আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

।। রামু, উখিয়া, টেকনাফের পর এবার পাবনার সাঁথিয়ায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নগ্ন হামলা: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় প্রয়োজন কঠোর ব্যবস্থা ।।

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর হামলার দাগ না শুকাতেই গতকাল শনিবার পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় আবারো হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলো। এবারো ফেইসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তির গুজব ছড়িয়ে এই হামলার ঘটনা ঘটলো। ওই হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০-২৫টি বাড়ি এবং দুইটি মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হামলার পর ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে।

ঘটনার যেভাবে শুরু- সাঁথিয়ার বনগ্রাম বাজারের পাশের গ্রামের স্থানীয় ব্যবসায়ী বাবলু সাহার ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র রাজীব সাহার (১৫) কথিত ফেইসবুক পাতায় মহানবীকে কটূক্তি করে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে শুক্রবার রাতেই ওই এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। এ খবরে শনিবার বাজারের কিছু ব্যবসায়ীও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। শনিবার বেলা ১১টার দিকে ফেইসবুকের সেই কথিত পাতার ফটোকপি বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কথিত ফেইসবুক পাতার ফটোকপিতে নামসহ কভার ছবি, প্রোফাইল ছবি ও একটি পোস্ট ছিল। ওই ফেইসবুক পাতাটির নাম ছিল আপত্তিকর আর কভারে ছিল আপত্তিকর একটি কার্টুন।

ফেইসবুক পাতার ফটোকপি ছড়িয়ে পড়ার পর পাড়া-মহল্লায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতা বনগ্রাম বাজারে বাবলু সাহার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাঁর ছেলেকে হাজির করতে বলে। কিন্তু তিনি ছেলেকে হাজির না করায় উত্তেজিত জনতা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে বাজারের মাঝ দিয়ে যাওয়া ঢাকা-পাবনা মহাসড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর ১২টার দিকে মহাসড়কে যখন বিক্ষোভ চলাকালীন কিছু যুবক মহাসড়কের পাশের বনগ্রামের ঘোষপাড়া ও সাহাপাড়ায় ভাঙচুর শুরু করে।

তারা প্রথমে সাহাপাড়ায় বাবলু সাহার বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। পরে ঘোষপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের আরও প্রায় ২০-২৫টি বাড়ি ও দুইটি মন্দির ভাঙচুর করে। পরে তারা বনগ্রাম বাজারে বাবলু সাহার দোকানসহ আরো কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করে। এ সময় অন্য দোকানদারেরা বাবলু সাহাকে নিরাপদ একটি কক্ষে লুকিয়ে রাখেন। খবর পেয়ে সাঁথিয়া ও আতাইকুলা থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করলে উত্তেজিত জনতা তাদের বাধা দেয়।

বেলা দেড়টার দিকে পাবনার পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে পুলিশ ও র‌্যাবের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে বাবলু সাহাকে উদ্ধার করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা করে বিক্ষুদ্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আসে। এলাকাবাসীর বক্তব্য, বাবুল সাহা লেখাপড়া জানেন না।

ফেসবুক কি, তিনি তা বোঝেন না। তার ছেলে রাজীব সাহা উপজেলার মিয়াপুর হাজী জসিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। সে ফেইসবুক ব্যবহার করে কি না, সে সম্পর্কে তার সহপাঠী ও প্রতিবেশীরাও কিছুই জানেন না। ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। হামলার সময় তারা অনেকে আত্মগোপন করেন।

পরে সন্ধ্যার দিকে তাদের বেশির ভাগ বাড়িঘরে ফিরে গেলেও এলাকায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। আতাইকুলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কোরবান আলী বিশ্বাসের মতে, তারা এলাকার খোঁজখবর রাখছেন। তবে ঘটনাটিকে উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হচ্ছে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে পাবনার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুন্সি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, আমরা এখনো ঘটনাস্থলেই রয়েছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

এদিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ পাবনা জেলা শাখার সভাপতি চন্দন কুমার চক্রবর্তী। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এ ধরনের কাজ করতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। এটি একটি ষড়যন্ত্র। পাবনার পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার পরপরই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

মহানবী সম্পর্কে আদৌ কোনো মন্তব্য করা হয়েছে কিনা, এ ব্যাপারে পুলিশ নিশ্চিত নয়। তবে এ ধরনের গুজব ও পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে পুলিশ সুপার দাবী করেন। এলাকার পরিস্থিতি আইনশৃংখলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলেও তিনি জানান। এর আগে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে একই ধরনের গুজব ছড়িয়ে বৌদ্ধপল্লিতে হামলা করা হয়েছিল। তখন ১২টি বৌদ্ধবিহার এবং ৩৪টি বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আর পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর পাশের উখিয়া ও টেকনাফেও সাতটি বৌদ্ধবিহার ও ১১টি বসতিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। উত্তম বড়ুয়া নামের এক যুবকের ফেইসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফের অবমাননার ছবি পাওয়া গেছে, এমন অভিযোগ তুলে গুজব ছড়িয়ে তখন ওই হামলা চালানো হলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের তদন্তে তার কোনো প্রমাণ মেলেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, কালী পূজার ঠিক আগে আগে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর কথিত ফেইসবুকের পাতার গুজব ছড়িয়ে আসলে পরিকল্পিতভাবেই এই হামলা করা হল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করা এবং সরকারের মেয়াদ শেষের শেষ সময়ে একটি ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দেওয়াই পাবনার ওই হামলার প্রধান উদ্দেশ্য। আমরা সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর এই হামলার তীব্র নিন্দা জানাই।

পাশাপাশি ওই হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর বিচারের দাবী জানাই। সরকারের মেয়াদ শেষের এই অন্তিমকালে একটি মহল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই দেশের আইন শৃঙ্খলা নষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। কক্সবাজারের রামু'র ঘটনার সুষ্টু তদন্ত ও বিচার হলে, পাবনার সাঁথিয়া'র হামলাও রোধ করা সম্ভব হত। কক্সবাজারের ঘটনা এবং পাবনার ঘটনার মধ্যে ফেইসবুকের কথিত পোস্ট নিয়ে গুজব ছড়ানোর একটি যোগসূত্র রয়েছে। ফেইসবুকের মাধ্যমে আগের ঘটনা ঘটিয়ে হামলাকারীরা যেহেতু আইনের ধরা ছোয়ার বাইরে থাকতে পেরেছ।

তাই তারা একই কৌশলে আবারো পাবনায় পুনঃব্যবহার করলো। বিষয়টিকে কোনোভাবেই হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। রামু'র ঘটনা হালকাভাবে নেওয়ার পরেই পরদিন উখিয়া ও টেকনাফে হামলা হয়েছিল। এখন সাঁথিয়ার হামলাকে গোজামিল দিয়ে চালিয়ে দিলে পরবর্তীতে দেশের অন্যান্য সংখ্যালঘু স্থানে হামলার আশংকা থেকেই যায়। সরকার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দোষীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর সাজার ব্যবস্থা করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, সরকারের অন্তিম কালে যে কোনো স্বার্থান্বেসী মহল আইন শৃঙ্খলা বিঘ্ন করে নানা ধরনের ফয়দা লোটার সুযোগ খুঁজছে। সেটিকে কঠোর হাতে দমন করতে না পারলে সংখ্যালঘুরা আরো আতংকিত হবেন। এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধরে রাখা কঠিন হবে। আমরা চাই, সরকার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করুক। যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার তীব্র প্রতিবাদ করছি।

এবং হামলার সঙ্গে জড়িত ও পরিকল্পনাকারীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির দাবী জানাচ্ছি। বাংলাদেশ একটি অ-সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতি'র দেশ। কোনোভাবেই এখানে সাম্প্রদায়িক হামলা বরদাস্ত করা যায় না।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।