আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

█ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাজুর পড়াশোনা,বিচারক হবার স্বপ্ন

যখন দেখি চাওয়া পাওয়া শূন্যতে মিলায় তখন আমি এই শহরে কষ্টে বেঁচে খাই
স্বপ্ন, আর ইচ্ছা পূরণের মতো কঠিন বিষয়টি বোঝার বয়স তার হয়নি। ঘরে খাবার নেই। গায়ের পোশাক কেনার টাকা নেই। নেই শিক্ষার উপকরণ কেনার সামর্থ্য। তবুও সে পড়বে।

উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপদ এলাকার ২০ নম্বর সড়ক। সেখানকার ফুটপাতে সন্ধ্যার পর ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাজু ও তার দু’ভাই-বোন পড়তে বসে। শখে নয়। অভাবের কারণে। আলোর অভাব।

আধুনিক ঢাকা শহরে রাজুদের ঘরে দিনের আলো ছাড়া অন্য কোন আলো নেই। একটি মাত্র কুপি বাতি। যা দিয়ে মায়ের দৈনন্দিন কাজ চলে। তাও হাতে টাকা না থাকলে কেরোসিনের অভাবে সেটিও কখনও কখনও জ্বলে না। তখন অন্ধকারে থাকতে হয় তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজু স্থানীয় বাইজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তার ক্লাস রোল-১৫। রাজুর বোন বৃষ্টি (৮) একই শ্রেণীতে পড়ে। ছোটভাই ভাণ্ডারী ওরফে তারেক (৬) পড়ে শিশু শ্রেণীতে। সকাল আটটায় স্কুলে যায় রাজু।

দশটায় ছুটি হলে চলে যায় পাশেই ‘রানা অটোমোবাইলস অ্যান্ড ওয়ার্কশপ’-এ। সেখানে কাজ করে দুপুর একটা পর্যন্ত। তারপর স্থানীয় একটি মসজিদে যায় কোরআন মুখস্থ করতে। দুপুর দু’টায় আবার যায় ওয়ার্কশপে। দু’টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ওয়ার্কশপে কাজ করে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরে রাজু।

চার-পাঁচ মাস হলো কেবল কাজ শিখছে ওয়ার্কশপে। এজন্য প্রতিদিন পায় ১০ টাকা। রোজগার বলতে এটুকুই। ওয়ার্কশপ থেকে এসেই ছেঁড়া একটি চট, বই, খাতা, কলম বগলদাবা করে ভাই-বোনদের নিয়ে পড়তে চলে যায় ঘরের পাশেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে। ২০ নম্বর সড়কের পাশে ডিজাইনটেক্স সোয়েটার্স লিমিটেড এর ৭২ নম্বর প্লট।

এর পাশেই একটি খুপড়ির মতো ঘর। উপরে ভাঙা পুরনো টিনের চালা। খুপড়ির চার পাশ মোটা পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। ঘরে বসার মতো চেয়ার টেবিল কিছুই নেই। আছে ভাঙা দু’টি চৌকি।

এর একটিতে রাজু ও তার ভাই-বোনদের বই খাতা ও অল্প কিছু বাসন-কোসন। আরেকটিতে তোষক, বালিশ কিছুই নেই। এর মধ্যেই মা, ভাই ও বোনদের নিয়ে গাদাগাদি করে রাত কাটে রাজুদের। একটু বৃষ্টি হলে সেটিও কখনও সম্ভব হয় না। রাজুর মা পঞ্চাশোর্ধ শিউলী বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজুরা চার ভাইবোন।

বড় বোন চুমকীর বিয়ে হলেও স্বামী তার খোঁজ-খবর রাখে না। এজন্য মায়ের সঙ্গেই থাকে সে। শাহীন নামে আর একটি ভাই ছিল রাজুর। কিন্তু মাত্র ১৭ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় শাহীন। রাজুর পিতা শামছুল হক জীবন চার বছর আগে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

এক সময় উত্তরার বিভিন্ন ফ্ল্যাটে ঝিয়ের কাজ করতেন শিউলী বেগম। এখন আর তা পারেন না। তার বাম কানের পাশে টিউমার। দিনরাত প্রচণ্ড ব্যথা। চিকিৎসকরা বলেছেন, সময়মতো তা অপসারণ না করলে তারও ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

সন্তানের মুখে ভাতই তুলে দিতে পারেন না। চিকিৎসার টাকা আসবে কোত্থেকে? তিনি বলেন, পোলাডার (রাজু) পড়ার এত ইচ্ছা। কিন্তু বই, খাতা, কলম, জামা-কাপড় কিছুই দিতে পারিনা। এক জোড়া বুট জুতা চাইছিল। তাও পারলাম না।

তিন বেলার জায়গায় দুই বেলা খায়। প্রায় রাতেই খাওন না পাইয়া কানতে কানতে ঘুমাইয়া পড়ে। তাও রাজু লেহা পড়া ছাড়ে না। আমিও বাধা দিই না। বলতে বলতে অঝোর ধারায় কাঁদেন শিউলী বেগম।

রাজুর সঙ্গে কথা বললে সে জানায়, আমি পড়তে চাই। ভাই-বোনরেও পড়াইতে চাই। রাজুর ইচ্ছা লেখা পড়া শিখে সে বিচারক হবে। বৃষ্টিকে চিকিৎসক বানাবে। কোরআন-হাদিস শেখার প্রতিও আগ্রহ আছে তার।

ইতিমধ্যে কোরআনের দশ পারা পড়া হয়ে গেছে। রাজু আরও জানায়, ল্যাম্পপোস্টের নিচে পড়তে গেলে গাড়ির হর্ন ও ধুলোবালিতে লেখা পড়ার ব্যাঘাত ঘটে। আর যেদিন ঝড় বৃষ্টি হয় সেদিন আর পড়া হয় না। রাজুর কর্মস্থল রানা অটোমোবাইলস অ্যান্ড ওয়ার্কশপের ডেন্টিং ইঞ্জিনিয়ার মো. জাকির হোসেন বলেন, রাজুকে আমি যথাসম্ভব সহযোগিতা করি। ও পড়াশুনা করুক- তাই চাই।

পড়ার প্রতি ওর দারুণ আগ্রহ। এজন্য তাকে পর্যাপ্ত সময়ও দিই। কিন্তু গরিবের ঘরে জন্ম। কেউ যদি একটু সহযোগিতা করতো তাহলে রাজুর ভবিষ্যৎ ভাল হতো। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাজুর পড়াশোনা,বিচারক হবার স্বপ্ন
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।