আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জামায়াত-হেফাজত ইস্যুতে বিএনপিতে বইছে পরস্পর বিরোধী ঝড়



বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট বিশেষ করে খোদ বিএনপিতেই জামায়াত-হেফাজত ইস্যুতে পরস্পর বিরোধী ঝড়ো হাওয়া বইছে। ঘরের বাইরে দেশের অভ্যন্তরে সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ জামায়াত-হেফাজতের বিরোধীতা করছে। পাশাপাশি বিদেশি ও ও তরুণ প্রজন্মও জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততার তীব্র বিরোধীতা করছে। এমতাবস্থায়, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তরুণ প্রজন্মের চাপে জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গ ছাড়ার বিষয়ে বিএনপি আস্থা সঙ্কটে ভুগছে। বিএনপির প্রভাবশালী একটি অংশ হেফাজত-জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে।

অপর প্রভাবশালী একটি গ্রুপ জামায়াত-হেফাজতযুক্ত বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। ফলে বিশ্বস্ত সঙ্গী জামায়াত ও নতুন বন্ধু হেফাজতকে বাদ দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না দলটি। জামায়াত ও হেফাজতকে সঙ্গে নিলে বিষয়টি তরুণ প্রজন্ম কিভাবে নেবে এবং বাদ দিলে তরুণ প্রজন্মের সমর্থন অক্ষুণœ থাকবে কিনাÑ এ নিয়েও সন্দিহান দলটি। জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গ ছাড়লে দল দুটিকে আওয়ামী লীগ তাদের কাছে টেনে নেবে এই আতঙ্কেও ভুগছে বিএনপি। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য স্বদেশ খবর’কে বলেন, জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা বা না করার সঙ্গে আস্থা সঙ্কটের কোনো সম্পর্ক নেই।

তাদের সঙ্গে আমাদের শুধু নির্বাচনি জোট ছাড়া কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একটি রাজনৈতিক কৌশল। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি করে তিনি বলেন, আমরাও চাই যুদ্ধাপরাধের বিচার হোক। তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি শুধু তাদের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছে।

জানা গেছে, বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে, নাকি তত্ত্বাবধায়ক অথবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবিতে অনড় থাকবে সেখানেও দলটির মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তি রয়েছে। এই ইস্যুতে দলের মধ্যেই দুটি গ্র“প দাঁড়িয়ে গেছে। এক গ্র“প যেকোনোভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারলেই দল বিজয়ী হবে বলে মনে করে। অপরপক্ষ কোনোভাবেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিপক্ষে। বাকি থাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচনে যাওয়া।

এজন্য প্রয়োজন কঠোর আন্দোলন। কিন্তু দলের মধ্যে দুটি গ্র“পের কারণে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে জোরালো আন্দোলন করাও কঠিন। একদিকে সরকারের চাপ, অন্য দিকে দলের অভ্যন্তরেই সমস্যা। বিএনপির অভ্যন্তরে যে দুইটি ধারা বিদ্যমান তা দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিবৃতি থেকে প্রকট হয়ে ওঠে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বিএনপি নেতাদের অনেকেই সরকারের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে আছেন।

সুযোগ পেলে অতীতের মতো তারা আবারও বেইমানি করবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়। ’ সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় বলা যায়, এখন উভয় সংকটে বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেকজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপি এখন জামায়াতকে ছেড়ে দিলে আওয়ামী লীগ তাদের কাছে টেনে নেবে। আবার জামায়াতকে রাজনৈতিক সঙ্গী হিসেবে রাখলেও পশ্চিমা শক্তি এবং দেশের তরুণ প্রজন্মের সমর্থন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি এবং উন্নয়ন সহযোগীরা আলাদাভাবে বিএনপি চেয়ারপারসনসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে শরিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামের মতো উগ্রপন্থী ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য বিএনপিকে পরামর্শ দেয়া হয়। এসব বৈঠকে বিএনপির অংশগ্রহণের মাধ্যমে আগামী নির্বাচন কিভাবে অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। একই সঙ্গে বিএনপি কিভাবে মাঠে থাকবে, শরিকদের অবস্থান কি হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। হরতালের মতো কর্মসূচি পরিহারের বিষয়ে প্রায় একমত হলেও এখন পর্যন্ত শরিক দলগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি বিএনপি। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারছে না।

হেফাজতে ইসলাম যেহেতু জোটভুক্ত দল নয় কাজেই কাগজেপত্রে এই দলটির বিষয়ে বিএনপির কোনো মাথাব্যথা নেই। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিএনপি গত জুনের পর থেকে হরতালের মতো কর্মসূচি পালন করছে না। তবে তাদের শরিক দল জামায়াতে ইসলামী হরতালের নামে সহিংস কর্মসূচি পালন করে আসছে। বিএনপি যে কৌশলগত কারণে হরতাল দিচ্ছে না এটা তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে প্রয়োজন হলে ঝুঁকিমুক্ত থেকে জামায়াতের কর্মসূচিতে স্থানীয়ভাবে সমর্থনের বিষয়ে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি সবুজ সংকেত দেয়া আছে।

মোট কথা জামায়াতে ইসলামী মাঠে আছে বলেই বিএনপি কঠোর কোনো কর্মসূচি না দিলেও চলছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, হরতাল না দেয়া একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র বলে মন্তব্য করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। মার্কিনিদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বিএনপি হরতাল করছে না ঠিকই, তবে তারা জামায়াতের সঙ্গও ত্যাগ করছে না। তবে দলটির অনেক নেতা মনে করেন জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে দিলে জামায়াত তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে।

নিজেদের প্রতি সাধারণ ভোটারদের প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই বিএনপি জামায়াতের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। অথচ তরুণ প্রজন্ম মনে করে বিএনপির মতো বড় একটি রাজনৈতিক দল যদি যুদ্ধাপরাধীদের নেতৃত্বে গঠিত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করে তাহলে তাদের ভোটের সংখ্যা অনেক বাড়বে। যুদ্ধাপরাধীদের কারণে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী তরুণ প্রজন্ম বিএনপির প্রতি সমর্থন দিচ্ছে না। অথচ এখন তরুণ ভোটারের সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের ভোটেই জোট-মহাজোটের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।

বিএনপির আরেকটি সূত্র জানায়, বিএনপি আওয়ামী লীগকে ভয় পাচ্ছে। জামায়াতকে আওয়ামী লীগ কাছে টেনে নেবে, জামায়াতের ভোট সব আওয়ামী লীগের বাক্সে চলে যাবে এটি ভ্রান্ত ধারণা বলে মনে করেন উভয় দলের নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের মতো জামায়াতও মাঠে ছিল। দাবি আদায়ের পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মতো জামায়াতে ইসলামীও বিএনপির বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছে। ওই সময় প্রচার চালানো হয়েছে আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করেছে।

কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। তার প্রমাণ ১৯৯৬ নির্বাচনে জামায়াত মাত্র ৩টি আসনে জয়লাভ করে। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করে জামায়াত ১৮টি আসন পেয়েছিল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্তত দুইজন প্রভাবশালী নেতাসহ একজন ভাইস চেয়ারম্যান এবং গুলশান কার্যালয়-কেন্দ্রিক কয়েকজন নেতা ও কর্মকর্তা খালেদা জিয়াকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদের সঙ্গে দলের কথিত সংস্কারপন্থীরাও রয়েছেন।

দলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সরকারের সঙ্গে বিএনপির কিছু নেতার যোগসাজশ রয়েছে। মহাজোট সরকারের সাড়ে ৪ বছরের বিভিন্ন ঘটনায় তা প্রমাণিতও হয়েছে। এসব নেতা আন্দোলনের বিষয়ে বরাবরই খালেদা জিয়াকে নেতিবাচক ধারণা দিয়ে থাকেন। তারা বলেন, পশ্চিমারা হরতাল পছন্দ করে না। তাই ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মসূচি দেয়া যাবে না।

তারা এও বলেন, কঠোর আন্দোলনে গেলে আবারও ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনা ঘটবে। এতে বিএনপিরই বেশি ক্ষতি হবে। অনেকদিন ক্ষমতার বাইরে থাকলে, দলের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়বে। দল দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই যেকোনো সরকারের অধীনেই বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে।

কারণ, নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। আন্দোলন করে দাবি আদায় না করে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে যেতে হবে। জানা গেছে, দলীয় এ সব নেতার পরামর্শ গ্রহণ করায় বিভিন্ন সময় ইস্যু পেয়েও আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি বিএনপি। দলীয় সরকারের অধীনে যারা নির্বাচনে যেতে চান না, তাদের আশঙ্কা ঈদের কিছুদিন পরই বিভিন্ন মামলায় তাদের গ্রেফতার করা হবে। সাজা দিয়ে নির্বাচনে কেন্দ্রীয় অনেক নেতাকে নির্বাচনে অযোগ্য করা হবে।

তারপর যারা নির্বাচনে যেতে চান, তাদের ব্যবহার করে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে নেয়া হবে। আর বিএনপি আন্দোলন করে নির্দলীয় সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকেও বিভিন্ন মামলায় সাজা দিয়ে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে। তারপর বিএনপির একটি অংশকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে নেয়া হবে। দলের মধ্যে দুটি ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ধারা দুটি নিজ নিজ বলয়ে শক্তিশালী হওয়ার কারণে বিএনপি কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

একদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আবার অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের কথাও বলছে। আবার সংসদে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের বিল আনার বিষয়ে তারা সম্মত নয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ, আন্দোলন, জোটের শরিকদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোনো বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না দলটি। এতে সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা হতাশ ও দ্বিধা-বিভক্ত।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।