আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৫২ জনের ফাঁসি, যাবজ্জীবন ১৬১

পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৫২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দিয়েছেন আদালত। এঁদের একজন ছাড়া সবাই তৎকালীন বিডিআরের সদস্য। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে ১৬১ জনকে। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পেয়েছেন আরও ২৫৬ জন। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছেন ২৭৭ জন।



মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছেন বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনাকারী উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলম। বিডিআরের বাইরে দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। এঁরা হলেন বিএনপির সাবেক সাংসদ নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলী।
পিলখানা হত্যা মামলার বিচারক মো. আখতারুজ্জামান গতকাল মঙ্গলবার চার হাজার পৃষ্ঠার এ রায় ঘোষণা করেন। তবে আদালতে তিনি শুধু সাজা ও পর্যবেক্ষণ অংশটি পড়ে শুনান।



রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা। একটি বিদ্রোহ থেকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে যে কারণে এ বিদ্রোহ হয়েছে, তা ছিল অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন। সেনাবাহিনীর মনোবল নষ্ট করা, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা এবং দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়াই ছিল হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ।  ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নামে পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে ঘটেছিল এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড।

এ ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। গতকাল বিচারের মুখোমুখি করা হয় ৮৪৬ বিডিআর জওয়ানকে। এই মামলার অন্য চার আসামি বিচার চলাকালে মারা যান। আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা।

রায় ঘোষণার সময় নিহত ১০ সেনা কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

তাঁরা রায় শুনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এই রায়ে বাহিনী কলঙ্কমুক্ত হয়েছে বলে মনে করেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। রাষ্ট্রপক্ষও এতে সন্তুষ্ট।  তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, এটি গোঁজামিলের রায়। এ রায়ের মাধ্যমে তাঁরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

 রায় ঘোষণা উপলক্ষে গতকাল পুরান ঢাকার বকশিবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত মহানগর দায়রা জজ আদালতকে ঘিরে নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। শত শত পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্য চারদিক দিয়ে আদালত এলাকা ঘিরে রাখেন। বকশিবাজার ও উর্দু রোডের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আদালতের ভেতরে ও বাইরে বসানো হয় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। তবে গণমাধ্যমের কর্মীদের জন্য আদালত ছিল উন্মুক্ত।



আদালত ১৫২ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়ে বলেন, মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এঁদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সাধারণ নাগরিক হলেন পিলখানার পাশের এলাকার বাসিন্দা নায়েক সুবেদার (অব.) কাঞ্চন আলীর ছেলে জাকির হোসেন। পিন্টু ও তোরাব আলীকে যাবজ্জীবনের পাশাপাশি পাঁচ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়; অনাদায়ে আরও পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।  ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেককে অস্ত্র লুণ্ঠনের দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এতে করে তাঁদের ৪০ বছরের সাজা হয়।

২৫৬ জনের মধ্যে ২০৭ জনকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে তাঁদের আরেকটি অভিযোগে আরও তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়। এ নিয়ে মোট ১৩ বছর কারাভোগ করতে হবে তাঁদের।

রায়ের শুরু থেকে শেষ: রায় ঘোষণার নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ১০টা। তার আগেই এজলাস ভরে ওঠে দুই পক্ষের আইনজীবী ও গণমাধ্যম কর্মীতে।

সময়মতো কারাগার থেকে হাজির করা হয় ৮৪৬ জন আসামিকে। কিন্তু বিচারকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কেটে যায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা। দুপুর ১২টা ৩৪ মিনিটে এজলাসে আসেন বিচারক মো. আখতারুজ্জামান। শুরুতেই তিনি দেরি হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।  দুই পক্ষের আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিচারক বলেন, ‘আপনাদের কাছ থেকে সব সময় অনেক সহযোগিতা পেয়েছি।

এটা বিচারের প্রথম আদালত। এরপর আরও আদালত আছে। রায় কারও পক্ষে যাবে, কারও বিপক্ষে। আপনারা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। এই রায় প্রস্তুত করার সময় আমি রাজীব গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, মহাত্মা গান্ধীসহ অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা পড়েছি এবং এই রায়ে উদ্ধৃত করেছি।

এভাবে এই রায়কে উন্নত করার চেষ্টা করেছি। ’

এরপর বিডিআর বিদ্রোহের কারণ নিয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন বিচারক। তিনি একে একে রায় ঘোষণা শুরু করেন। অভিযোগপত্রে আসামির নম্বর ধরে ধরে তিনি সাজা ঘোষণা শুরু করেন। দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে তিনি বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের রায় ঘোষণা করছিলেন।

লম্বা এজলাসের প্রায় অর্ধেক অংশজুড়ে আসামিদের কাঠগড়া। বিপুল সংখ্যক আসামির মধ্যে বিচারক যাঁদের নম্বর পড়ছিলেন, তাঁদের আলাদা করে কাঠগড়ার সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। রায় ঘোষণা করার পরপরই তাঁদের বের করে প্রিজনভ্যানে তুলে কারাগারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।  প্রথম দিকে রায় ঘোষণার শুরুতে আসামিদের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। মাঝ পর্যায়ে যখন ২৭৭ জন আসামির নম্বর উল্লেখ করে তাঁদের খালাসের আদেশ দেওয়া হয়, তখন ‘হো হো...’ করে উল্লাসে ফেটে পড়েন তাঁরা।

কেউ কেউ লাফিয়ে বিজয়সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখাতে থাকেন এবং একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন।

এরপর ঘোষণা করা হয় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের নম্বর। কাঠগড়ার সামনের দিকে নিয়ে তাঁদের যাবজ্জীবনের রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। কেউ বলেন, ‘আল্লাহর দরবারে এর বিচার হবে’, কেউ বলতে থাকেন ‘আমি বাইরে ছিলাম, আমি কোনো অপরাধ করিনি’, কেউ বলতে থাকেন, ‘এটা বিচারের নামে অবিচার, এ দেশে কোনো বিচার নাই। ’ জওয়ানদের চিৎকারে এজলাসে তখন কান পাতা দায়।

কেউ তখন উচ্চস্বরে কাঁদছেন। বাধ্য হয়ে বিচারক কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা কী করছেন!’

এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম মাইক্রোফোন নিয়ে আসামিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা প্লিজ কেউ কথা বলবেন না। আমি শুরু থেকে আপনাদের হয়ে মামলা লড়েছি, আপনাদের ওপর আমার একটা অধিকার আছে। এই আদালতের পর আরও আদালত আছে, আমরা সেখানে আপিল করব। দয়া করে কেউ কথা বলবেন না।

’ কিন্তু তার পরও আসামিরা চিৎকার করে নিজেদের নির্দোষ দাবি করতে থাকেন।  এরপর যখন অন্য আসামিদের নম্বর ঘোষণার পর কাঠগড়ার সামনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, অনেকে তখন উচ্চস্বরে দোয়া পড়া শুরু করেন। ১৫২ জনের নম্বর ঘোষণার পর বিচারক বলেন, ‘এই আসামিদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলো। ’ সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁরা। ‘আল্লাহ আল্লাহ’ বলে বিলাপ করতে থাকেন কেউ কেউ।

আবার কয়েকজন তখনো দোয়া পড়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ কাঠগড়ার গ্রিল ধরে লাফিয়ে উঠে বলেন, ‘এই দেশে বিচার নাই...’।  ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের যখন প্রিজনভ্যানে তোলা হচ্ছিল, তখন তাঁদের অনেককে কাঁদতে দেখা যায়। গাড়ির পাশে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের কেউ কেউ গালাগালা দেন। নিজেদের এ পরিণতির জন্য গণমাধ্যমকে দায়ী করেন তাঁরা।


অনেক আসামি ভালোমতো বুঝতে পারেননি, তাঁদের কী সাজা হয়েছে। পরে আদালত আবার বসে ২৪ আসামির রায় পড়ে শোনান। এ কারণে মধ্যাহ্ন বিরতিসহ আদালতকে তিন দফা বসতে হয়।  

কলঙ্কের তিলক উঠে গেছে:
রায় ঘোষণার সময় আদালতে ছিলেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমদ। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘বাহিনীর ওপর কলঙ্কের তিলক ছিল।

এ রায়ের মাধ্যমে সেটা উঠে গেল। বিদ্রোহের সময় যাঁরা মারা গেছেন, এ রায়ে তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে। যাঁরা খালাস পেয়েছেন, আর কোনো মামলা না থাকলে তাঁরা চাকরি ফেরত পাবেন। ’ ২৭৭ জন আসামির খালাসের বিষয়ে জানতে চাইলে আজিজ আহমেদ বলেন, এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা ব্যবস্থা নেবেন।

সন্তুষ্ট রাষ্ট্রপক্ষ: রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মামলার রায় এত কম সময়ে হতে পারে, সেটা ভাবাই যায় না।

মামলার রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এ রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ’ ২৭৭ জন খালাস পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খালাস পাওয়ার ব্যাপারটা খতিয়ে দেখে আপিল করা হবে।  মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। তবে সব আসামির সাজা হলে আমরা বেশি খুশি হতাম।



আপিল করবে আসামিপক্ষ: সবচেয়ে বেশি আসামির আইনজীবী আমিনুল ইসলাম, ফারুক আহাম্মদ ও শামীম সরদার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, এটা একটা গোঁজামিল রায়। এ রায়ে তাঁরা সংক্ষুব্ধ। তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। যাঁদের খালাস দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল, ফাঁসির আদেশ পাওয়া অনেক আসামির বিরুদ্ধেও তা ছিল না। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র একজন।

 নাসির উদ্দিন পিন্টুর আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, পিন্টু রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়ার মতো কোনো অপরাধ তিনি করেননি। আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীর শাস্তি দেওয়ার ঘটনার ভারসাম্য রক্ষার জন্য পিন্টুকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।