আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"কীশ দ্বীপ" -ইরানের পারস্য উপসাগরের মুক্তা

আমি মানি, জানি, মানুষকে ভাল বাস, মানুসের সেবা করো, আল্লাহ খুশি হবে, আল্লাহকে পাবে।

আমরা একটু চেষ্টা করলেই জানতে পারি ইসলামের ইতিহাস ইরানের একটি সুন্দর দ্বীপের কথা, আমামদের সেন্ট মাটিন দ্বীপের চাইতে অনেক অনেক গুন সুন্দর এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি আরব্য দ্বীপের কথা। পারস্য উপসাগরের উত্তরাঞ্চল এবং কেন্দ্রীয় অঞ্চল জুড়ে ৯১ বর্গ কিলোমিটার স্থানব্যাপী এই দ্বীপটি অবস্থিত। দ্বীপটির আকৃতি ডিমের মতো অনেকটা। পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত কীশ দ্বীপের দৈর্ঘ্য হলো ১৫ কিলোমিটার।

আর উত্তর দক্ষিণে দ্বীপটির প্রস্থ হলো প্রায় ৮ কিলোমিটার। কীশ দ্বীপের সর্বোচ্চ স্থানটির উচ্চতা হলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৫ মিটার। ইরানের দক্ষিণ উপকূল থেকে এর দূরত্ব হলো ২০ কিলোমিটারের মতো। ইরানের পারস্য উপসাগরে যতোগুলো গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ রয়েছে সেসবের মাঝে কীশ দ্বীপটি অন্যতম। সমগ্র বিশ্বের সাথে ইরানের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এই দ্বীপটির ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

বেশ পুরনো এই দ্বীপটি তার অস্তিত্বের ইতিহাসে বহু চড়াই উৎরাই দেখেছে, দেখেছে অনেক ভাঙা গড়া। তারপরও আজো অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। কীশ দ্বীপটি নৌচালনা এবং মুক্তা কুড়ানোর জন্যে বিখ্যাত। এজন্যে কীশের আলাদা একটা গুরুত্ব রয়েছে। কীশের আবহাওয়ায় আর্দ্রতা রয়েছে বেশ।

সমুদ্রের তীরে অবস্থানের কারণেই আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি। আর উষ্ণতার মাত্রাও অনেক। বছরের কোনো ঋতুতেই এমনকি প্রচণ্ড শীতেও কীশের আবহাওয়ায় উষ্ণতার পরিমাণ ১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নীচে নামে না। বছরের ছয় মাস মোটামুটি গরম থাকে এখানকার আবহাওয়া আর বাকি ছয় মাস বেশ উপভোগ্য আবহাওয়া বিরাজ করে। কীশকে কবি ফররুখের ভাষায় প্রবালদ্বীপও বলা যেতে পারে।

প্রচুর পরিমাণ প্রবাল এখানে রয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে থেকে এখানে মানব বসতি গড়ে উঠেছে। কীশের সংস্কৃতি যেমন প্রাচীন তেমনি সমৃদ্ধ। তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবেও প্রাচীনকাল থেকেই কীশের খ্যাতি ছিল। ইতিহাস এবং ভূগোলের বহু বইতে অবশ্য এই দ্বীপটির বিচিত্র নাম পাওয়া যায়।

যেমন কীশ, কামতিনা, আরিয়ান, কেইস এবং আরো অনেক নাম। ভেনিস পর্যটক মার্কোপুলু তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেছেন তিনি চীন সম্রাটের স্ত্রীর গলায় মুক্তার মালা দেখে বিস্মিত হন। আরো লিখেছেন ঐ মুক্তাগুলো কীশ দ্বীপ থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছিল। ইরানের কালজয়ী কবি সাদিও সপ্তম শতকে তাঁর বিখ্যাত ‘গোলেস্তান’ কাব্যগ্রন্থে কীশ দ্বীপ প্রসঙ্গে লিখেছেন। তৎকালীন কীশের মর্যাদা, ব্যাপক বিস্তৃতি এবং কীশের বাণিজ্যিক লেনদেনের বিষয়টিই তিনি তুলে ধরেছিলেন তাঁর লেখায়।

আরো অনেক পুরনো বইতেও কীশের বিচিত্র ব্যবস্থাপনার কথা লক্ষ্য করা যায়। যেমন জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদের পর প্রাসাদ, চমৎকারসব বাগ বাগিচা, পানি সরবরাহ করার অভিনব ব্যবস্থা ইত্যাদি। আর এসব থেকেও প্রমাণিত হয় বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্যে কতোটা প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল দ্বীপটি। সেইসাথে জনবসতি যে প্রচুর ছিল সেটাও সহজেই উপলব্ধি করা যায়। কীশের এতোসব সুযোগ সুবিধা আর আনুকূল্যের কারণে এবং সেখানকার জনগণের সহযোগিতায় ইরানের সর্বপ্রথম ফ্রি ট্রেড জোন হিসেবে দ্বীপটি সমৃদ্ধি লাভ করে।

বাণিজ্য ছাড়াও শিল্প এলাকা এমনকি টুরিস্ট স্পট হিসেবেও কীশ দ্বীপটি বেশ নামকরা। সমগ্র দ্বীপের শতকরা প্রায় ৫৫ ভাগ এলাকা পর্যটনের জন্যে নির্দিষ্ট, শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ এলাকা রাখা হয়েছে শিল্পের জন্যে আর ১৫ থেকে ২০ ভাগ এলাকা বাণিজ্যিক কাজের জন্যে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আরো বেশ কিছু এলাকা রাখা হয়েছে ভবিষ্যৎ কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে। পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে কীশ হয়ে উঠেছে দর্শনীয় একটি দ্বীপ।

এইসব ব্যবস্থাপনার কারণে ইরানের ফ্রি ট্রেড জোনগুলোর মাঝে এই কীশ দ্বীপটি কেবল বিদেশী পর্যটকদের ট্যুর থেকেই সর্বোচ্চ আয় দেখাতে সক্ষম হয়েছে। ইরানের কীশ বাণিজ্য ও পর্যটন কেন্দ্র প্রমাণ করেছে ইসলামী সমাজের সকল মূল্যবোধ তথা সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সকল মূল্যবোধ অক্ষুণ্ণ রেখেও লক্ষ লক্ষ বিদেশী পর্যটককে আকৃষ্ট করা যায় এবং সেই সুবাদে অর্জন করা যায় বিদেশী মুদ্রাও। বিদেশী মুদ্রা অর্জন করার চমৎকার একটি উৎস এই পর্যটন কেন্দ্র। এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যেমন আসে তেমনি ইরানও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পরিচিতি পায়। কীশ দ্বীপে রয়েছে উপকূলীয় বৈচিত্র্য, রয়েছে স্ফটিক স্বচ্ছ পানি, বহুরকমের প্রবাল, বিচিত্র রঙের অ্যাকুরিয়ামের মাছ এবং সর্বোপরি কীশে রয়েছে মন কেড়ে নেওয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

এগুলো কীশ দ্বীপ দেখতে যাওয়া যে কোনো দর্শক বা পর্যটককেই যে নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট করবে তা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। সবমিলিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিশেষ করে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত হল পৃথিবীর মধ্যে এমন একটি দ্বীপ একেবারেই বিরল যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলোকে মোটামুটি একসাথে দেখতে পাওয়া যায়। কীশ দ্বীপের অন্যতম একটি দর্শনীয় এবং প্রাচীন স্থান হলো ‘হারিরা’ নামক পুরনো শহর। দ্বীপের উত্তরাঞ্চলে এই শহরটি অবস্থিত। এই শহরটি হিজরি অষ্টম শতকের বলে ইতিহাসে জানা যায়।

হারিরা শহরের প্রাচীন নিদর্শনগুলো দর্শকদের নিয়ে যায় সময়ের পর্দা ভেদ করে ইতিহাসের অনেক পেছনে। সেখানে নিয়ে গিয়ে এই চমৎকার প্রবাল দ্বীপের প্রাচীন বাসিন্দাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ৮০০ বছর আগে হারিরা শহরটির ওপর হামলা হয়েছিল। তার আগে যারা ওই শহর দেখতে গিয়েছিল তারা বলেছে সেখানে সাত তলা প্রাসাদ ছিল দেখার মতো। সেইসাথে ছিল সুন্দর সুন্দর বাগবাগিচা।

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইয়াকুত হামাভি তাঁর বইতে লিখেছেন পারস্য উপসাগর এবং ভারতের মাঝে যেসব জাহাজ যাওয়া আসা করতো, সেগুলো এই কীশ হয়ে যেত। কীশের আরেকটি দর্শনীয় স্থাপনা হলো শেইখ আলে আলি ভবন। শেখ আলে আলি ছিলেন কীশ দ্বীপের সাবেক শাসক। সমুদ্রের পাড়ে যে সুরম্য প্রাসাদ তিনি গড়ে তুলেছেন তা বিচিত্র দিক থেকে অনন্য সাধারণ। স্থাপত্য কৌশলের দিক থেকে অনেকেই কাজারি রাজবংশের শাসনামলের স্থাপত্যের সাথে মিলে যায় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

সব মিলিয়ে আল্রাহু তায়ালার একটি অপরুপ মেহেরবানীতে পরিপূর্ন নেয়ামতের নির্দশন মাত্র। (বি:দ্র: ইরানি ইতিহাস থেকে অনুদিত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।