১।
বহুদিন দেরি হয়ে গেল। এর মাঝে মান্না দে আর লতা মুঙ্গেশকরকে বিদায় জানালাম। বাঙালি নিউজিল্যান্ডকে ডেকে এনে দৌড়ানি দিল। পাকিস্তান ১০০ করার আগেই অলআউট হইল (আহা, কি শান্তি)।
প্রধানমন্ত্রীর ফোনপেয়ে আবেগাপ্লুত (আ-টা বাদ যাবে) জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত মহিলা আমীর হরতাল প্রত্যাহারের আগাম ঘোষনা বেমালুম অস্বীকার করে ফেললেন। শফি সাহেব চোখের পাত্তি না ফেলে মিথ্যা বলার স্টাইলে তেঁতুল গাছে ফুল ফুটিয়ে নাকে ঘষাঘষি শুরু করলেন। মগবাজারের ফরহাদ সাহেব ‘কথার কথা’ বলতে বলতে টকমারানীদের মহাসমাবেশ করে ফেললেন। পলাতক চৌধুরী মাইনুদ্দিন আর আশ্রাফুজ্জামানের ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়ে গেল। ড. নোবেল মালয়শিয়া গিয়ে সরাসরি বৃহত্তর জামায়াতী জোটের পক্ষে ভোট প্রার্থনায় নেমে পড়লেন।
আর আমি ডিজিটাল জীবনকে সাময়িক বিদায় জানিয়ে এনালগ পরীক্ষা দিতে দিতে হয়রান (হয়রানাবীর না) হয়ে গেলাম। যাকগে, এসেই যখন পড়েছি- একটু গল্প শুনিয়ে যাই। জামাতের হরতাল হবে, আর ককটেল ফাটবে না, বা দুটো রগ কাটা পড়বে না- তাই কি হয়?
২।
হয়রানাবীরের কথায় মনে পড়ে গেল- বেচারা কেয়ামত পর্যন্ত (মিলিটারি ইস্কুলের পরিভাষা, ইস্রাফীলের শিঙ্গার সঙ্গে ইহার কোনও সম্পর্ক নাই; অর্থঃ থামতে না বলা পর্যন্ত চালায়া যাও) পিএইচডি করতে করতে হয়রান। (আফসোস, আজকাল ডক্টরেট ডিগ্রীর কথা শুনলেই আশেপাশের আশেপাশের লোকজন হয় নোবেল লামা নয়ত জোকাই লামার কথা বোঝে।
) অথচ কেবল পিএইচডি থিসিস দিয়েই নোবেল প্রাইজ পাবার ইতিহাস গড়েছিলেন একজন ফরাসী। (এইরে, ফরাসী শুনলেই তারেকাণু তো আবার ফরাসীদের টাই দিয়ে কি করা যায় সে সংক্রান্ত আলী সায়েবের রেফারেন্স দিয়ে বসবেন। ) মজার ব্যাপার হল প্রথমে তিনি ছিলেন ইতিহাসের ছাত্র, পরে সেনাবাহিনী হয়ে পদার্থবিজ্ঞান- এবং বাজিমাত। কদিন আগে সুকুমার রায়ের জন্মদিন গেল, গুরুজী তো বলেই খালাস- “ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল, এতো হামেশাই হচ্ছে!” সবাই বুঝি এইটাকে “ননসেন্স রাইম” এর মত “ননসেন্স ডায়লগ” ভেবেই ক্ষান্ত। অথচ, প্রকৃতিতে এ ঘটনা হামেশাই ঘটছে।
আর পদার্থবিজ্ঞানে তাই এর একটা গানিতিক কাঠামো বড্ড দরকার হয়ে পড়েছিল। এই কাঠামোটাই দাঁড়া করিয়েছিলেন আজকের গল্পের নায়ক যার নাম ‘লুই দ্য ব্রগলি’। তার রূপকথার মত তত্ত্বটা ছিল খুবই সোজাসাপ্টা; সোজা বাংলায়- “বিড়াল বা রুমাল বলে কিছু নাই, সবকিছুই আংশিকভাবে বিড়াল বা আংশিকভাবে রুমাল। যখন লেজে পাড়া খেয়ে সেটা ম্যাঁও করে ওঠে- তখন সেটা বিড়াল। আর যখন তাতে ফ্যাঁচ করে সর্দি ঝাড়া যায়- তখন সেটা রুমাল।
” একটু সবুর করুন, বুঝিয়ে বলি।
৩।
তৃতীয় পর্বে বলেছিলাম না- আলো কখনও কণার মত আবার কখনও ঢেউয়ের মত। আলোর এই দুই নৌকায় পা দেয়া নিয়ে বিজ্ঞানীরা এমনিতেই তিতিবিরক্ত ছিলেন। এমন সময় ইলেকট্রনও যদি দু’বেলা দুই দলে যোগ দেবার হুমকি দেয় তবে তো বিজ্ঞানীদের কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে যাবার দশা।
ঠিক এই সময় দ্য ব্রগলি মশায় তার থিসিস খানা জমা দিয়ে বসলেন। সে এক উদ্ভট ব্যাপার। রুপকথায় এমনতরো প্রায়ই হয়, ব্যাং কে চুমু দিলে রাজকন্যা বেরয়, সাপ খোলস ছেড়ে রাজপুত্র হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ডিম ফেটে মুর্গি কিংবা শুঁয়োপোকা ফেটে প্রজাপতি হয় তা নাহয় সহ্য হল। কিন্তু বলের মত গুঁতোগুঁতি করা ইলেক্ট্রন দেখতে অভ্যস্ত চোখে হঠাৎ তাকে ডেউয়ের মত নর্তন-কুর্দনশীল ভেবে নেয়াটা কষ্টকর বৈকি।
ধরুন মেরিলিন মনরোর সঙ্গে রাত্রিযাপন করতে গিয়ে সকালে জেগে যদি দেখেন এডমিরাল জেনারেল আলাদীনের গলা ধরে শুয়ে আছেন, তখন আপনি যতখানি ভিরমি খাবেন, ইলেক্ট্রনের এই রূপবদল বিজ্ঞানীদের প্রায় ততটাই হতবাক করে দিয়েছিল। তো যা বলছিলাম, ব্রগলি প্রস্তাব করলেন বাস্তবে ইলেকট্রন কেবল কণাধর্মীই নয় তার সঙ্গে ঢেউধর্মীতাও আছে। বৃহত্তর অর্থে খালি ইলেকট্রন না, যেকোনো বস্তুর সঙ্গেই একটি ঢেউ সংশ্লিষ্ট। এই ‘যেকোন’ বস্তুর মধ্য কিন্তু আমি-আপনি, চেয়ার-টেবিল, বই-খাতা, চাঁদ-সুর্য গরু-ছাগল, গোলামাজম-নরেন্দ্রমোদী সব্বাই পড়ে। তবে প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক বলে একটা জিনিস আছে।
ভাগ্যিস সেটার মান ৬.৬৩ কে ১০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০ (১ এর পরে ৩৪টা শূন্য) দিয়ে ভাগ করলে যত হয় তত। তাই বড় একটা জিনিসের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঢেউখানা তেমন বিরক্ত করেনা, কারন সে এতই ছোট যে আসলে পাত্তাই পায়না। কিন্তু জিনিষটা যখন ইলেক্ট্রনের মত একরত্তি, ঢেউ তখন সিন্দাবাদের বুড়োর মত বেশ করে ঘাড়ে চেপে বসে।
৪।
এখন ইলেকট্রন যদি ঢেউয়ের মত হয়েই থাকে তবে অবশ্যই সে ঢেউয়ের মত কাজকর্ম করবে।
আলোর বৃত্তকাওয়াজের গল্প বলেছিলাম মনে আছে? মুশকিল হল ইলেকট্রনকে দুই ছেঁদার মধ্যে দিয়ে পাঠিয়েও ঠিক একই রকম কম-বেশি’র ব্যাতিচার নকশা পাওয়া গেল- অর্থাৎ ঢেউয়ের মত তাকে হতেই হবে। ঢেউয়ের আরেকটা আচরণ হল অপবর্তন। এই জিনিষটা আলোর ক্ষেত্রে দেখাতে বিজ্ঞানীরা ব্যাবহার করেন গ্রেটিং। সে বড্ড ভয়ানক জিনিস- তাতে ১ সেন্টিমিটারের মধ্যে ৫ বা ১০ হাজার সূক্ষ্ম সাদাকালো দাগকাটা থাকে। এতে আলো ফেললে কোথাও তা প্রতিফলিত হতে পারে, কোথাও আটকে যায়।
কিন্তু ফিরে আসা আলোরা মিলেমিশে এমন এক নকশা সৃষ্টি করে, যে তা কেবল ঢেউয়ের পক্ষেই সম্ভব হত। এখন ইলেকট্রনের ঘাড়ে যে ঢেউত্ব চেপে বসেছে তার তাত্ত্বিক আকৃতি আবার আলোর চাইতেও ছোট। অর্থাৎ তার অপবর্তন দেখতে হলে সেন্টিমিটারে ১০ হাজার দাগকেটেও লাভ নেই, আরো বহুগুনে সূক্ষ্ম হতে হবে- তবে উপায়? এখন বিজ্ঞানীরা যেহেতু সারাদিন নাকে ফুল ঘষাঘষি করতে ব্যাস্ত থাকেন না তারা ঠিকই একটা উপায় বের করে ফেললেন। তারা প্রাকৃতিক বস্তুর টুকরাকেই গ্রেটিং হিসাবে ব্যাবহার করলেন। অর্থাৎ, অণুর সারি আর তার মাঝের ফাঁকা যায়গাটাই হল তাদের গ্রেটিঙের সাদা আর কালো।
তারপর ইলেকট্রন দিয়ে তাতে গোলাগুলি, আর ফলাফল তো বলাই বাহুল্য। (টিনটিনের টমসন ভাইয়েদের মত পদার্থবিজ্ঞানের টমসন বাপ-বেটাও একটা হাসির খোরাক। বাবা টমসন যেখানে ১৯০৬ সালে প্রমান করলেন ইলেকট্রন আসলে কনার মত, ছেলে টমসন কিনা ১৯৩৭ সালে প্রমান করে বসল ইলেক্ট্রন আসলে ঢেউয়ের মত। ব্যাটা পিতৃঘাতী। )
৫।
নীলস বোরের গল্প মনে আছে তো? ব্রগলির এই তত্ত্বে খুব সুবিধা হয়েছিল তাঁর। বেচারা তাঁর তত্ত্ব নিয়ে খুব অস্বস্তিতে ছিলেন। তিনি ইলেক্ট্রনের ফ্ল্যাটবাড়িগুলোকে বেশ করে খণ্ড খণ্ড (অর্থাৎ কোয়ান্টায়িত) করেছিলেন বটে, কন্তু সেটা কোনভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন না। ওদিকে পরীক্ষালব্ধ তথ্যও সমর্থন করছিল তাঁকে। এসময় তাঁকে দু দন্ড শান্তি দিয়েছিলেন প্যারিসের লুই ব্রগলি।
ইলেকট্রনের ফ্ল্যাটবাড়ি গুলো কাটা কাটা হতেই হবে কারন তার বাসিন্দা আসলে ঢেউয়ের মত। তাও আবার যেনতেন ঢেউ নয় নির্দিষ্ট সাইজের ঢেউ। একটা কাপড় শুকানো দড়ি বা তারের দুই মাথা টানটান করে বেঁধে নাড়ালে কি হয় দেখেছেন কখনও? দুই মাথা যেহেতু বাঁধা গরুর মত আটকা, তারা মোটেই নড়েনা, নড়ে মাঝখানটুকু। আর সেটা এমন একটা ঢেউ বানিয়ে নড়তে বাধ্য হয় যেন ঢেউগুলী দড়িটাকে সমান কয়েক অংশে ভাগ করে নেয়। সেই টুকরো গুলো হয় তারের ঠিক অর্ধেক নতুবা এক-তৃতীয়াংশ, কিংবা এক চতুর্থাংশ।
ইলেকট্রনও তার পারমানবিক ফ্ল্যাটবাড়িতে ঠিক তেমনিভাবেই আটকা পড়ে। তাই তার বিচরনক্ষেত্র হয়ে পড়ে কাটা কাটা, সুনির্দিষ্ট।
৬।
তারের ঢেউ না বুঝলে নিচের প্রথম ছবিটা দেখে আসুন। এখানে তারের দৈর্ঘ কিন্তু ঢেউয়ের আকার নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে।
কিংবা উলটা ভাবে বললে, ঢেউয়ের আকার ঠিক করে দিলে সেটাই তারের দৈর্ঘ ঠিক করে দেবে- যেকোন দৈর্ঘের তারে আমরা তাকে আঁটাতে পারবনা। ইলেকট্রন যখন পরমানূর চারপাশে দৌড়ে বেড়ায় তখন তার শক্তি নির্দিষ্ট মানে তার তরঙ্গের আকারও নির্দিষ্ট থাকে। আর তার ফলাফল- চাইলেই সে যেকোন সাইজের ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়ে বসতে পারেনা। অলিম্পিকে হার্ডল রেস দেখেছেন? ওই যে একটু পর পর কোমর সমান বেড়ার মত কি জানি কি দেয়া থাকে, দৌড়াতে দৌড়াতে সেগুলোকে লাফিয়ে পার হতে হয়, সময় মত লাফাতে না পারলেই পপাত ধরণীতল। এখন কোনও দৌড়বিদের প্রতি কদমের মাপ যদি নির্দিষ্ট হয়, সে কিন্তু চাইলেই যেকোন মাপের ট্র্যাকে এই দৌড় দিতে পারবে না।
কারন তার কদমের সাথে মিলিয়ে একেকটা হার্ডল বসাতে হবে, আর সেগুলোকে গোল একটা ট্র্যাকে সমান দুরত্বে বসালে ট্র্যাকের দৈর্ঘ ইচ্ছামত ঠিক করা যাবেনা। যদি এমন হয় যে দৌড়বিদের এক কদমে ৩ ফুট গিয়ে তারপর লাফাতে পারেন তাহলে হার্ডল বসাতে হবে ৩ ফুট পরপর। তখন ট্র্যাক কিন্তু হতে হবে ৩ ফুট, কিংবা ৬ ফুট, কিংবা ৯ ফুট এমন। কারন সাড়ে সাত ফুট ট্র্যাক হলে দেখা যাবে শেষ মাথায় পৌঁছে বেচারা দৌড়বিদ আছেন কদম ফেলার মাঝপথে, অর্থাৎ- ধুরুম! (বাস্তবে অবশ্যই দৌড়বিদের মাপে ট্র্যাক করা হয়না, বরঞ্চ ট্র্যাকের মাপেই দৌড়বিদেরা কদম ফেলার অনুশীলন করেন। তবে আলোচ্য দৌড়বিদ জামায়াতের সদস্য হলে তার জন্য কি করা হবে আমি নিশ্চিত নই।
)
৭।
ভাগ্যিস ইলেক্ট্রন ঢেউয়ের মত, নইলে সর্বনাশ হয়ে যেত। আলো দিয়ে আমরা একটা মাত্রা পর্যন্ত ছোট জিনিস বড় করে দেখতে পারি, তারপর আলো বিব্রতবোধ করে। তাই সাধারন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে একটা পর্যায়ের পরে আর বিবর্ধন সম্ভব না। (ধরেন আপ্নার মোবাইলের ক্যামেরাটা ১০X পর্যন্ত জুম করতে পারে এখন ১৫X দরকার হলে কিন্তু চাইলেও পারবেননা, লিমিট শেষ।
) এইখানেই আমাদের সাহায্য করে ইলেকট্রন (আগেই বলেছি, তার ঘাড়ে চাপা ঢেউটা আলোর চাইতে ঢের ছোট)। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের বিস্তারিত গল্প আরেকদিন, আপাতত এতে তোলা একটা ছবি দেখুন এখানে। এদেরকে ডাইনোসর সাইজের প্রাগোইতিহাসিক কোন জীব ভাববেননা আবার। এরা মামুলী পোকামাত্র। ঠিক জামায়াতের মত, কিন্তু কাছে থেকে দেখলেই ভয়ঙ্কর।
পাদটিকাঃ বৃহত্তর জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত গদীনশীন মহিলা আমীর সম্ভবত ভোমা সাইজের সানগ্লাসের জন্য চোখে ভাল দেখেন না। আচ্ছা, তাকে একটা ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখালে কি মিলনের হতভাগ্য দেহটা পরিস্কার দেখতে পাবেন? আমি জানি না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।