হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর নিজের প্রাণাধিক পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর রাহে কোরবানির সর্বোচ্চ ত্যাগ শিকারের স্মরণে পবিত্র ঈদুল আজহার উৎসব পালিত হয় মুসলিম বিশ্বে। পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম ও সমাজে স্ব স্ব সংস্কৃতি ও অবকাঠামো অবয়বে উদযাপিত উৎসবাদিতে আর্থিক কার্যকলাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের সৃজনশীল প্রেরণা, সখ্য, সৌহার্দ্য প্রকাশের অভিষেক ঘটে থাকে। নানান উপায় উপলক্ষে সম্প্রীতি বোধের বিকাশ লাভ ঘটে থাকে, অবনিবনার পরিবর্তে বন্ধন, মতপার্থক্যের অবসানে সমঝোতার পরিবেশ সৃজিত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজায় আত্দশুদ্ধির আনন্দের, অপয়া অশুর সত্তার সংহার, সংবেদনশীলতার শুভ উদ্বোধন উপলক্ষে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোতে প্রাণচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়েছে। আসন্ন খ্রিস্টীয় বড়দিনের উৎসব সাংবছরের সব বিভ্রান্তি বিবাদ-বিসংবাদ ভুলে অনাবিল আনন্দ আচার অনুষ্ঠানে নিবেদিত হওয়ার সুযোগ সমুপস্থিত হবে।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সৎ চিন্তা, সৎ ধ্যান ও অহিংস অভেদ বুদ্ধি বিবেচনার বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের পরিপালনীয় নির্বাণ অনুষ্ঠানাদিতে। উৎসবের সব আয়োজন আপ্যায়নের মর্মবাণীই হলো সামাজিক সমতা-সখ্য বৃদ্ধি এবং সম্পদ, সুযোগ ও সৌভাগ্যকে বণ্টন ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা, ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে যা নিয়ামক ভূমিকা পালন করে।
আত্দশুদ্ধির জন্য উৎসর্গ বা সংহার প্রকৃত প্রস্তাবে খোদাভীতি ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় হিসেবে জীবে প্রেম বা দয়া ও সেবার প্রেরণাপ্রদায়ক হিসেবে প্রতিভাত হয়। ঈদুল আজহার এই উৎসব হজ পালন ও পশু কোরবানি সূত্রে সমাজ এবং অর্থনীতিতে বিশেষ তাৎপর্যবাহী প্রভাব ও কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
ঈদুল আজহা উদযাপনে অর্থনীতিতে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ, শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে।
এ উৎসবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ব্যাপক আর্থিক লেনদেনসহ বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় যা গোটা অর্থনীতি তথা দেশজ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় শনাক্তযোগ্য প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
পশু কোরবানি উপলক্ষে জাতীয় অর্থনীতিতে এক ব্যাপক আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৭৮ লাখ গরু ও খাসি কোরবানি হয়েছিল। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) ধারণা, এবার ৩০ লাখ গরু ও ৫৫ লাখ খাসি কোরবানি হবে। গরুপ্রতি গড় মূল্য ৩০ হাজার টাকা দাম ধরলে এই ৩০ লাখ গরু বাবদ লেনদেন হবে ৯ হাজার কোটি টাকা এবং ৫৫ লাখ খাসি (গড়ে ১৫০০ টাকা দরে) ৮২৫ কোটি টাকা অর্থাৎ পশু কোরবানিতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে।
৮৫ লাখ কোরবানির পশুর মধ্যে প্রায় ৪৫ লাখ পশু (গরু ২০ লাখ, খাসি-ভেড়া ২৫ লাখ) আমদানি হবে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। ভারতীয় সূত্র থেকেই জানা গেছে, প্রায় ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার রপ্তানি তাদের এবারের প্রত্যাশা। এর একটা বড় অংশ অবশ্য চোরাইপথে বা পদ্ধতিতে আদান-প্রদান হবে, যার দরুন পশুর সংখ্যা ও টাকার পরিমাণ অবশ্যই অনুমাননির্ভর। যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন বাংলাদেশের প্রায় ৫ হাজার কোটির টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবে এ খাতে। ২০ লাখ গরু আমদানির জন্য বাংলাদেশের শুল্ক রাজস্ব (গরুপ্রতি ৫০০ টাকা হিসাবে) ১০০ কোটি টাকা অর্জিত হওয়ার কথা।
কোরবানিকৃত পশুর সরবরাহ ও কেনাবেচার শুমার ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় চাঁদা, টোল, বকশিশ, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, হাসিল, পশুর হাট ইজারা, চাঁদিয়া, বাঁশ-খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবার, পশু কোরবানি ও কসাইয়ের খরচ এমনকি পশুর সাজগোজ বাবদও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতবদল হয়ে থাকে অর্থাৎ অর্থনীতিতে ফর্মাল-ইনফর্মাল ওয়েতে আর্থিক লেনদেন বা মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের কর্মযোজনা সৃষ্টি হয়। আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্যে, পাদুকা ও পোশাক শিল্পে, হস্তশিল্পে এক অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ চামড়া সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে এক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রতিবছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বিশেষ ঋণ দিয়ে থাকে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৮০-১০০ কোটি টাকা।
চামড়া নিম্ন দামে পাচার হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেটের কবল থেকে চামড়া ব্যবসাকে উদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই। পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনে প্রকাশ প্রতিবেশী দেশ থেকে বাকিতে গরু সরবরাহ করা হয় কম দামে কাঁচা চামড়া পাচারের প্রত্যাশায়। সেই চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করে বেশি দামে বিদেশে রপ্তানির মুনাফা অর্জন করে তারা। দেশে নিজেদের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ এবং উপযুক্ত মূল্যে তা রপ্তানির প্রণোদনা সৃষ্টি করেই এ পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি ঘটতে পারে।
লবণ চামড়া সংরক্ষণের একটি অন্যতম উপাদান। গত বছর সরকারকে ৪০ হাজার টন লবণ শুল্কমুক্ত আমদানির উদ্যোগ নিতে হয়েছিল যাতে সিন্ডিকেট করে লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয়। মাংস রান্নার কাজে ব্যবহৃত মসলা বাবদ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে এ সময়ে। মসলার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে ঈদ উদযাপনের ব্যয় ব্যবস্থাপনাকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করায়। সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, শুধু মিয়ানমার থেকে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার মসলা অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে।
ঈদ উপলক্ষে পরিবহন ব্যবস্থা বা ব্যবসায় ব্যাপক কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়। শহরের মানুষ আপনজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামে ছোটে। এক মাস আগে থেকে ট্রেন বাস লঞ্চের টিকিট বিক্রির তোড়জোড় দেখে বোঝা যায়, এর প্রসার ও প্রকৃতি। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ দামে ফর্মাল টিকিট আর ইনফর্মাল টাউট দালাল ও বিবিধ উপায়ে টিকিট বিক্রির সার্বিক ব্যবস্থা বোঝা যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পরিবহন খাতে সাকুল্যে ২ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা বা লেনদেন হয়ে থাকে।
এটিও অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এবার ঈদ ও পূজা উপলক্ষে উৎসব ভাতা, বছরের এ সময়টাতে ব্যাংকগুলো বার্ষিক বোনাস দিয়ে থাকে তার ওপর সম্প্রতি ঘোষিত মহার্ঘভাতা জুলাই থেকে প্রাপ্তির সম্ভাবনা বাড়তি অর্থ ব্যয়ের আগ্রহ সৃষ্টি করবে। এসবের ফলে একটা বড় ধরনের বাড়তি অর্থ অর্থবাজারে প্রবেশ করবে, মুদ্রা সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় স্থিতিস্থাপকতার টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ, মুদ্রা লেনদেন, আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রসারই অর্থনীতির জন্য আয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মুদ্রা সরবরাহ গতিশীলতা আনয়ন।
ঘূর্ণায়মান অর্থনীতির গতিপ্রবাহে যে কোনো ব্যয় অর্থনীতির জন্য আয়। দেশজ উৎপাদনে এর থাকে অনিবার্য অবদান। যে কোনো উৎসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনয়ন করে, মানুষ জেগে উঠে নানান কর্মকাণ্ডে, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় একটা স্বতঃপ্রণোদিত আবহ সৃষ্টি হয়। এই আবহকে স্বতঃস্বাভাবিক গতিতে চলতে দেওয়ায় দেখভাল করতে পারলে অর্থাৎ সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও পারঙ্গমতা দেখাতে পারলে এ কর্মকাণ্ড, এই মুদ্রা সরবরাহ, ব্যাংকের এ তারল্য তারতম্য, পরিবহন খাতের ব্যয় প্রবাহ একে স্বাভাবিক গতিতে ধরে রাখতে পারলে অর্থনীতির জন্য তা পুষ্টিকর প্রতিভাত হতে পারে। এখানে বিচ্যুতি বিভ্রান্তি ও বিপত্তি সৃষ্টি হলে একটা স্বাভাবিক সিস্টেম লসের সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারে।
হজ ব্যবস্থাপনায় নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়ে পরিবহন ও আবাসনে নিজেদের অবকাঠামো গড়ে উঠলে এবং কার্যকর ভূমিকায় পাওয়া গেলে, বর্ডার ট্রেডে বাঞ্ছিত নিয়ন্ত্রণ ও পরিবীক্ষণ জোরদার করে, ঘাটে ঘাটে চাঁদা, দুর্নীতি ও দালালি, সব ধরনের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে, চামড়া পাচার রোধকল্পে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে উৎসবের অর্থনীতিকে জিডিপিতে যোগ্য অবদান রাখার অবকাশ নিশ্চিত হতে পারে।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।
ই-মেইল : সধুরফ১২৭৩@যড়ঃসধরষ.পড়স
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।