আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিষ গহবর (একটি সত্য ঘটনার উপস্থাপনা)

নীল আমি দেখছিলাম ফারিয়া এগিয়ে আসছে । আমি নিশ্চিত ছিলাম ওর গন্তব্য আমরাই। হুট করে বিপ্লব দাড়িয়ে যায়। এমন বিপ্লবকে আমি কল্পনাও করিনি। বোধয় ঘৃণা ধারণ করার ক্ষমতা ওর অনুভূতিতে আর অবশিষ্ট ছিল না।

স্তব্ধ পুরো লাউঞ্জ। তুমি! ওয়াকক..তোমাকে আমি এতটাই ভালবেসেছিলাম যে আমার হৃদয় আমাকেই আক্রমন করে বসেছিল। দুদিন মৃত্যুর সাথে টাই করে ফিরে এসেছি। আইসিইউ’তে মৃত্যুদূত কি বলেছে শোন-আমি তোকে নরকে নিতে এসেছিলাম। তুইতো নরককেই ভালবেসেছিস।

মৃত্যদূতের সময় থামিয়ে দিয়েছিল আমার এই বন্ধুরা, যাদের ভালবাসায় এই পৃথিবীই আমার জন্য জান্নাত হয়ে অপেক্ষা করছিল। ফারিয়া নিশ্চুপ। আমি দেখছিলাম পাপের অবয়ব কেমন হয়। ফারিয়া চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না। বিপ্লব থামল না।

কিসের যেন অতিমানবিক শক্তিতে ও বলছে- শোন,আমি মৃত্যুর ফিরতি পথে দেখি পাপিষ্ঠ তুমি আর তোমার শরীর,এত বীভৎস,আমি ভয়ংকর ভয় পেয়েছিলাম,ছুটেছিলাম উর্ধ্বশ্বাসে। তোমার জন্য আমি হারিয়েছি অসংখ্য হৃদয় বন্ধুদের; জীবনের মূল্যবান সময়গুলো ব্যয় করেছি তোমার পিছে;আমার উপার্জন,আমার ব্যবসা এবং শেষ পর্যন্ত আমার জীবন সবই উপুড় করে দিয়েছি তোমার পায়ে। হিসেব রাখিনি,এভাবে ভাবিনিও কখন আর আজও ভাবতে চাই না। কি চাইব বল? প্রতিদান হিসেবেতো দিয়েই দিয়েছ সর্বস্ব মিথ্যা আর অগনিত পাপিষ্ঠ সম্পর্ক দিয়ে। আমি বিপ্লবের কাঁধে হাত রাখি।

আমার আঙ্গুল থেকে তখন রক্ত ঝড়ছিল। কফি গ্লাসশুদ্ধ টেবিল গ্লাস টুকরো টুকরো ছটিয়ে। এর মধ্যেই দুজনকেই বসতে বলি। কিন্তু বিপ্লব বলা থামায় না। তোমার অনেক সত্য আমি বিশ্বাস করতে চাইনি।

কিন্তু সত্য সত্যই। আমার অবিশ্বাসে তা বদলে যাবে না আর যায়ওনি। সত্যও কখনও কখনও নিকৃষ্ট ও ঘিন কাঠামোয় অবয়ব নেয় আর মিথ্যার স্তম্ভে আশ্রয় দিতে হয় বিশ্বাস,ভালবাসার। তোমার ক্ষেত্রে আমি তাইই করেছিলাম। সত্যটাকি এই না যে,তুমি বহুগামী।

পথবুধুরাতো সারভাইভার আর বহুগামীরা সিনার। তাইতো গোপনীয়তা ও শর্ত দিয়ে তোমার বসবাস করতে হয়। সত্যটা এই না যে,তুমি মিথ্যা ভাস্কর্য। সত্যটা এই না যে, তোমরা বদলাও না,আর বদলাওনা বলেই সময় ও বয়স তোমাদের বীভৎস পরিনতি নিয়ে অপেক্ষা করে। আমি বিশ্বাস করেছিলাম তোমায়।

অথচ তুমি- এক বীভৎস ভাগাড়। যেখানে অগনিত পাপী বীর্য্যরে স্তুপ আর স্তুপ থেকে ক্রমাগত জন্ম নিচ্ছে তোমার একেকটি নিকৃষ্টতম নষ্ট অবয়ব,ঘিন। এরমধ্যে শামস হাততালি বসে। পুরোই ফিল্ম,সেকি ডায়ালগ। ঐন্দ্রি নড়েচড়ে বসে।

বলে যাচ্ছে বিপ্লব। তোমার স্বার্থপরতার চরিত্র আমার কাছে শিল্প মনে হয়। আক্ষরিক অর্থেই তাই। তোমার চরিত্রের ব্যবহারিক মনস্তত্ত্বের কাঠামো ধরতে গেলে অতিমাত্রিক মানুষ হতে হবে। স্বার্থপরতাকে বৈধ করে নেয়ার এমন দক্ষ চরিত্রের জন্য তোমাকে বাহবা না দিলে সৃষ্টিশীলতার মূল্যায়নে অন্যায় হবে।

কী অনায়াসে তুমি বলে ফেল,‘আমার কোন প্রয়োজন ছাড়া তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই,তোমার প্রয়োজনতো প্রশ্নই আসে না’’। এই একটি উদাহরণই নাহয় দিলাম। কারন তুমি জানো,পেছনে আমার ভালবাসার দেয়াল। যেখানে ধাক্কা খেয়ে আমি বারবার তোমার কাছেই ফিরে আসবো। ওহহো, সম্পর্কের দূর্বলতার সুযোগ নেয়ার মত সবচেয়ে ঘৃণিত কাজেতো তুমিই করবে।

বোঝার বয়সে আমি বুঝিনি, ছিলাম অবুঝ,আর তুমি ছিলে চতুর,ধুর›দ্ধর; প্রতিটি সেকেন্ড হিসেবে শেষ হয়ে যাচ্ছিল সময়। আর তোমাকে ভালোবাসার পর আমি একে একে হারিয়ে ফেলেছিলাম আমার সব অস্তিত্বকে,সব প্রাণবন্ততাকে। আজ যখন আমি ভাঙ্গন থেকে উঠে দাড়াচ্ছি তখন তুমি এসেছ আমার ঘরের দরজায় ঘট ঘট করে; পাপিষ্ঠ। শোন, আমার ভেতরে ঢুকে যাওয়া তোমার দুর্গন্ধ থেকে আমি এখন পবিত্র । ফারিয়া কী যে বলতে যাচ্ছিল।

কিন্তু তার আগেই বিপ্লব বলে থামো,তোমাকে দেখলে কী মনে হয় জানো,মনে হয় কৈশর থেকে বৃদ্ধ বয়সী অগনিত শিশ্ন তোমার মুখের সামনে লাফালাফি করছে। আর তুমি একেক সময় একেক মুডে একেকটি চুষে চলেছো। যাশশ। একি বলল বিপ্লব। ভেতরে ভেতরে হাসিতে আমার বিষম যাচ্ছিল।

আমার এই অদ্ভুত ব্যাপার। অনেক কঠিন সময়েও আমি হাসতে পারি। আসলে আজকের এই বিপ্লব একদিনের নয়। নষ্টার নষ্টে খুঁিচয়ে খুঁিচয়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলা হয়েছে তার ভেতর বাহির। মানুষ হিসেবে বিপ্লব আমার মত অতিমাত্রিক নয়,সহজ,সরল।

ভাঙ্গনের আগেই ও বার বার উঠে দাড়াতে চেয়েছে,হয়ত ও ভয় পেত। ভাঙ্গনের যন্ত্রণার অবয়ব ওর কল্পনায় কোন আতংকের ছিল। কিন্তু অবশেষে ভাঙ্গনকে রুখতে পারেনি। আর আজ এই ভাঙ্গন থেকেই ও উঠে দাড়িয়েছে। যার পেছনে দাড়িয়ে আছি এই ‘আমি’।

এছাড়া উপায়ও ছিল না,ও পারত না। আমার কাছে ভাঙ্গন শেষ নয়,কারণ ভাঙ্গন থেকে মানুষ যখন উঠে দাড়ায় তখন ভাঙ্গনের চিহ্নও তাকে বহন করতে হয়। আমি নিশ্চিন্ন হবার ঝুকি নেই,বার বার। নিশ্চিন্ন থেকে আমি ফুঁেড় উঠি এক নতুন অফুরন্ত প্রাণ নিয়ে। আরেকটি অবাক সুন্দর,নরোম আদরসহ বেড়ে উঠি নতুন সংগ্রামে।

বিপ্লবরা সেটা পারে না। ওরা নিশ্চিন্ন হতে গেলে বিলীন হয়ে যাবে,ইট পাথরের এই নির্মম শহর ফুঁড়ে উঠার ক্ষমতা ওদের হয় না। কারণ মাড়িয়ে উঠা বীজের পরিপক্কতার জন্য পাপের শহর মাড়িয়ে ওরা আসেনা। তাই ভাঙ্গনের স্থান থেকেই ওদের নতুন ডালপালা জন্মাতে হয়,জীবনের অবশিষ্ট নিশ্বাসটুকুর জন্য,আলোর জন্য। পেছনের দড়িয়ে হঠাৎ আমার মনে হয় এই বিপ্লব কি আমি! সামনে দাড়ানো এই ফারিয়াকে আমি যেন বহুকাল ধরে চিনি।

২০১১ সালের এপ্রিল থেকে ২০১২ অগাষ্ট পর্যন্ত সময়টাকে আমার বহুকালই মনে হয়। হ্যা,সময় এবং সম্পর্ক মানুষ জীবনের প্রতিটি নিশ্বাসের দৈর্ঘ্য,প্রস্থ আর গভীরতার মাপজোঁখ আমায় দেখিয়েছে। যেখানে প্রতিটি মানুষ চরিত্রের একেকটি ‘আমি’ র অবয়ব কখনও নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর আর কখনও উকৃষ্ট থেকে উকৃষ্টতম। বিপ্লব বলে যাও,তোমার সামনে যে দাড়িয়ে সে নিকৃষ্টতর,ঘিন। বলে যাও,ভাঙ্গনের জোড়ায় যে দাগ অবশিষ্ট রয়ে যাবে সেখানে যেন শুধুই স্মৃতিহীন দাগ থাকে।

নষ্টের সবটুকু উদগিরণ করে দাও। ওরা নষ্টেরই ভাগাড়। বছর দেড়েক আগে। এপ্রিলের শুরুতে। ফেসবুক।

ব্যবসায়িক ঝামেলায় বিপ্লবের সময়টা তখন কিছুটা এলোমেলো। বিপ্লবের বাবা’র নিজেদের কোম্পানীর চট্টগ্রাম ব্রাঞ্চের দায়িত্বে থাকতে হবে তাকে,শিপিং বিজনেসে ঢাকার হেড অফিস থেকেও চট্টগ্রাম ব্রাঞ্চ অভিস অনেক ভাইটাল,ওখানে সার্বক্ষণিক নিজেদের কাউকে বসতেই হবে। বিপ্লব টানা সাত বছর চট্টগ্রামে থাকলেও ওই সময় ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয় ও। এ পর্যায়ে বাবা’র কথা সরাসরি অগ্রাহ্য করে ঢাকায় চলে আসে সে। আর এ নিয়েই আভিজাত্য ও অভিমানের শীতল সম্পর্ক শুরু হয় বাবা ছেলের মধ্যে।

বিপ্লব ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরে বাসা নেয়। এপ্রিলেরই কোন এক শেষ রাতে ফেসবুকে কথপোকথন শুরু হয় ফারিয়া দূর্ভা খানে’র সাথে। ফারিয়া লিখছিল,ও অসুস্থ। পায়ে পানি জমেছে। জ্বরও বেশ।

বিপ্লব এমনিতেই নরম। মানুষ হিসেবেই ও একটু বিচলিত হয় । ও বলে,সম্ভব হলে শাওয়ার নাও। গরম দুধ খেতে পার। ফারিয়া জানায়,ও অফিসে।

মাঝে মাঝেই রাতে সে অফিসে থেকে যায়। শাওয়ার নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও গরম দুধ খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বিপ্লবের খারাপ লাগে। কিন্তু কোন রিপ্লাই দেয় না। ফারিয়া জানায়,ওর ছোট্ট একটা অফিস দরকার।

হাজার পাঁচেক ভাড়ার মধ্যে। খুঁেজ দেবার ব্যবস্থা হবে কিনা? বেশ বিপদে আসে সে। বিপ্লব বিস্তারিত কিছু জানতে চায় না। শুধু বলে,খুব আন্তরিক ভাবেই ও চেষ্টা করবে। ফারিয়া জানায়,রাতে কিছু খায়নি ও।

এখন জ্বর ও পায়ের যন্ত্রণায় বেশ খারাপ ফিল করছে। বিপ্লবের বেশ মায়া অনুভব হয়। জানতে চায়,ফোনে কথা বলতে পারবে কি না? ও কল করতে চায়,প্রোফাইলে ফারিয়ার একটি একটের নম্বর দেয়াই ছিল। ফারিয়া ফোন দিতে বলে এবং এটাই শুরু। ফারিয়ার বয়স তখন একত্রিশ।

বিপ্লব ফারিয়ার চেয়ে চার বছরের ছোট। ফারিয়ার সাথে বিপ্লবের প্রথম দেখা হয় মিরপুরে। কাজীপাড়ায় বিপ্লবের এক সাংবাদিক বড় ভাইয়ের বাসায় বসে ওরা । বিপ্লব ফারিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিল,ও কি খেতে চায়? ফারিয়া বিয়ার পছন্দ করে জানিয়ে বলে,আমি মাত্র একটি বিয়ার খাই। ব্রান্ড ব্যারনস।

বিপ্লব এক কেইস বিয়ার নিয়ে আসে। ফারিয়ার সাথে ওর দেখা হয় কাজীপাড়া ফুট ওভার ব্রীজের নীচে। ফারিয়ার হাতে একটি ছোট্ট কোকের বোতল। খুব সাধারণ ছিমছাম গড়ণের একটি মেয়ে। উচ্চতায় পাঁচ ফিট বা তার একটু বেশি।

গায়ের রং শ্যামলা। ফেসবুকের ছবির সাথে বেশ অমিল। প্রথম দেখাতেই বিপ্লবের মনে হয়,প্রচন্ড ঝড়ে বিধ্বস্ত একটি পাখি নীড় হারিয়ে উদ্দেশ্যহীন উড়ে চলেছে। ক্লান্ত পাখায় একটু বিশ্রামের আশ্রয় চায়। করুণ অভিব্যাক্তি আড়াল করার সামর্থও সে হারিয়ে ফেলেছে।

(চলবে) (বিষ গহবর,অসম্পাদিত,আল আমীন দেওয়ান) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।