাকিয়ে যেত। ’
মিডিয়ার মুখোমুখি হলে সব সময় আলোকচিত্রীসহ নিজের একটি দল সঙ্গে রাখেন অমিতাভ। তাঁর কোনো কথা যাতে বিকৃতভাবে প্রকাশিত হতে না পারে, তার ব্যবস্থা করে ওই দল।
কেবল অমিতাভের নিজস্ব আলোকচিত্রীর তোলা ছবিই প্রকাশ করা হয়। ছবিগুলো অমিতাভ তাঁর সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার ওয়েবসাইটে পোস্ট করেন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।