আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এমন মায়ার মানুষ কোথায় পাব?

এমন মায়ার মানুষ কোথায় পাব...

স্যারকে ছাড়া এত তাড়াতাড়ি স্যারের জন্মদিন পালন করতে হবে, তা কখনো ভাবতে পারিনি। জানি শুধু আমি নয়, স্যারের যারা ভক্ত তারাও হয়তো ভাবতে পারেনি, স্যারকে ছাড়া এত তাড়াতাড়ি জন্মদিন পালন করতে হবে।

স্যারের জন্মদিনে অনেক মজা হতো। আমরা স্যারের নুহাশ পল্লী অথবা দখিনা হাওয়ার বাসায় যেতাম। 'ওল্ড ফুলস ক্লাব' নামের স্যারের একটি ক্লাব ছিল।

স্যারের প্রিয়ভাজনেরা প্রায় সবাই এ ক্লাবের সদস্য। তার মধ্যে আমিও এক সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। স্যার বেঁচে থাকতে তার জন্মদিনে ওই ক্লাবের প্রায় সবাই মিলে কেক কাটতাম, গান করতাম। গানের ফাঁকে ফাঁকে আমরা হারিয়ে যেতাম স্যারের গল্পের মধ্যে। স্যার আমাদের তার জীবনের কথা বলতেন, জীবন দর্শনের কথা শোনাতেন।

আমার স্ত্রী তানিয়ার ছোটভাই মানে আমার শ্যালক, তার নাম অমিতাব। ওর জন্মদিনও ১৩ নভেম্বর। প্রতি বছরই আমি আর তানিয়া পড়তাম বিপদে। একমাত্র শ্যালকের মনরক্ষা করব, না স্যারের কাছে যাব। আমরা বুদ্ধি করে রাত ১২টার পর ওকে নিয়ে স্যারের বাসায় চলে যেতাম।

অনেক রাত পর্যন্ত চলত আমাদের গল্প, গান, আর আড্ডা। আমরা সবাই স্যারের সঙ্গে আমাদের সমস্যা, ভালোলাগা, মন্দলাগা শেয়ার করতাম। আর স্যার আমাদের প্রিয় বন্ধুর মতো তার সমাধান দিতেন। এমন মায়ার মানুষ কোথায় পাব। স্যারের ৬৪তম দিনে আমরা নুহাশ পল্লীতে ৬৪টি গাছ লাগিয়েছিলাম।

নানাজাতের এই গাছগুলো আজও নুহাশ পল্লীতে আছে কিন্তু নুহাশের ওই মায়ার মানুষটি আজ আমাদের পাশে নেই। আমি স্যারের প্রতি জন্মদিনেই চেষ্টা করতাম একটি করে নতুন গান উপহার দিতে। আর তারই ধারাবাহিকতায় এবারের জন্মদিনে আমি স্যারকে নিয়ে একটি গান গেয়েছি। গানটির শিরোনাম হচ্ছে 'আমি ভালোবাসি তোমায়'। গানটির কথা লিখেছেন কাজী মোমেনুল ইসলাম ও আমি।

আর সংগীতায়োজন ও কণ্ঠ দিয়েছি আমি। গানটি আজ বাংলাভিশনে একটি ফোনোলাইভ অনুষ্ঠানে আমি গাইব।

স্যারের জন্মদিনের অনেক ঘটনা আজও আমাকে কাঁদায়, হাসায়। একটি ঘটনা বলি। স্যারের জন্মদিনের কিছুদিন আগে স্যার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

আমার হাতে একটি গান ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটি সুর করে নিয়ে আস। গানটির নাম ছিল 'ময়ূরাক্ষী'।

এ গানটির মধ্যে স্যারের ব্যক্তিগত জীবনের একটি গল্প লুকিয়ে আছে। ওই সময়টায় শাওনের মনটা নাকি অনেক খারাপ ছিল। শাওনের অভিযোগ, স্যার নাকি শাওনকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যান না অনেক দিন ধরে।

স্যার আমাকে বললেন, টুটুল আমিতো গেছি। এ গানটি তুমি সুর কর আর কুসুমকে শোনাও, আমার বিশ্বাস তার মন ভালো হয়ে যাবে। আমি গানটি নিয়ে চলে আসলাম। গানটিতে সুর বসালাম। স্যারের জন্মদিনের আগের দিন রাত ১২টার মধ্যে অনেকেই স্যারের বাসায় উপস্থিত হয়।

আমি তখনো পৌঁছায়নি। আমি রাত ২টার দিকে স্যারের বাসায় পেঁৗছলাম। আর সবাই দেখলাম একটু মুখ ভার করে আছে। আমি কথা না বলে সবাইকে বললাম, আপনারা সবাই একটু চুপ করেন, আমি এখন একটি গান গাইব। সবাই চুপ করল।

আমি গানটি শুরু করলাম। গানটি গাওয়া শেষে আমি দেখলাম শাওন বুবু, তানিয়া, স্বর্ণার চোখে জল। গানটির কথা শুনে প্রায় সবাই সেদিন কেঁদেছিলেন। আমি স্যারের চোখেও সেদিন জল দেখেছিলাম। আমি তখন সবাইকে বললাম।

গানটি স্যার লিখেছেন। আমি শুধু সুর লাগিয়েছি। স্যার তখন আমাকে বললেন, 'আমি যখন একটি গান লিখি, তার আমার মাথায় একটি সুর খেলতে থাকে। আমি তো গান গাইতে পারি না, তাই সেই সুরটাও শোনাতে পারি না। তখন আমি স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম।

স্যার আমি যে সুরগুলো করি তার সঙ্গে কি আপনার সুরের কোনো মিল আছে? স্যার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, কিছুটা তো মিল আছেই। তখন আমি স্যারের কাছে আবার জানতে চাইলাম, আমারটা ভালো না আপনরটা ভালো? স্যার হেসে বললেন, 'নিজেরটাকে খুব রসগোল্লা মনে হচ্ছে, না। আমারটাই ভালো যাও। আমি স্যারকে বললাম, স্যার আপনার সুরটা একটু গেয়ে শুনান না। তাহলে বুঝতে পারব কারটা ভালো।

স্যার কথা বললেন, ওটা যদি পারতাম তাহলে তোমাকে কি ডাকতাম। এভাবে অনেক আড্ডা, রসিকতায় কেটেছে কত সময়। একটা সুরকারের জন্য একটি গান সুর করে, সেই গানটি শোনানোর পর যদি কারও চোখের পানি পড়ে, আর তিনি যদি হয় আমাদের স্যার হুমায়ূন আহমেদ, তাহলে একটি শিল্পীর জীবনে আর কি বেশি কিছু চাওয়ার থাকে। স্যারের সঙ্গে এমন অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার। আমি স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি।

স্যার বলতেন, 'জীবনের মধ্যে অনেক দুঃখ-কষ্ট থাকবেই। এগুলোকে এনজয় করতে হবে। কারণ কষ্টেও একটি স্বাদ আছে। স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন এ কথাটি আমি বিশ্বাস করি না। তিনি আমাদের হৃদয়জুড়ে আছেন।

প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের পাশে আছেন। এখন আমি যখন নুহাশ পল্লীতে যাই, আমি স্যারকে খুঁজে পাই নুহাশ পল্লীর প্রতিটি কোনায় কোনায়। চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই স্যার আমার পাশে পাশে আছে। যখন চোখ মেলে তাকাই তখন আর দেখতে পাই না। মুক্তিযুদ্ধে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি আর সেই জায়গাটাতে আমি স্যারকে বসিয়েছিলাম।

আজও আমি রাতের আকাশে খুঁজে বেড়ায় কোন তারাটা আমার বাবার। জানি আমি একদিন তাকে খুঁজে পাব।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।