জবাব এভাবেই দিতে হয়!
যখন ব্যাটিংয়ে নামলেন, বাংলাদেশ ৯২ রানে পিছিয়ে। হেরে যাওয়ার আশঙ্কার স্রোত তখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়েই বহমান। রবিউল ইসলাম ২৯ রানে অপরাজিত সোহাগ গাজীকে বললেন, ‘লাস্ট উইকেটে ওরা যেমন আমাদের খাটাইছে, আমরাও ওদের খাটামু। ’
খাটালেনও। নিউজিল্যান্ড শেষ উইকেটে যে যন্ত্রণা উপহার দিয়েছিল, বাংলাদেশ তা ফেরত দিল নবম উইকেটে।
ওয়াটলিং-বোল্টের ১২৭ রানের জবাবে সোহাগ-রবিউলের ১০৫।
আগের দিনই গরমে-আর্দ্রতায় অবস্থা কাহিল নিউজিল্যান্ড দলের। মাঠ থেকে ফেরার সময় হাবিবুল বাশার বলছিলেন, ‘কাল লাঞ্চ পর্যন্ত ওদের খাটাতে পারলে বড় আনন্দ পেতাম। ’ চতুর্থ দিন লাঞ্চ পর্যন্ত ব্যাটিং করতে পারলে মোটামুটি ঝুঁকিমুক্ত। এটি একটা কারণ।
আরেকটি কারণও এর চেয়ে কম বড় নয়। প্রতিপক্ষকে এক শ/ দেড় শ ওভার ফিল্ডিং করতে দেখার বিমলানন্দ। ‘ওরা যেমন খাটাইছে’ ব্যাপারটা এখানেও থাকছে। যখন খেলতেন, টেস্ট ক্রিকেট যে এমন যন্ত্রণার সঙ্গে হাবিবুলকে নিয়মিতই পরিচয় করিয়ে দিত।
রবিউল একটা ব্যক্তিগত লক্ষ্য নিয়েও নেমেছিলেন।
আগের টেস্ট সর্বোচ্চ ২৪ রানকে টপকে যাওয়া। গত জাতীয় লিগে প্রতিটি ইনিংসেই আগের সর্বোচ্চ স্কোরকে পেরিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে নামতেন। দু-তিনবার তাতে সফলও। কাল ৯ রান বেশি করে যখন আউট হলেন, তখন অবশ্য লক্ষ্যপূরণের আনন্দের চেয়ে বেশি আত্মদহন। সোহাগ গাজীকে যে ৯৬ রানে রেখে এসেছেন।
যদি সেঞ্চুরিটা না হয়!
রুবেল হোসেনের সঙ্গতে সেটি হলো। সোহাগ গাজী চিৎকার-টিৎকার করে উদ্যাপনটাও করলেন দেখার মতো। রবিউলের দাবি, তাঁর খুশিটা একটুও কম নয়। বুক থেকে যে পাথর নেমে গেছে!
জবাবের কথা বলছিলাম। এখানেও তা থাকল।
নিউজিল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে আট নম্বর ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি। বাংলাদেশেরও তা-ই। শুধু এই দুই দলের দ্বৈরথের কথা যদি ধরেন, তাহলে পরপর দুই টেস্টে বাংলাদেশের আট নম্বর ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি। পৌনে তিন বছর আগে হ্যামিল্টনে আট নম্বরে নেমে যিনি সেঞ্চুরি করেছিলেন, তিনি এই টেস্টের দর্শক। মাহমুদউল্লাহর সেই স্মৃতি মনে পড়ারই কথা।
সঙ্গে হয়তো এটাও মনে পড়েছে যে, তাঁর ওই সেঞ্চুরিতে ৪০৮ রান করার পরও বাংলাদেশ হেরেছিল।
এখানে ম্যাচের যে গতিপ্রকৃতি, তাতে হ্যামিল্টনের চেয়ে সেন্ট লুসিয়ার সঙ্গেই এটির মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আট নম্বরে বাংলাদেশের আর যে একটি সেঞ্চুরি, সেটি উপহার দিয়েছিল জয়ের সমান এক ড্র। ২০০৪ সালে সেন্ট লুসিয়ায় খালেদ মাসুদের সেই সেঞ্চুরিটি অবশ্য দ্বিতীয় ইনিংসে। সেই টেস্টে অভাবিত সব ঘটনা ঘটেছিল।
প্রথম ইনিংসে ৯ নম্বরে নেমে সেঞ্চুরি করে বসেছিলেন মোহাম্মদ রফিক। কোচ ডেভ হোয়াটমোর তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘তুমি জানো, কী কাণ্ড করে ফেলেছ! আমারও তো টেস্ট সেঞ্চুরি নেই!’
এখন যিনি কোচ, সেই শেন জার্গেনসেনও সোহাগ গাজীকে একই কথা বলতে পারেন। টেস্ট সেঞ্চুরি অবশ্য কখনো জার্গেনসেনের স্বপ্নেও দেখা দেয়নি। নির্ভেজাল পেসার ছিলেন, এটা একটা কারণ। এর চেয়েও বড় কারণ, কখনো টেস্টই খেলেননি।
সোহাগের সেঞ্চুরিতে জার্গেনসেনের চেয়েও বেশি খুশি হওয়ার কথা কোরি রিচার্ডের। বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচ হিসেবে বাড়তি দায়িত্ব পালন করছেন, এ জন্য নয়। সোহাগ গাজীর ব্যাটিং সেই শুরু থেকেই মন কেড়েছে তাঁর। রিচার্ডের বদ্ধমূল ধারণা, বংশলতিকা ধরে পিছিয়ে গেলে সোহাগের কোনো না কোনো পূর্বপুরুষের ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাবে। ব্যাট হাতে সোহাগ যে তাঁকে সহজাত ক্যারিবীয় ব্যাটিংয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সোহাগের এক ম্যাচে সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিক আছে, স্যার গ্যারি সোবার্সেরও যা নেই। টেস্টে অবশ্য আগের ১১ ইনিংসে সর্বোচ্চ ছিল ৩২। সেঞ্চুরি তো বটেই, হাফ সেঞ্চুরিও তাই তাঁর কাছে নতুন। তবে স্কোরবোর্ডে বাংলাদেশের ‘৫০০’ একদমই নয়। সোহাগই তো বাংলাদেশকে ৫০০ করতে শেখালেন! ৮০তম টেস্টে মাত্র তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের পাঁচ শ ছাড়ানো স্কোর।
তিনটিই গত ১১ মাস ও ৭ টেস্টের মধ্যে। এটা সোহাগ গাজীর টেস্ট ক্যারিয়ারেও!
পাঁচ শ পেরোনোই যে টেস্টে হার বাঁচানোর নিশ্চয়তা নয়, এটি অভিষেকেই জেনে গিয়েছেন। গত নভেম্বরে ঢাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৫৬ করেও হেরেছিল বাংলাদেশ। এখানে মনে হয় না সেই ভয় আছে।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশের ৩২ রানের লিডেই তা প্রায় কেটে গেছে।
‘প্রায়’টাকেও দূর করে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন পিটার ফুলটন এবং বৃষ্টি। এই ম্যাচে জেতার সম্ভাবনা তৈরি করতে দ্বিতীয় ইনিংসে একটু ঝোড়ো ব্যাটিং করতে হতো। অথচ ব্যাটিং-স্বর্গ উইকেটে ফুলটন সাহেবের অপরাজিত ৪৪ রান ১৩৬ বল খেলে! ওপেনিংয়ে তাঁর সঙ্গী হামিশ রাদারফোর্ডের ব্যাটিংয়ে অবশ্য ম্যাচের দাবি মেটানোর চেষ্টা ছিল। ৪৫ বলে ৩২ করে তিনি বিদায় নিয়েছেন।
বিদায় নিয়েছেন খুবই দুঃখভরে।
কারণ, গত মার্চে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ২১৭ বলে ১৭১ রান করে টেস্ট ক্রিকেটে সাড়া জাগানো আবির্ভাবের পর ১০ ইনিংসে কোনো ফিফটি পর্যন্ত নেই। ওই আবির্ভাবটা ছিল বাবার পুরো বিপরীত। কেন রাদারফোর্ডের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ‘পেয়ার’ দিয়ে। ১৯৮৪ সালে চার প্রমত্ত ফাস্ট বোলারের ওই ওয়েস্ট ইন্ডিজ একেবারে এলোমেলো করে দিয়েছিল ১৯ বছর বয়সী তরুণের মনোজগৎ। ৭ ইনিংসে করেছিলেন মাত্র ১২ রান।
সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতির কারণেই আত্মজীবনীর অদ্ভুত এক নাম দিয়েছেন—অ্যা হেল অব অ্যা ওয়ে টু মেক লিভিং। যেটির আক্ষরিক অনুবাদ হয়, জীবিকা নির্বাহের এক নারকীয় উপায়!
ক্রিকেট ছাড়ার পর এখন জীবিকা বেটিং সংস্থার বড় কর্তা। অনেক বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় কাটিয়ে সম্প্রতি ফিরেছেন নিউজিল্যান্ডে। সেই কেন রাদারফোর্ড এই টেস্টে ড্র ছাড়া আর কিছুর পক্ষে বাজি ধরার মতো কাউকে পাবেন বলে মনে হয় না। এমনিতেই হয়তো ড্র হতো।
সেটি আরও নিশ্চিত করে দিয়েছে শেষ বিকেলের এক পশলা বৃষ্টিতে এক ঘণ্টা আগেই চতুর্থ দিনের খেলা শেষ হয়ে যাওয়া। সাগরে তোলপাড় তুলে উপকূলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকা ফাইলিন চট্টগ্রাম থেকে তখনো ৬০০ কিলোমিটার মতো দূরে। আজ দূরত্ব যত কমবে, ততই বাড়বে বৃষ্টির সম্ভাবনাও।
টেস্ট সিরিজের মীমাংসাটা মনে হচ্ছে ঢাকাতেই হবে।
নিউজিল্যান্ড: ৪৭৯ ও ১১৭/১
বাংলাদেশ: ১ম ইনিংস: ৫০১
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।