আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গুলস্থিান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার: ওরিয়ন এর দুর্নীতির দায় জনগণের ওপর



ওয়াছিউর রহমান খসরু, ঢাকা: গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার নির্মাণে ওরিয়নের দুর্নীতির দায় এখন জনগণের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। উদ্বোধনের পর অতিরিক্ত টোল আদায়ের মাধ্যমে জনগণের পকেট কাটছে নির্মাতা ও পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপ। আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে চুক্তি বা সরকার নির্ধারিত টোল আদায়ের শর্ত উপেক্ষা করে অনিয়মকে নিয়ম হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছে ওরিয়ন গ্রুপ। দফায় দফায় নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠানটি ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয় দাঁড় করিয়েছে মূল ব্যয়ের প্রায় ছয় গুণ। বিনিয়োগের নামে লুটপাট করা অর্থ তুলতে গিয়ে ফ্লাইওভার ব্যবহারের প্রথম দিন থেকেই নির্ধারিত হারের চেয়ে দ্বিগুণ টাকা টোল হিসেবে আদায় করছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি।

নিয়মনীতি অনুসরণ না করে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বাড়ানো হয়েছে (মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) ফ্লাইওভারের টোলের হার। আর তার বৈধতা দিতে ইতোমধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)-এর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও ডিসিসির সঙ্গে ২০০৩ সালের ১০ নভেম্বর সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, ২৪ বছরের জন্য টোলের হার নির্ধারিত থাকলেও ফ্লাইওভারটি চালুর প্রথম দিনই তা বাড়িয়েছে প্রায় ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ। এক্ষেত্রে চুক্তি ভঙ্গ করে বর্ধিত হারে টোল আদায় বন্ধ না করে বরং তা অনুমোদনসহ আরেক দফা বাড়ানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে ডিএসসিসি’র দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায়। চুক্তি অনুযায়ী, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার ব্যবহারে মোটর সাইকেলের টোল ৫ টাকা, অটোরিকশা ১০, কার ৩৫, জিপ ৪০, মাইক্রোবাস ৫০, পিকআপ ৭৫, মিনিবাস ও চার চাকার ট্রাক ১০০, বাস ও ছয় চাকার ট্রাক ১৫০ এবং ট্রেইলার ও কাভার্ড ভ্যান ২০০ টাকা।

প্রকল্পের দরপত্র চূড়ান্ত করার সময় টোলের এ হার নির্ধারণ করা হয়। এ সংক্রান্ত চুক্তিতে সই করেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম ছাড়াও তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সচিব, প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী। অথচ চুক্তি ভঙ্গ করে সরকারের অনুমোদন ছাড়া নির্ধারিত হারের চেয়ে ৭০-১০০ শতাংশ অধিক হারে টোল আদায় করছে ওরিয়ন গ্রুপ। ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় টানানো তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে মোটর সাইকেলের টোল ১০ টাকা, অটোরিকশা ১৮, কার ৬০, জিপ ৭০, মাইক্রোবাস ৮৫, পিকআপ ১৩০, মিনিবাস ও চার চাকার ট্রাক ১৭৩, বাস ও ছয় চাকার ট্রাক ২৬০ এবং ট্রেইলার ও কাভার্ড ভ্যান ৩৪৫ টাকা। ফ্লাইওভার নির্মাণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরামর্শ অনুসরণ না করায় গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি রুটের নিচের সড়কটি অনেক সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

এছাড়া ফ্লাইওভারের নিচের সড়কে বিভিন্ন স্থানে অপ্রয়োজনে ডিভাইডার দিয়ে প্রচুর জায়গা আটকে দেয়া হয়েছে। ফলে ফ্লাইওভারের নিচের সড়কে নিয়মিতই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এই জটিলতা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। মাত্রাতিরিক্ত টোলের কারণে ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী যানবাহনের সংখ্যাও অনেক কম। এতে ফ্লাইওভার সামর্থ্যরে ১০ শতাংশও ব্যবহার হচ্ছে না।

এ কারণে পরিকল্পিতভাবে নিচে যানজট সৃষ্টি করা হচ্ছে, যাতে যানবাহনগুলো বাধ্য হয় ফ্লাইওভারের উপরে উঠতে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামছুল হক শীর্ষ কাগজকে বলেন, নিচের সড়কটি সংকুচিত না করে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করা যেত। এক্ষেত্রে বুয়েটের পরামর্শ বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এছাড়া ফ্লাইওভারের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ফ্লাইওভারটি নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিল বুয়েট। কিন্তু তাও মানা হয়নি।

উল্লেখ্য, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার নির্মাণে ৬৬৭ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয়। কিন্তু কয়েক দফা বৃদ্ধির পর প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। বিল্ড ওন অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওওটি) পদ্ধতিতে করা ফ্লাইওভারটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। টোলের মাধ্যমে ২৪ বছরে মুনাফাসহ বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে নেবে। বর্তমানে এর নামেমাত্র তত্ত্বাবধান করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

২০০৩ সালের গোড়ার দিকে ডজন খানেক প্রতিষ্ঠানের দরপত্র থেকে কারিগরি মূল্যায়নে রেসপন্সিভ বলে বিবেচিত হয় চারটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বেলহাসা-একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড। তাদের দর ছিল ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। পরবর্তীতে ২০১০ সালে দরপত্রের মূল প্রস্তাব বদলে এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ওরিয়ন গ্রুপ জালিয়াতি করে মূল দরদাতা বেলহাসার শেয়ার ৮০ শতাংশ থেকে মাত্র ৫ শতাংশে নামিয়ে আনে এবং ফ্লাইওভার নির্মাণের পুরো কর্তৃত্ব নেন ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম।

নির্মাণ ব্যয়ের কথা বলে ওরিয়ন গ্রুপ ব্যাংক থেকে ৬০০ কোটি টাকা তুলে নেয়, অথচ এ ব্যাপারে বেলহাসাকে কিছুই জানানো হয়নি। বেলহাসার কারিগরি দক্ষতা দেখে কার্যাদেশ দিলেও পরবর্তীতে তাদের শেয়ার অংশ পরিবর্তন ও নানা কারণে বেলহাসা ওরিয়নের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ এনে চিঠি দিয়ে নিজেদের প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। নিয়ম অনুযায়ী এক্ষেত্রে পুন:দরপত্র আহ্বান ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। কিন্তু সকল নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ওরিয়নকে কাজের সুযোগ দেয়া হয় শুধুমাত্র লুটপাট-ভাগবাটোয়ারার লোভেই। আর সেই কারণেই প্রকল্পের ব্যয় পরবর্তীতে আরো দফায় দফায় বাড়িয়ে ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কাজ শুরুর আগেই নির্মাণ ব্যয়ের একটি বড় অংশ (যা ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছিলো) সরকারের প্রভাবশালী মহলের পকেটে চলে যায়। বাকি টাকা ওরিয়ন গ্রুপের পকেটে যায়। ব্যাংকগুলোকে এক্ষেত্রে বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রভাবশালী মহলকে ম্যানেজ করার পর বস্তুতঃ ওরিয়ন যখন যা চেয়েছে তা-ই ঘটেছে। ডিসিসি এক্ষেত্রে সরকার বা জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, ওরিয়নের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কাজ করেছে।

এসব ব্যাপক অনিয়ম আর লুটপাটের কারণেই নির্মাণের পূর্বে প্রকল্প ব্যয়কে অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেখানো হয়। অথচ বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী পুরো প্রকল্পে সাড়ে তিনশ’ থেকে চারশ’ কোটি টাকার বেশি লাগার কথা নয়। এই ফ্লাইওভার নির্মাণের শুরু থেকেই ভয়াবহ দুর্নীতি ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে। প্রকল্প উদ্বোধনের পর পরই এই প্রকল্প নিয়ে তৈরি করা মন্ত্রণালয়ের ফাইল থেকে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মূল্যবান কাগজপত্র গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটে। যা এই প্রকল্পে যে সব অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে সেগুলো প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল।

দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত ওবায়দুল করিমের ওরিয়ন গ্রুপ এই কাগজপত্র গায়েবের সাথে জড়িত বলেও অভিযোগ উঠে। উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে প্রকল্প শুরুর দিকে বেসরকারি বিনিয়োগে বিওওটি পদ্ধতিতে নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে দেশি বিদেশি ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বনিম্ন দরদাতা বেলহাসা-একম অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের দর ছিল ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সেটিকে জালিয়াতির মাধ্যমে জোট সরকারের আমলে কার্যাদেশ দেয়া হয় ৬৬০ কোটি টাকায়। বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতির অভিযোগে প্রকল্পটি বাতিল করে; কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ২০১০ সালের ২২ জুন প্রকল্প উদ্বোধনের সময় নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা।

সর্বশেষ বাড়তে বাড়তে নির্মাণ কাজের এই পর্যায়ে এসে তা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকায়। ওরিয়ন গ্রুপের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রকল্পের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর কারণে নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু, দৈর্ঘ্য বাড়ানোর এই নকশা কে অনুমোদন করেছে, ব্যয় বৃদ্ধিই বা কে মূল্যায়ন করেছে, কে অনুমোদন করেছে এসবের কোন তথ্য নেই। উদ্বোধনের দিন থেকে টোল আদায় নিয়ে পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ও গাড়ি চালকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এক পর্যায়ে তা হাতাহাতিতে রূপ নেয়।

কারণ, অস্বাভাবিক টোল দিয়ে ফ্লাইওভার ব্যবহার করতে রাজি নয় ব্যবহারকারীরা। - See more at: Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।