মিসরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডের আরও ১৪ জনের বিচার কার্যক্রম একটি আদালত আগামী ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করার এক দিন পর আমি এই নিবন্ধ লিখছি। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ এলাকায় সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে তাঁদের বিচার হচ্ছে। আরও তদন্তের জন্য আদালতের বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ার পর মুরসিকে হেলিকপ্টারযোগে উড়িয়ে নেওয়া হয় আলেক্সান্দ্রিয়ার বোর্গ আল-আরব কারাগারে। তিনি তাঁর কয়েদির পোশাক পরতে অসম্মতি জানিয়েছেন এবং নিজেকে মিসরের বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লেখ করেন।
২০১১ সালের ৩ আগস্ট, মিসরীয়রা হোসনি মোবারককে গরাদের পেছনে দাঁড়াতে দেখেছিল।
শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের হত্যা এবং দুর্নীতির অভিযোগে মামলায় তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। আর মোবারকের ওই বিচারের ৭৯১ দিন পর ২০১৩ সালের ৪ নভেম্বর একই খাঁচার মধ্যে দাঁড়ালেন মুরসি। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধেও। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মুরসির বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ওই বিচার নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন আইনি ও রাজনৈতিক প্রশ্ন উঠেছে।
আইনি বিবেচনায়, কেউ কেউ এই বিচার-প্রক্রিয়াকে মিসরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচনা করেন। আবার অন্যদের মতে, এটি একটি অন্যায় বিচার, যা ‘বৈধতার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের’ পরিণাম। রাজনৈতিক পর্যায়ে, মিসরের অন্তর্বর্তী সরকার তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বিচারটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশটিতে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার চেষ্টা আবার নিশ্চিত করার জন্যও ওই বিচার গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে অন্যরা মনে করছে বিচারটি মিসরের চলমান রাজনৈতিক সংকটকে আরও গুরুতর পর্যায়ে নিয়ে যাবে এবং আরও বিক্ষোভ ও অস্থিতিশীলতার সুযোগ তৈরি করে দেবে।
পরিণামে অর্থনীতি আরও সংকটে পড়বে এবং বিনিয়োগ ও পর্যটন বিপন্ন হবে।
মুরসির বিচারের বিরুদ্ধে যাঁরা সবচেয়ে জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আবদেল মোনিম আবুল ফতুহ। তিনি কয়েক দশকব্যাপী মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। টুইটারবার্তায় আবুল ফতুহ লিখেছেন, ‘মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে এই প্রহসনমূলক বিচারের আওতায় আনার কলুষ থেকে দেশটির সৎ নাগরিক ও বিচারকেরা মুক্ত রয়েছেন। ’ তিনি আরও লিখেছেন, সেই সৎ মিসরীয়রা প্রেসিডেন্টকে এভাবে অপমান করার সঙ্গে জড়িত সবাইকে অভিশাপ দেয়।
রাজনীতিবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ আহমেদ আবদ্রাবো ওই বিচারের আগের দিন আল-শরুক পত্রিকায় লিখেছেন, মুসলিম ব্রাদারহুড ও দলটির নেতারাই গত ৩ জুলাইয়ের পরের ঘটনাবলির জন্য দায়ী। ব্রাদারহুড একটি ন্যায়বিরুদ্ধ বিচার চাইছে, যা ক্ষমতা ধরে রাখতে তাদের জন্য সহায়ক হবে, এমনকি মানুষের জীবনের বিনিময়ে হলেও— আর ঠিক তা-ই ঘটেছে যখন দলটির নেতারা বিক্ষোভে অংশ নিতে সমর্থকদের উৎসাহিত করেছেন, তাঁদের জন্য স্বর্গের প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
আবদ্রাবো আরও লিখেছেন, ব্রাদারহুড নেতাদের বক্তৃতা শুনে সমর্থকেরা অনুপ্রাণিত হয়ে রাস্তা দখল করে। তারা একটি ব্যর্থ সংগঠন ও নির্বোধ নেতৃত্বের জন্য শাহাদাতবরণের স্বপ্ন দেখতে থাকে, যাদের একমাত্র লক্ষ্য রাজনৈতিক ফায়দা। এভাবেই অবিচার সংঘটিত হয় এবং অনেকে প্রাণ হারায় এমন একটি রাষ্ট্রের জন্য, যেটি সহিংসতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের অবস্থান পুনর্বহাল করতে চায়।
আর তারা এমন একটি সংগঠনের মাধ্যমে কাজটি করতে চায়, যা মানুষের রক্ত চায় এবং শাহাদাতবরণের আহ্বান জানায়।
আরেকটি আকর্ষণীয় বিশ্লেষণ করেছেন মার্ক লিঞ্চ। মধ্যপ্রাচ্যে গণজাগরণের ব্যাপারে এই বিশেষজ্ঞ ফরেন পলিসি সাময়িকীতে লিখেছেন, আরব দেশগুলোতে মৌলিক অবক্ষয় শুরু হয়েছে। তিনি আরও লিখেছেন, মিসরে রাষ্ট্রবিরোধী ক্ষোভকে দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং সেই জনমতকে অভ্যন্তরীণ শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন।
লিঞ্চ ব্যাখ্যা করেছেন, স্থিতিশীল অবস্থা অর্জন করতে চাইলে কোনো ধরনের নিপীড়নের কাছে আত্মসমর্পণ করা জনগণের উচিত হবে না।
২৫ জানুয়ারির সেই গণবিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগে মিসরের কেউ কল্পনাও করেনি যে দেশটির দুজন স্বৈরতান্ত্রিক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রেসিডেন্টকে কেবল উৎখাতই নয়, বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে দেখা যাবে—যাঁদের একজন ৩০ বছরব্যাপী দেশ শাসন করেছেন আর অপরজন কেবল এক বছর। বিচারের রায় কী হবে, তাতে কিছু যায় আসে না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, মিসরের জনগণ তিন বছরের কম সময়ে তাঁদের দুজনকেই ক্ষমতাচ্যুত করেছে। আশা করা যায়, এটি পরবর্তী প্রেসিডেন্টদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে যে মিসরীয় রক্ত মোটেও সস্তা নয়।
মিসরে ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাইয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হলেন মুরসি।
জেনারেল মোহাম্মদ নাগিবকে ১৯৫৪ সালে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়। তারপর ২০১১ সালে হোসনি মোবারক আর অবশেষে ২০১৩ সালে মুরসিরও একই পরিণতি হয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের একসময়ের জ্যেষ্ঠ সদস্য মুরসিকে গত জুলাইয়ে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনী। এর আগে তাঁর শাসনের অবসান দাবিতে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। লাখ লাখ মানুষ তাঁর পদত্যাগের দাবিতে স্বাক্ষর করে।
মুরসি যখন মোবারকের শাসনামলের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিককে পরাজিত করে ২০১২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সময় গণতন্ত্রের মূলনীতির প্রতি সম্মান দেখানোর অঙ্গীকার করেছিলেন। মুরসি মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রথম প্রার্থী ছিলেন না। নির্বাচন কমিটি খাইরাত আল-শাতেরের প্রার্থিতা বাতিল করে দেওয়ার পরই মুরসিকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করা হয়েছিল। ফলে তিনি পেয়ে যান বিখ্যাত ‘বাড়তি টায়ার’ উপাধিটি।
মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি এমন আচরণ শুরু করলেন যেন মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্দেশনা অনুসারেই দেশ পরিচালিত হয়।
ক্ষমতাচ্যুত ওই প্রেসিডেন্ট গত নভেম্বরে একটি সাংবিধানিক ফরমান (ডিক্রি) জারি করেছিলেন। অনেকেই এটিকে ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ আখ্যা দেন এবং প্রত্যাখ্যান করেন। সাংবিধানিক ডিক্রিগুলোই জনমনে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে প্রথম ক্ষোভের সঞ্চার করে। তখন বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে সমবেত হয়।
মুরসি ও মোবারকের বিচার-প্রক্রিয়ার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তার মধ্য দিয়েই সংক্ষেপে মিসরের বর্তমান পরিস্থিতির প্রতীকী উপস্থাপন ঘটে।
মোবারক ও মুরসির বিচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবধানগুলো হচ্ছে:
১. মোবারক কাঠগড়ার খাঁচায় প্রবেশ করেন ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সাত মাস পর। আর মুরসি যান তাঁর উৎখাতের চার মাস পর।
২. মোবারককে একটি হাসপাতালের বিছানা থেকে আদালতে নেওয়া হয়, কিন্তু মুরসিকে নেওয়া হয় একটি অজ্ঞাত স্থান থেকে এবং তিনি সুস্থভাবেই কাঠগড়ায় দাঁড়ান।
৩. মিসরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন মোবারকের বিচার কার্যক্রম সরাসরি সম্প্র্রচার করে।
কিন্তু মুরসির বিচার কার্যক্রম সেভাবে প্রচার করা হয়নি। (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ধারণকৃত কিছু দুর্বল ভিডিওচিত্র প্রচার করা হয়)
৪. মোবারক সাদা পোশাক পরলেও মুরসি কালো স্যুট পরে আদালতে হাজিরা দেন। এতে প্রধান বিচারক আদালত মুলতবি করেন।
৫. মোবারক কালো সানগ্লাস পরেছিলেন উপস্থিত অন্যদের (তাঁর ছেলে গামাল ও আলা) চোখে চোখ পড়ার মতো পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য। এ ছাড়া তিনি ক্যামেরা থেকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে, মুরসি কাঠগড়ায় প্রবেশ করেন হাসিমুখে!
৬. বিচারকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন মোবারক। তিনি বিচারের নিয়মকানুন পালন করেন। কিন্তু মুরসি বারবার বলতে থাকেন, তিনিই দেশের বৈধ প্রেসিডেন্ট এবং ওই বিচার অবৈধ।
৭. প্রথম সেশনে মোবারক কোনো কথা বলেননি এবং তাঁর পরিবর্তে তাঁর আইনজীবী কথা বলেন। কিন্তু মুরসি কোনো আইনজীবী নিয়োগ করার প্রস্তাব মেনে নেননি এবং গরাদের ভেতর থেকে নিজেই কথা বলেন।
৮. মোবারক ও তাঁর ছেলেরা একই খাঁচার ভেতরে ছিলেন। কিন্তু মুরসি ও তাঁর সহযোগীরা সবাই মিলে একটি খাঁচায় দাঁড়িয়েছিলেন।
৯. সবশেষে, মোবারককে তাঁর অসুস্থতার কারণে তোরা হাসপাতালে পাঠানো হয়—যেটি একটি জনবহুল এলাকায় অবস্থিত। কিন্তু মুরসিকে একটি প্রত্যন্ত এলাকায় পাঠানো হয় নিরাপত্তার স্বার্থে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কামাল গাবালা: মিসরের আল-আহরাম পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
kgaballa@ahram.org.eg
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।