বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...
আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। আমরা খুব অল্পতে তুষ্ট হই। আমরা খুব আশাবাদি একটি জাতি। এই আশা আর স্বপ্ন হয়তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, আমরা এটা বিশ্বাস করি বলেই হয়তো বেঁচে থাকি।
আমাদের বেঁচে থাকায় কার কি আসে যায়? বিশেষ করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর? কিংম্বা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রীদের বা কি আসে যায় আমাদের বেঁচে থাকা না থাকা নিয়ে? গোটা জাতি দেশের প্রধান দুই দলের নেত্রীর অর্থ্যাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রীর টেলিফোন সংলাপের মধ্যে আশা দেখেছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন, পেছনের সব অন্ধত্ব দূর করে হয়তো দেশের প্রধান দুই নেত্রী জাতিকে একটি নতুন দিকে নিয়ে যাবেন। তাদের টেলিফোন সংলাপকে গোটা জাতি একটা প্রতীকি বন্ধাত্ব ঘুচানোর মাইলফলক হিসেবেই দেখতে চেয়েছিল। টেলিফোনে কি কথা হয়েছে, তার চেয়েও বড় বিষয় হল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রীকে টেলিফোন করেছেন। দুই নেত্রী যেখানে প্রায় কুঁড়ি-বাইশ বছর সরাসরি কথাই বলেন না, সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সউদ্যোগে মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রীকে টেলিফোন করেছেন, এটাই একটা ঐতিহাসিক এবং অভূতপূর্ব ঘটনা।
আমরা আমজনতা সেই স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।
আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলি। সংগঠনের স্বাধীনতার কথা বলি। মিটিং মিছিল সভা সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলি। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলি।
নারীর অধিকার আদায়ের কথা বলি। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধের কথা বলি। শিশুশ্রম বন্ধের কথা বলি। সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলি। দুর্নীতি বন্ধের কথা বলি।
জাতিকে সংবেদন ও ঐক্যের কথাও বলি। আমরা কথায় কথায় অনেক কথাই আসলে বলি। আমাদের সেই অনেক কথামালার যে আশা জাগানিয়া স্বপ্ন, বাস্তবতার সঙ্গে তার অনেক অনেক দূরত্ব। সেই যোজন যোজন দূরত্ব দূর করতেই হয়তো আমরা একটু সবকিছু বেশি বেশিই বলি। আমরা একটু বেশি বেশিই আশা করি।
আমরা একটু বেশি বেশিই স্বপ্ন দেখি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী টেলিফোনে কি কথা বলেছেন, তা মিডিয়ার আগ্রাসি এবং অতি বাড়াবাড়িতে এখন সন্ত্রাসের পর্যায়ে চলে গেছে। মিডিয়া সেই টেলিফোন সংলাপের নানান রঙ ঢঙ মেখে নানাভাবে প্রচার করছে। অনেকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সেই টেলিসংলাপ রিমিক্স করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে স্বাধীন সংবাদপত্র এবং স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের অনৈতিক কার্যকলাপের ঔদ্ধত্ত্ব থেকেই।
সংবাদ মাধ্যমের এতো বড়াই অনেক সময় দেশের জন্য অমঙ্গলই ডেকে আনে। একটি ভালো খবরকেও সংবাদ মাধ্যম হলুদ সাংবাদিকতার তুলির আচড়ে কালো অধ্যায় বানিয়ে ফেলার মত অপকর্ম করতে পারে। বাংলাদেশে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের অধিকার নিয়ে সেটাই করা হচ্ছে বলে আমি মনে করি।
একাত্তর টেলিভিশন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী'র টেলি-সংলাপ প্রচার করছে। টেলিভিশনের পর্দায় ছাড়াও একাত্তর টেলিভিশনের ফেইসবুকে সেটি দুই পর্বে আপলোড করা হয়েছে।
স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের অধিকারের সুযোগ নিয়ে এটা একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। গতকাল প্রথম আলো টেলি সংলাপের কাল্পনিক ভার্সান ছেপেছিল। আর রাত নাগাদ একাত্তর টেলিভিশন তার অর্জনাল ভার্সান শুনিয়ে দিল। দুই নেত্রী'র টেলিসংলাপের বিষয়বস্তু যা-ই হোক না কেন, সেটি ছিল উভয় দলের মধ্যে জাতির এক ক্রান্তিকালের বরফ গলার একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ। সেই উদ্যোগকে ভিন্নভিন্ন অর্থ করে ভিন্নভিন্ন মেজাজে মিডিয়া খুব সিরিয়াসলি ভিন্নখাতেই প্রবাহিত করলো।
কোনোভাবেই সংবাদ মাধ্যম এটা করে কোনো ভালো কাজ করেনি। বাংলাদেশে মিডিয়ার এই বাড়াবাড়ি অধিকারটা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ করা উচিত বলেই আমি মনে করি। গোটা জাতির দুই নেত্রী'র প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-সম্মান, সেটিকে খুব ষড়যন্ত্রমূলকভাবেই নষ্ট করার একটি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই এই টেলি-সংলাপ প্রচার করা হয়েছে বলে আমি মনে করি।
কারো ব্যক্তিগত আলাপ বা টেলিফোন সংলাপ এভাবে অবাধে প্রচার বা প্রপাগাণ্ডা আকারে প্রচার করলে দেশের প্রচলিত আইনে কি ধরনের সাজার কথা আছে, আমার জানা নেই। কিন্তু এটা যে একটা বঢ় ধরনের অপরাধের মত কাজ সেটি আমি বুঝতে পারি।
সংবাদ মিডিয়া প্রচার প্রপাগাণ্ডার নামে সেই অপরাধটি করছে বাংলাদেশে।
সেদিন ডেইলি স্টার বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে দেওয়া চিঠি'র ফোটাশট ছেপে দিল। এটা কি ধরনের সাংবাদিকতা আমি বুঝি না। মিডিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা যে নেই, সেটি উদ্ধারের প্রক্রিয়ার অংশ হলেও এটাকে ঠিক সাংবাদিকতা বলা যায় না। এটা মিডিয়ার নামে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা।
বানিয়ে বলা গল্প যেহেতু মানুষ আর বিশ্বাস করে না, তাই মিডিয়া এখন প্রমাণ হাজির করে সাংবাদিকতায় প্রমাণ দিতে চায় যে, তারা আসল খবরটি প্রচার করার চেষ্টা করছে। মানুষের মিডিয়ার প্রতি আস্থা সংকট আছে বলেই মিডিয়াকে সেটি হাতেনাতে প্রমাণ করার দায় পড়েছে। কিন্তু সেই দায় এড়াতে গিয়ে মিডিয়া যখন অপরাধ বা সন্ত্রাস করবে, সেটি মেনে নেওয়া যায় না।
আমরা আমেরিকার ওয়াটার গেইট কেলেংকারীর কথা জানি। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সেই কেলেংকারীর দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
বসনিয়া যুদ্ধে মিলোসেভিচের মিডিয়া প্রচার সেলের উদ্যোগের কথাও আমরা জানি। গোটা বসনিয়ায় যখন মিলোসেভিচের রক্তের হোলি খেলা চলছিল, তখন মিডিয়া সেটিকে পাশ কাটিয়ে বার্সালোনার অলিম্পেকর খবরে নিমজ্জিত ছিল। আমরা ইরাক যুদ্ধে মিডিয়ার ক্যারিশমা দেখেছি। আমরা আফগানিস্তানে মিডিয়ার ভূমিকাও দেখেছি। আমরা তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া, সিরিয়ায় মিডিয়ার একচোখা ভূমিকাও দেখেছি।
আমরা আমেরিকার নাইন ইলেভেনের মিডিয়ার ভূমিকাও দেখেছি। আমরা বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেনে মিডিয়ার ভূমিকাও দেখেছি। মিডিয়ার নিজস্ব লোভ লালসার ইতিহাসও আমরা জানি। মিডিয়ার খবরের সত্যাসত্য মিথ্যাচার আর প্রপাগাণ্ডার খবরও আমরা জানি। আমরা হিটলারের গোয়েবলসের চাটামের খবরও জানি।
বাংলাদেশের মিডিয়া এখন হিটলারের গোয়েবলসকেও হার মানাতে বদ্ধপরিকর। রাতারাতি গজিয়ে ওঠা হাজার হাজার মিডিয়ার চলমান প্রপাগাণ্ডা আর মিডিয়া সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দেশের কোনো মঙ্গল করছে না। বরং এটা দেশের মধ্যে নানা ধরনের অপরাধ কার্যকলাপকে উৎসাহ দিয়ে উসকে দিচ্ছে। যা একটি জাতির জন্য ভয়ংকর একটি অসনি সংকেত। সরকারিভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী'র টেলিফোন সংলাপ প্রেসরিলিজ আকারে প্রচার করা হয়নি।
অবশ্য মাননীয় তথ্যমন্ত্রী মিডিয়ার বাড়াবাড়ি এবং উল্টাপাল্টা প্রচার নিয়ে এক মন্তব্য বলেছেন, এটি প্রকাশ করলে সবাই আসল সত্যটা জানতে পারবেন। কিন্তু সরকারি ভাবে এটা তো এখনো প্রকাশ করা হয়নি। সরকারিভাবে এটা প্রচার করার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী'র সম্মতি লাগবে সবার আগে যে, তাদের টেলিফোন সংলাপ প্রকাশ করা যাবে কিনা? তাদের এই বিষয়ে সম্মতি পাওয়া যাবে বলে কেউ বিশ্বাসও করবে না। কিন্তু মিডিয়া নিজেদের উদ্যোগে তা প্রচার করতে শুরু করে দিল। এটা কি কোনো অপরাধ নয়? একাত্তর টেলিভিশন এবং প্রথম আলো'র বিচার কি হবে? কে করবে সেই বিচার? সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল কি এখন সউদ্যোগে এসব মিডিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের কাছে উপস্থিত হবেন?
মহামান্য আদালতের কোনো বিচারপতি কি এখন নিজ বিবেচনায় মিডিয়ার বিরুদ্ধে রুল জারী করবেন? আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমরা কি সভ্য হচ্ছি? নাকি দিন দিন আমরা অসভ্য আরো হচ্ছি? একটা দেশ এবং সেই দেশের মিডিয়া সবকিছু নিয়ে ফান করবে এটা তো মেনে নেওয়া যায় না।
ধিক্কার জানাই আমি সেসব মিডিয়া নামের কুলাঙ্গারদের। মিডিয়া বিষয়ে এদের আরো গবেষণা করে জেনে শুনে তারপর মিডিয়া ব্যবসায়ে নামা উচিত। ব্যবসা আর সাংবাদিকতা মোটেও এক জিনিস নয়। বাংলাদেশের মিডিয়া সাংবাদিকতার নামে ব্যবসা করছেন। আমি ইতোমধ্যে আমার অনেক সাংবাদিক বন্ধু'র লজ্জ্বিত হবার ফেইসবুক স্টাটাস দেখেছি।
মিডিয়া যাদের দিয়ে এটি করাচ্ছেন, তাদের পেশা তো সাংবাদিকতা। একজন সাংবাদিক হিসেবে দিন শেষে তারা কি প্রচার করছেন জাতির সামনে? তাদের কি বিবেক বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে? যদি না পায়, তাহলে দুঃখপ্রকাশ করে তাদের এসব প্রপাগাণ্ডা প্রচার বন্ধ করা উচিত। নইলে রাষ্ট্রের উচিত হবে এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওযা।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রের কেউ-ই আইনের উর্ধ্বে নয়। আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না।
সংবাদ মাধ্যমকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। নইলে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম দেশের চলমান বিভাজনকে আরো বিভাজিত করবে বলেই আমি মনে করি। যা কারো প্রত্যাশা হতে পারে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।