সরকারপক্ষ থেকে একদিকে সংলাপ আর সমঝোতার ডাক, অপরদিকে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার এবং তাদের বাড়িতে তল্লাশি। প্রধান বিরোধী দল বলছে, তারা সংলাপে আগ্রহী; কিন্তু লাগাতার হরতাল দিয়ে চলেছে। উভয়পক্ষ থেকেই আন্তরিকতার অভাব দেখা যাচ্ছে।
সরকার কেবল বিএনপির পাঁচ শীর্ষ নেতাকেই গ্রেফতার করেনি, তারা খালেদা জিয়ার বাসায় অতিরিক্ত পুলিশ পাহারা বসিয়ে সে বাসায় যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করছে। বস্তুত একে এক ধরনের গৃহবন্দী অবস্থা বলে।
হ্যাঁ, কার্যত সেটাই করা হয়েছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার জন্যই নাকি এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্ষুব্ধ জনগণ যাতে খালেদা জিয়ার বাড়িতে চড়াও হতে না পারে, সে জন্যই নাকি এমন ব্যবস্থা। হাসব, না কাঁদব! আমাদের স্বনামধন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন ধারায় কথা প্রায়ই বলে থাকেন।
মনে পড়ে গেল, কিছুদিন আগে রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনায় এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক অদ্ভুত থিওরি আমাদের শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আগের দিন হরতালকারীরা ভবনে ধাক্কাধাক্কি করেছিল বলেই ভবনটি ধসে পড়েছিল। অতীব দুঃখের মধ্যেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন উক্তি বেশ হাসির খোরাক জুগিয়েছিল। তখন অনেকে কৌতুক করে বলেছিলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে শেকিং থিওরির জন্য ফিজিঙ্ েনোবেল পুরস্কার দেওয়া হোক। আইনস্টাইন, নিউটনের পাশে তার নাম লেখা হোক।
এখন সংকটে জর্জরিত গোটা জাতি যেখানে উদ্বিগ্ন, সেখানে উদ্বেগের মধ্যেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাণী কিছুটা হলেও উদ্বেগ কমিয়েছে। কারণ হাস্যরস নাকি টেনশন কমায়। বাংলাদেশের ভাগ্য এমনই যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্রই এ ধরনের হাস্যরসের জন্ম দিয়ে থাকেন। এর আগের আরেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঈদের ছুটিতে ঢাকাবাসীকে ঘরে তালা লাগানোর উপদেশ দিয়ে এমনই কৌতুকরসের সৃষ্টি করেছিলেন। তখন কেউ কেউ মন্তব্য করেছিলেন, ঘরে তালা লাগানোর আগে মন্ত্রীর মুখে তালা মারা দরকার।
আজকাল অবশ্য সেই মন্ত্রীর আর কোনো কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি না। ফলে এমন ধারার কৌতুকরস থেকে আমরা বঞ্চিত রয়েছি। সেটা পুষিয়ে দিচ্ছেন বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
বলছিলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরাই এমন ধরনের অদ্ভুত কথা বলেন, যা হাসির খোরাক জোগায়। বিএনপি আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেনও এমন ধরনের কথা বলতেন, যা অতি দুঃখের মধ্যেও হাসির খোরাক জোগাত।
দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেলে তিনি বলেছিলেন, 'আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে গেছে। ' অবশ্য এমন ধরনের কথা ক্ষণিকের জন্য কিছুটা হাসির উদ্রেক করলেও, সেই হাসি তাৎক্ষণিকভাবে মিলিয়ে যায়। কারণ ঘটনাটি বেদনাদায়ক। বহু মানুষের মৃত্যু। তেমনই বর্তমানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করলেও বিষয়টিকে তুচ্ছ বিবেচনায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাই বলুন না কেন, বিষয়টি গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিক্ষুব্ধ জনতা খালেদা জিয়ার বাড়ি আক্রমণ করবে, এমন মনগড়া কথা একটি মানুষও বিশ্বাস করবে না। আসলে খালেদা জিয়া যাতে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতে পারেন, সে জন্য তাকে প্রায় গৃহবন্দী করা হয়েছে। সরকারের এই কাজ নিন্দনীয়। বাজে অজুহাতে কারও গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা কোনোভাবেই মানা যায় না।
প্রধান বিরোধী দলের নেতার চলাফেরা, লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করবে, এটা কীভাবে মানা যায়?
সরকারের দমন-পীড়ন নীতির অবশ্যই প্রতিবাদ জানাতে হবে। অন্যদিকে বিরোধী দল দাবি আদায়ের জন্য হরতাল ডেকেছে। লাগাতার হরতাল। হরতাল শান্তিপূর্ণ ছিল না কোনোভাবেই। প্রতিদিন বোমা ফাটছে।
মানুষ মরছে। অগি্নদগ্ধ হচ্ছে। পরীক্ষার্থীদের, শিশু, বালক-বালিকাদের ফেলে দেওয়া হচ্ছে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। বিরোধী দলের এই আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যায় না। সন্ত্রাস যারা করছে তাদের অবশ্যই দমন করতে হবে।
কিন্তু সেই অজুহাতে পুলিশ যেভাবে গণহারে গ্রেফতার করছে সেটাও সমর্থন করা যায় না। গণহারে গ্রেফতারের নির্দেশ নিশ্চয়ই এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। এমন নির্দেশ পেলে পুলিশের খুব লাভ। গ্রেফতার বাণিজ্যে ভালো অর্থ উপার্জন করা যায়। হরতাল, গ্রেফতার, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ডামাডোলের মধ্য দিয়ে উপেক্ষিত হচ্ছে সেই শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন, যারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে।
আমি গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথা বলছি। শ্রমিকরা দাবি করেছিলেন, আট হাজার টাকা নূ্যনতম মজুরি। যে কোনো বিবেচনায় আট হাজার টাকা একেবারেই নূ্যনতম। নূ্যনতম মজুরি নিয়ে দরকষাকষি চলে না। মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজন হিসাব করে নূ্যনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে, যা আইনি মর্যাদা পাবে।
সব দেশে এটাই হয়ে আসছে। সরকারের মজুরি বোর্ড তিন হাজার ২০০ টাকা নূ্যনতম মজুরি ঘোষণা করেছে। নানা ধরনের ভাতা যোগ করে দেখানো হচ্ছে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। বস্তুত তার মধ্যেও অনেক ফাঁকিবাজি আছে। সঙ্গত কারণেই শ্রমিকরা তা মানেননি।
অন্যদিকে অতি মুনাফালোভী মালিকরাও মানেননি। শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন। সরকার সেখানেও চরম দমননীতি প্রয়োগ করছে। সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর সর্বত্র শ্রমিক বিক্ষোভ। আর পুলিশ-র্যাব গুলি, টিয়ারশেল ছুড়ছে।
প্রধান বিরোধী দলও কিন্তু এর প্রতিবাদ জানায়নি। কারণ সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দল উভয়ই ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধি ও স্বার্থরক্ষক। মালিকদের বেয়াড়াপনার জন্য সরকার অথবা বিরোধী দল তাদের এ পর্যন্ত একটি ধমকও দেয়নি। এ দুই দল পালাক্রমে ক্ষমতায় ছিল। যখন তারা ক্ষমতায় থাকেন, তখন তারা স্বৈরাচারী হয়ে বসেন।
একে বলা যায়, নির্বাচিত স্বৈরাচার। আর বিরোধী দল তখন গণতন্ত্রের ভক্ত হয়ে বসেন। এটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রায়ই বলেন, 'গণতন্ত্রের স্বার্থে এই দুই দলকে তাই স্থায়ীভাবে বিরোধী দলে রাখাই বাঞ্ছনীয়। ' কথাটা খুবই যুক্তিযুক্ত।
বর্তমান সরকার এখন যে ধরনের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস চালাচ্ছে, অতীতে বিএনপিও তাই করেছিল। দুর্নীতি, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যক্তি ও দলীয় সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, দলীয় মস্তানদের দাপট ভুলিয়ে দিয়েছে হাওয়া ভবনের অপকর্ম। তাই দুটি দলকেই ক্ষমতার বাইরে রেখে অন্য কোনো দেশপ্রেমিক গণমুখী শক্তিকে ক্ষমতায় বসানো এখন জনগণের দায়িত্ব।
জনগণ অনেক আশা নিয়ে সামরিক শাসক এরশাদকে হঠিয়েছিল। তারপর দুই দশকের বেশি সময়েও গণতন্ত্র আসেনি।
এসেছে নির্বাচিত স্বৈরাচার। এই সময়কালে রাজনীতিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ত্যাগী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মীদের পরিবর্তে জায়গা নিয়েছে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন সাবেক আমলা ও ব্যবসায়ীরা। গত ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক প্রতিবেদনে পীর হাবিবুর রহমান সঠিকভাবেই লিখেছেন, 'আজ দেশের শাসন ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগী কোনো দলকেই গরিবের দল বলা যায় না। কারণ গরিব যতই ভালো মানুষ হোক এসব দলের নেতৃত্বে বা মনোনয়ন দৌড়ে তারা কোথাও নেই।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অর্থবিত্ত চিন্তা করেই তাদের রাজনীতিতে দৌড়াতে হয়। '
তিনি আরও বলছেন, 'সেনাশাসনের জামানায়ও রাজনীতিতে বিত্তশালীদের এত দাপট দেখা যায়নি। ... ছাত্ররাজনীতি এখন অছাত্র, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজদের হাতে। কী আওয়ামী লীগ, কী বিএনপি, দুই দলেই কমিটি বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা। ' উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন, 'একটি জেলা কমিটি নিতে নিলামে ওঠে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা।
' সর্বনাশা সর্বগ্রাসী এই অপরাজনীতির হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে। নতুন ধারার রাজনীতির উদ্বোধন ঘটাতে হবে। আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বিদায় দিয়ে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে হবে। এই কাজটা জনগণই করবে। জনগণকে সচেতন হতে হবে।
কাজটা খুবই জরুরি হলেও আপাতত আমরা বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চাই। দুর্ভাগ্য এই যে, সে জন্য আপাতত সেই দুই অবাঞ্ছিত দলের মধ্যেই সমঝোতা চাইতে হচ্ছে। কিন্তু এই দল দুটি তেমন সমঝোতায় পেঁৗছতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে হয়তো একতরফা নির্বাচন হবে। তাতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
সংকট একভাবে স্থায়ী রূপ নিতে পারে। সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্যও তাই দরকার আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে দৃশ্যমান শক্তিশালী বিকল্প শক্তি। জনগণের কাম্য তাই। সেই নতুন শক্তির অভ্যুদয় ঘটুক, এ কামনাই করছি।
লেখক : রাজনীতিক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।