আমার লেখা জুড়ে আমার ভালবাসা ছাড়া আর কিছু নেই।
তখন ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠেছি। একতলা টিনের ছোট স্কুল থেকে ৪ তলা বড় হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। ছাত্র সংখ্যা ১১ থেকে ২২৪। এত বন্ধু পেয়ে মনে মনে অনেক খুশি।
এতই বেশি খুশি ছিলাম যে ২২৪ জন ক্লাসমেট ছেলেমেয়ের নাম সহ রোল মুখস্থ করে ফেললাম। যদিও সবার সাথে কথা হয়নি। নতুন স্কুল, নতুন ড্রেস, নতুন ব্যাগ, নতুন জুতা, জুতার ফিতা, নতুন বন্ধু। আমি তখন আকাশে ভাসি অবস্থা। স্কুলের সাথে পোস্ট অফিস।
স্কুলে যাবার পথে ও আসার সময় প্রতিদিন পোস্ট বক্সটা দেখতাম। কোন এক কারণে আমার ঐ লাল পোস্ট বক্সটার প্রতি খুব আগ্রহ জন্মেছিল। আমার চিঠি পাঠাবার কেউ নেই। কিভাবে পাঠায় তাও জানিনা। শুধু ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য, পত্র লেখা শিখেছিলাম।
কিন্তু সত্যিকারে কাউকে লেখা হয়নি। যেহেতু চিঠি পাঠাবার কেউ নেই, পাঠাতেও পারি না। কিন্তু বক্সটার প্রতি খুব আগ্রহ। তাই প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার সময়। লুকিয়ে একটা করে ইটের টুকরা পোস্টবক্সে ফেলে দিতাম দৌড়।
একটা সময় তা খারাপ লাগাতে। প্রতিদিন একটা করে কাঠগোলাপ ফুল ফেলে দিতাম। এর ফাকে একদিন পোস্ট অফিস থেকে জেনে নিলাম চিঠি পাঠানোর নিয়ম। বাবার দেয়া প্রতিদিনের ৫ টাকা থেকে ২ টাকা দিয়ে একটা করে খাম কিনে চিঠি পাঠাতাম। ফাঁকা চিঠি।
আর পাঠানোর ঠিকানা ছিল বাংলা ২য় পত্র বই এ পত্র লিখনে যে ঠিকানা গুলো ছিল সেগুলো। তখন আমি জানতাম না সেগুলো এমনি ঠিকানা দেয়। তাই কোন চিঠিই যে যেত না ওটা আমার অজানাই রয়ে গেল। এরপর শুরু করলাম অন্য কাজ। এলাকায় বড় লাইব্রেরি ছিল দুইটা।
আমি গিয়ে লাইব্রেরি মালিক দুজনের নাম জেনে আসলাম। তাদের নামে চিঠি পাঠাতাম। বই থেকে প্রকাশনি গুলোর ঠিকানা নিয়ে, বুক অর্ডার দিয়ে। তাও লাভ হত না। আমার অর্ডারে কোন বই ই আসত না।
হতাশ হয়ে চিঠির নেশা ছেড়ে দিলাম। আবার পোস্ট বক্সে ফুল ফেলা শুরু করলাম।
এর ভিতর মাথায় ঢুকল আরেক জিনিস। আমাদের ইংলিশ স্যার বললেন যারা ভাল আঁকতে পার তারা ছবি একে নিয়ে আসবে। দেয়ালে টানানো হবে।
আমি ছোট্ট এক খাতার পেজে অনেক যত্ন নিয়ে রাত জেগে একটা গ্রামের দৃশ্য একে নিয়ে আসলাম। ভাবলাম স্যার কে বলে ছবিটা আমি যে সিটে বসি সেখানে মাথার উপর লাগিয়ে নিব। কিন্তু ছবি নিয়ে এসে আমি পুরপুরি বেক্কল। সবাই বড় আর্ট পেপারে করে ছবি এনেছে আর আমি পিচ্চি এক কাগজে। পরে ভাবলাম আসলেই তো এই পিচ্চি ছবি লাগালে তো নৌকা গুলোকে ঘামাচির চেয়েও ছোট লাগবে।
আমি তাই ছবি লুকিয়ে রাখলাম। কাউকে দেখালাম না। সবাই ছবি দিল। নিচে নাম রোল সহ। সত্যি সত্যি আমার মাথার উপর দেয়ালে একটা ছবি লাগানো হল।
নিচে নাম রোল দেখলাম। মেয়েকে আমি চিনি। কিন্তু কথা হয়নি তার সাথে কখনও। আমি খুব মনোযোগ নিয়ে ছবি দেখতে লাগলাম। অনেক সুন্দর ছবিটা।
ছবির প্রেমে পরি রকম অবস্থা। কিন্তু হঠাৎ এক জায়াগায় গিয়ে চোখ আটকে গেল। নদীর পাড়ে এক মহিলা বদনা হাতে দাঁড়িয়ে আসে। মেয়ের আশেপাশে কোন টয়লেটের ছবি আঁকেনি। চিন্তায় পরে গেলাম।
এই জিনিস আকার মানে টা কি? এত কিছু থাকতে বদনা। আমার মাথায় ঢুকছিল না। পুরো সিক্সের বছর ঐ ছবির নিচে বসেছি। প্রতিদিন একটা কথাই ভাবতাম মেয়েটা বদনা আঁকল কেন? কয়েকবার ভেবেছি ওকে জিজ্ঞেস করব কিনা। কিন্তু সাহস করে বলা হয়নি।
সিক্স থেকে ssc. একসাথে পড়েছি। ঐ মেয়েকে দেখলেই আমার ছবির কথা মনে পড়ত। আর সাথে সাথে বদনা হাতে মহিলা আঁকার কারণ জানার কথা। তার আশে পাশের বান্ধবীর সাথে কথা হলেও ওর সাথে কোনদিন কথা হয়নি। একসাথে পড়লেও।
তাই জানাও হয়নি ছবির রহস্য। কলেজে উঠে মেয়ে চলে গেল ঢাকার নামী কলেজে, আর আমি আমার স্কুলের নতুন খোলা কলেজে। ছবি রহস্য উদঘাটনের ইচ্ছা চলে গেল। ভেবে নিলাম, শিল্পীর মন অনেক কিছু ভাবে যা আমরা জানিনা।
কোন এক অস্বাভাবিক কারণে ঐ মেয়ের সাথে আমার কথা হয় মোবাইল এ, hsc পরীক্ষার পর।
সে আমার সাথে অপরিচিতা হিসেবে কথা বলেছিল। ততদিনে আমি ছবির কথা ভুলে গেছি। অপরিচিতা যখন তার পরিচয় দিয়েছিল অনেক দিন পর। সে বলেছিল চিনতে পেরেছি কিনা?
আমি তাকে চিনি। তাই ঐ কথার উত্তর না দিয়ে আমার প্রশ্ন ছিল পরিচিতার কাছে।
" তুমি সিক্সে যে ছবিটা দিছিলা ক্লাসে। ঐটা আমার মাথার উপর থাকত। ঐটাতে তুমি বদনা হাতে মহিলা আঁকছিলা কেন? "
মেয়ে তো অবাক হয়ে বলল,"মানে কি বল তুমি? ঐটা তো এক মহিলা কলস হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। "
আমি কথা শুনে হতবাক। আমি এতদিনের জানার ইচ্ছা পূরণ হলেও , ধারণাটা ভুল ছিল জেনে কষ্ট লেগেছিল।
যাকে আমি বদনা ভাবছি, তা ছিল কলস।
যাই হোক, প্রিয় জিনিস আরও সুন্দর হয়েছিল ঐ কথা বলার পর।
পরিচিতা অপরিচতার ব্যাপারে আর কিছু বলব না। সব কথার সবটুকু জানতে নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।