বনের চারদিকে ছিল নির্বাচনের চরম উত্তেজনা। কে জিতবে তাই নিয়ে সবার মধ্যে ধুন্দুমার আলোচনা। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাঘ মামাকে পছন্দ করতাম। শুধু আমি কেন, আমার মনে হয় আমাদের বানর জাতির সবাই বাঘ মামাকে ভোট দেয়। কেন জানি না, বাঘ মামার আমাদের প্রতি অরুচি আছে।
জেনারেলি, তিনি আমাদের কাউকে খেতে চান না। বাঘ মামা নির্বাচিত হলে সপ্তায় মাত্র একটা বানর খান আর সিংহ মামা নির্বাচিত হলে সপ্তায় দুইটা। তাই আমরা বানর জাতি যে বাঘ মামাকে সাপোর্ট করব এটাই স্বাভাবিক। তবু কিছু কিছু দুষ্ট বানর আছে যারা সিংহ মামার সাথে আঁতাত করে বসে। তারা সিংহ মামার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারনা চালায়।
বিনিময়ে তারা হয়তো পুরো রাজত্বকাল জীবিত থাকার নিশ্চয়তা পায়। অন্যদিকে সিংহ মামা আবার সব শিয়ালের সমর্থন পান কারণ সিংহ মামা শিয়াল খেতে একেবারেই পছন্দ করেন না। রুচি না থাকায় একবার একটা শিয়াল সিংহ মামার ডেরায় গিয়েও ফিরে আসার উদাহরণ একেবারেই বিরল না।
তো কথা বলছিলাম, নির্বাচনকালীন উত্তেজনা নিয়ে। সিংহ মামা সবে তার টার্ম শেষ করেছেন।
পরের মাসে নির্বাচন হবার কথা। কিন্তু বাঁধ সাধলেন বাঘ মামা। তিনি নাকি লক্ষ্য করেছেন নির্বাচন পরিচালনায় যারা এই মুহুর্তে আছে তাদের সবাই শিয়াল সম্প্রদায়ভুক্ত। এমনিতেই শিয়াল ধূর্তের শিরোমনি, তার উপর আবার তাদের অধিকাংশই চায় সিংহ মামা জিতুক। স্বভাবতই বাঘ মামার আশংকা ছিল নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না।
তাই তিনি একের পর এক হরতাল দিয়ে বনের ভেতর এক রকমের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছেন । সিংহ মামা অবশ্য বেশ কয়েকবার রণ হুংকার দিলেন, যদিও তাতে কোন কাজ হয়নি। বাঘ মামা তার নির্ধারিত হরতাল কর্মসূচী চালিয়ে গেলেন।
হরতালে আমার সবচে খারাপ লাগে বন জুড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়ার ব্যপারটা। মানুষের কাছ থেকে বেশ কিছু দিয়াশলাই চুরি করে এনে রাখা আছে আমাদের কাছে।
হরতালের সময় এগুলার সদ্ব্যবহার করা হয়। আগুন জ্বালালে অনেকেই পালাতে পারে না। আগুনে পুড়ে মারা যায়। সেদিন ঈগল পাখির একটা বাচ্চা মারা গেল যখন, তখন ঈগল পাখিরা সবাই মিলে কোর্টে নালিশ করল। বিচারক হলেন সুন্দরী একটা ময়ূর।
দেখতে যেমন সুন্দর, মনটাও তার খুব ভাল। ময়ূর মহাশয়া এবার বিচারে বেশ কঠোর ভূমিকা নিলেন। তিনি প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নিয়ে জানতে পেলেন ঐ নির্দিষ্ট গাছটিতে আগুন ধরিয়েছিল একটা সজারু। ব্যাপারটা বউ কথা কও পাখি জানতে পেরে প্রচার করে দিল সমগ্র বনে। ঘটনা জানতে পেরে পাখিরা সবাই এক হয়ে গেল।
বলাবাহুল্য, পাখিদের মধ্যেও কিন্তু দলাদলি আছে। তবু নিজ প্রজাতির একজন মরে যাওয়ায়, বোধ করি, তারা সবাই এক হয়ে সমগ্র সজারু জাতির নির্বাসন চাইল। দাবী উঠল, তাদের নির্বাসন দেয়া হোক এমন একটা দ্বীপে যেখানে কোন খাবার নাই। কিন্তু বিজ্ঞ বিচারক আরো গভীরে যেতে চাইলেন। বললেন, না, আমি সজারুকে জিজ্ঞেস করব এটা কার জন্য করা হয়েছে।
সজারু এসে জানালো, এটা তাদের দলের সেক্রেটারী হাতির নির্দেশে করা হয়েছে। হাতিকে ডেকে আনা হল। হাতিকে হুকুমের আসামী করা হলে হাতি অনন্যোপায় হয়ে বললো, আমি এটা করেছি আমাদের দলের প্রধান বাঘ মামার কথায়। বিচারকের দৃঢ়তায় একসময় বাঘ মামাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো। বাঘ মামা বললেন, সিংহ মামা যদি নির্বাচনে কারচুপি করার সিদ্ধান্ত না নিতেন তবে এটা হতো না।
বিজ্ঞ বিচারক সবকিছু শোনার পর রায় দিলেন, বাঘ মামা আর সিংহ মামা মূল আসামী। তাই শাস্তি তাদেরকে গ্রহণ করতেই হবে। এরপর সিংহ মামা বাঘ মামার সাথে কথা বললেন। ওটাই বোধ হয় ওদের মধ্যে প্রথম কথা। তাদের ধারণা হল সব পশু-পাখি তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
তারা ঠিক করলেন, দুজন মিলে এটার প্রতিরোধ করবেন। তারা সবাইকে ডেকে মিটিংএর আয়োজন করলেন।
কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল আরেকটা ঘটনা। খরগোশ জাতি একটা জনসভার আয়োজন করে সবাইকে নিমন্ত্রণ করল। জনসভায় খরগোশদের নেতা ভাষন দেয়া শুরু করলেন,
ভাইসব, আজ আমরা এখানে হানাহানি আর মারামারি করছি কাদের জন্য? বাঘ আর সিংহ মামার জন্য।
অখচ যখন বিচারে তারা নিজেরা দোষী সাব্যস্ত হলেন তখন তারা বিচার না মেনে আমাদের উপর ক্ষেপে গেলেন।
ভাইসব, আমরা যাদের জন্য আজ দলাদলি করছি, যুদ্ধ করে নিজের প্রাণ দিচ্ছি, তাদের মধ্যে একজন না একজন ক্ষমতায় যাবেন। তারা ক্ষমতায় যাবার জন্য নির্বাচনী মেনিফেস্টো দেন। আপনারা নিশ্চয়ই ভাল করে সেই ইশতেহারের প্রথম পয়েন্টটা পড়েছেন। প্রথম পয়েন্টেই একজন বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে সকাল আর রাত দু’বেলা আহার করবেন যে আহারের মেনুতে থাকবো আমাদেরই কেউ না কেউ।
আরেকজন বলেছেন, তিনি কেবল দুপুরে আহার করবেন। কিন্তু একটু বুদ্ধি খাটালেই দেখবেন তাকে এই একবেলাতেই কিন্তু অন্যজনের দুবারের সমান আহার করতে হবে। সেখানেও আহারের মেনু কিন্তু আমরাই।
ভাইসব, আমাদের অনেকে ভাবি, সিংহ মামা গেলে আমাদের প্রজাতি থেকে কম আহার করবেন। আরেক দল ভাবি, বাঘ মামা জিতলে আমাদের সংখ্যা হ্রাস কম হবে।
এভাবে তুলনামূলক বিচার করে আমরা ভোট দেই।
ভাইসব, একটু ভেবে দেখেন আমরা বোকার মতো এই দুজনকে নির্বাচিত করি আল্টিমেটলি আমাদের ক্ষতি করার জন্যই। অথচ আমরা সবাই যদি এক হতে পারি, আমরা সবাই যদি মিলেমিশে বিদ্রোহ করতে পারি, তবে এই দুই শাসকশ্রেনীকে চিরতরে এ বন থেকে বিতাড়িত করতে পারি। আর এটা করতে পারলেই আমাদের এ বনে চির শান্তি নেমে আসবে।
ভাইসব, আপনারা সবাই প্রাজ্ঞ।
আপনাদের আর কী বুঝাবো? যদি আপনারা আমার বক্তব্যের সাথে একমত হন, আমার সাথে চলুন। আমরা দুধ কলা দিয়ে যে কাল সাপগুলো পুষেছি তাদের দুধ-কলার অধিকার কেড়ে নিতে রওনা দেই।
ভাষন শেষে লক্ষ লক্ষ পশুপাখি এগিয়ে চললাম সেই কালসাপগুলোর ডেরার দিকে। পথিমধ্যে খবর পেলাম, এতোদিন বিপুল বিক্রমে রাজত্ব পরিচালনাকারী দুই শাসক লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।