মেগান আর মারুফ পাশাপাশি বসে আছে ছাদের কিনারে। মেগান জার্মানী থেকে এসেছে বাংলাদেশে ঘুরতে। মারুফ তাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায়নি। আজ ছাদ পুড়ে যাওয়া চরাচর ঢেকে যাওয়া আলোতে জোত্স্না খেতে নিয়ে এসেছে এখানে। মেগানের ইংরেজী জ্ঞ্যান গুগল ট্রান্সলেটর পর্যায়ের চেয়েও খারাপ।
মারুফও জার্মান জানে না। মারুফ স্প্যানিস শিখেছে, জার্মান কেন শিখেনি তা নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে। তাই ওদের কথা হয় না খুব একটা। তবে অসুবিধাও হচ্ছে না। ভালোবাসার অনুভূতির ভাষা সব দেশেই এক।
মারুফকে তাই কিছু বলতে হলো না। মেগানের হাতের উপর হাতটা রাখলো। এক স্পর্শেই বুঝিয়ে দিলো হৃদয়ের সব কথা। হৃদয়ের কাছে ইংরেজি, স্প্যানিশ, জার্মান ব্যার্থ, হৃদয় নয়।
মারুফের চোখ জলে ভিজে আসছে।
মেগান দেখে ফেললে লজ্জার ব্যাপার হবে। চোখের জল লুকোতে বৃষ্টি প্রয়োজন। প্রয়োজন জোত্স্না আর বৃষ্টির মধ্যে বন্ধুত্বের।
মারুফ জার্মান শিখবে, তারপর মেগানকে বাংলা শিখিয়ে বৃষ্টি আর জোত্স্নার লেখকের বই পড়তে দেবে। মারুফ হবে হিমু, মেগান রূপা।
জোত্স্না আর বৃষ্টির বন্ধুত্বও হবে সেদিন। !
***
পিকুর মন খারাপ আজ। ছাদে দাড়িয়ে আছে একা। পিকু অন্ধকার ভয় পায়। মন খারাপ থাকলে ভয় পায় না।
আম্মুর বকায় পিকুর খুব মন খারাপ, তাই ভয় পাচ্ছে না। পিকু ভালো ছেলে। আম্মুর কথা শোনে সবসময়, চকলেট খায় না, আইসক্রিম খায় না, ইচ্ছে হলেও খায় না। আম্মু কম্পিউটারের সিপিউ খুলতে মানা করেনি তবু আম্মু আজ বকেছে পিসি খুলে লন্ডভন্ড করায়। আরেকটু সময় পেলে ঠিক করে দিতে পারতো পিকু কিন্তু আম্মু দেয়নি আর।
কম্পিউটার অর্থ হিসাবযন্ত্র। ক্যালকুলেটরেও হিসেব করা যায় তবে বড় অঙ্ক করা যায় না। বড় অঙ্ক করতে কম্পিউটার বুঝতে হবে। আরো বড় অঙ্ক করতে সুপার কম্পিউটার প্রয়োজন। পিকুকে একটা সুপার সুপার কম্পিউটার বানাতে হবে।
পিকুকে অনেক বড় অঙ্ক করতে হবে। ফিহার চতুর্থ মাত্রার সমিকরণের সমাধান করতে অনেক বড় অঙ্ক করতে হবে। এই সমীকরণের সমাধান করতে পারলেই জানা যাবে অমরত্বের সূত্র। ‘ফিহা সমীকরণ’ বইতে পড়েছে পিকু।
পিকুর বাবা অনেকদিন বাসায় ফেরে না।
পিকুকে জড়িয়ে ঘুমায় না। বাবা হাসপাতালে অনেকগুলো যন্ত্রপাতির মাঝে ঘুমায়। পিকু বাবাকে ছুঁতে পারে না, পাপ্পি খেতে পারেনা। বাবা একটা কাঁচ ঘেরা রুমে ঘুমায় হাসপাতালের। পিকু আর আম্মু দেখতে যায় বাবাকে প্রতি রবিবার সকালে।
আম্মু বলেছে বাবা আকাশের তারা হয়ে যাবে। মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়, জানে পিকু। মরে যাওয়া ঠেকাতে পিকুকে ফিহার চতুর্থ মাত্রার সমীকরণ সমাধান করে অমরত্বের সুত্র বের করতে হবে।
আকাশের তারা হয়ে যাওয়া বাবাকে পিকুর ভালো লাগে না, কাঁচঘেরা ঘরে ঘুমিয়ে থাকা বাবাকেও না। আম্মুকে সেই কাঁচে চোখ রেখে কাঁদতে দেখতেও ভালো লাগে না, একদমই ভালো লাগে না।
***
আজগর সাহেবের মেজাজ খারাপ। আজ হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। হুমায়ূন আজগর সাহেবের প্রিয় লেখক না। একসময় হয়তো ছিল কিন্তু এখন আজগর সাহেবের সবচেয়ে বড় শত্রু এই ব্যাটা হুমায়ূন। জন্মদিন উপলক্ষে আজগর সাহেবের মেয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছে।
ছেলেটাও বাইরে যায়নি আজ। আজগর সাহেবের সবচেয়ে বড় কষ্ট তার ছেলেটা। কাজকর্মের নাম নেই, সারাদিন-সারারাত শুধু হইলদে পান্জাবী পড়ে টই টই করা। জিজ্ঞেস করলেই উদ্ভট সব জবাব। বলে কিনা হিমু হবে।
আরে হিমু কি পড়ার জিনিস না হ্ওয়ার জিনিস! সব নষ্টের গোড়া ওই ব্যাটা হুমায়ূন!
মেয়েটাও প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছে। চুপচাপে আভাস পেয়েছেন মেয়ে প্রেম প্রেমিক দেখে না, প্রেমিককে নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার সপ্ন দেখে। কেন যে হুমায়ূনের বই কিনে সেল্ফ বোঝাই করেছিলেন! মেয়েটা যেদিন পালিয়ে গেল, রেগে বুক সেল্ফে আগুন ধরিয়ে দিতে ছুটে গিয়ে দেখেন একটাও নেই। মেয়ে জামা-কাপড় নেয়নি, গয়না নেয়নি, হুমায়ূনের সব বি নিয়ে গেছে। উদ্ভট!
রাহেলা বেগম স্বামীর রুমে ঢুকলেন।
স্ত্রীকে দেখে আরো মেজাজ খারাপ হলো আজগর সাহেবের। তিনি থপ থপ পা ফেলে সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলেন। রাহেলা গুরুত্ব দিলেন না। একটা বয়স পরে স্বামীর রাগ-অভিমানকে গুরুত্ব না দিলেও চলে। তিনি এক মনে কাজ করে চলেছেন।
আজ বাসায় অনেক কাজ। মেয়ে এসেছে, রাতে মেয়ে জামাই আসবে। মেয়ে জামাই শ্বাশুড়ীর হাতের রান্না করা আলু-কাচকি মাছের চরচরি খুব পছন্দ করে। সেটাও এখনো রান্না হয়নি। আরো কত রান্না, দম ফেলার সময় কোথায়।
মেয়েটাও যে কোথায়, মা কে একটু সাহায্য করবে, তা না উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছেন। ছেলেটাকে একটু বাজারে পাঠাতে হবে, ধনিয়া সজ নেই ঘরে। ছেলেকে না পেয়ে ছাদে উঠতে লাগলেন, স্বামীকে পাঠাতে হবে।
ছাদে আজ হুলুস্থুল জোত্স্না। চাঁদের আলোয় সমস্ত চরাচর যেন ঢেকে যাবে।
রাহেলা বেগম চমতকৃত হলেন ছাদের দৃশ্য দেখে। আজগর সাহেব আসন করে বসে আছেন ছাদে। মেয়েটা আজগর সাহেবের বাহু জড়িয়ে ধরে বসে আছে। বিয়ের পর রাহেলা বেগমও এমন ভাবে স্বামীর পাশে বসে জোত্স্না দেখতেন। ছেলেটা একটু দূরে বসেছে।
হা করে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা ওর জোত্স্না খাওয়া। মায়া লাগছে রাহেলার। ছেলে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। যেতে পারছেন না রাহেলা।
তার চোখে জল জমে গেছে, ছেলে দেখে ফেললে লজ্জার ব্যাপার হবে। চোখে জল আর জলের লজ্জাকে ঢেকে ফেলতে বৃষ্টি প্রয়োজন রাহেলার, চোখের জল আর বৃষ্টিতে ভিজে একাকার!
হোক না আজ জোত্স্না আর বৃষ্টির সেই কাঙ্খিত বন্ধুত্ব। রাহেলা বেগম চোখ মুছলেন নীরবে, আহারে আহারে!
***
শুভ জন্মদিন মিঃ ম্যাজিশিয়ান!
যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।