সুখীমানুষ
ইংরেজিতে একটি কথা আছে, লিসেন টু ইউর হার্ট। বাংলায় "মনকে শুনো"। আমি মনকে শুনি।
উদাহরণ দেই। তখন চার পাঁচ বছর বয়স।
মা'র সাথে খালার বাড়ী যাচ্ছি। তখন দুনিয়াটা অনেক বড় ছিলো। এই বড় দুনিয়ার প্রায় মাইলখানেক রাস্তা আমার পরিচিত। বাড়ীর কাছের কথা!
ওঠোন পার হয়েই ভোঁ দৌড়। কারন মাইলখানেক হেঁটে গিয়ে তবেই রিক্সায় চড়তে হতো তখন।
কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম এক বয়স্ক মহিলা একটা কলসি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। হঠাৎ করেই মনে হলো, বয়স্ক এই মানুষটাকে সাহায্য করা দরকার। আমি বুড়ীর হাত থেকে কলসি নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। পিছন ফিরে দেখি মাকে দেখা যায়। তারমানে আমি ভুল পথে যাচ্ছি না।
কনফিডেন্স আরো বেড়ে গেলো। মা আমাকে হাত পা ছুড়ে ডাকছেন। কিন্তু আমিতো জানি আমি ভুল পথে যাচ্ছি না, আমি থামবো কেন?
রিক্সাষ্ট্যান্ডে গিয়ে বয়স্ক মহিলা চলে গেলেন। মাথায় হাত রেখে অনেক্ষন দোয়াও করলেন। এই দোয়া ভিক্ষুকের প্রফেশনাল দোয়া না, মন থেকে ওঠে আসা দোয়া।
কতক্ষণ পর মা পৌছালেন। বয়স্ক মহিলাকে কাছে না পেয়েও খুব বকা দিলেন। আমি কোন কারন খুঁজে পেলাম না। ভদ্রমহিলাতো আমাকে সাহয্য করার কথা বলেননি! আমি নিজেই সাহায্য করেছি। আমার এতে কষ্টও হয়নি।
তবে এখানে দোষের কি? মনটা খারাপ হয়ে গেলো। দুনিয়া যে যেমন দেখি তেমন না, যেমন ভাবি তেমন না তা বুঝা শুরু করলাম।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। বেশ কয়েক মাস আগে পার্কে হাটছি। একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের উপর নজর আটকে গেলো।
খাটো মত দেখতে, মাথায় ক্যাপ, গলায় মাফলার, গায়ে কোট, পায়ে কেড্স। ভদ্রলোককে দেখে মনে হলো তিনি গল্প করার মত কোন লোক পান না। পার্কে সকালে বা বিকালে হাটার সময় দুই, তিন জনের গ্রুপ থাকে। তিনি একা। হঠাৎ করেই মনে হলো, লোকটাকে সঙ্গ দিলে হয়ত খুশি হবে।
ভদ্রলোক এক গাল হেসে বল্লেন তিনি কবি।
আঁতকে ওঠলাম। কবিসঙ্গ এর আগে যিনি পেয়েছেন তিনি আঁতকে ওঠার কারন নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন। মনেমনে বল্লাম, খাইছে..। প্রথম দিন কবিতা শুনতে হলো না, ফোন নাম্বার দিয়ে চলে এলাম।
পরক্ষণেই মনে হলো, আয় হায় ইহা আমি কি করিলাম!
দুপুর বেলা ফোন পেলাম -
- বলছেন কি অরুণ?
আমার পেট কামড় দিয়ে উঠলো। তিনি দেখি কবিতায় কথা বলছেন!
- জ্বি আমি অরুণ
- আপনি তবে অরুণ, ধরুণ কবি আমি তবে। তবে কেমন হবে?
এমন ছন্দ দিয়ে কথা আগানো টাফ, সো টাফ। কিন্তু ভদ্রলোককে কিছু বলে না নাবলে চুপ থেকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছে না। উনার কথার ফাঁকে বল্লাম, আপনিতো ভাই সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকেও ছন্দে ফেল করে দিতে পারবেন এক তুড়িতে! তিনি আগ্রহ পেলেন।
তাঁর আগ্রহের তোপে আমার মাধা ব্যাথা নিয়ে ফোন রাখতে হলো। কিন্তু তার কবিতা শুনা হলো না।
এমন করে নিয়মিত ফোন চলতে থাকলো। একদিন কথার ফাঁকে খুব বিনয়ের সাথে বল্লাম, ভাই আমি এক সাথে অনেক জায়গায় এনগেজ থাকি। এতক্ষণ কথা বলতে পারি না ফোনে।
ভদ্রলোক মনে হয় একটু রাগ করলেন আর অনেক দিন ফোন দিলেন না।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আগেই বলেছি, আই লিসেন টু মাই হার্ট। ঠিক করলাম ভদ্রলোকের বাসায় যাবো। বাসায় গিয়ে আড্ডা দিয়ে কবিতা শুনবো।
ভদ্রলোককে চমকে দেওয়ার জন্য তার বাসার নীচে গিয়ে ফোন দিলাম। ভদ্রলোক আমাকে আরো চমকে দিয়ে ফোনই ধরলেন না। বেশী বুদ্ধির বোকামীতে বিরক্ত হয়ে বাসায় ফিরলাম।
ব্যাস্ততায় আরো অনেকদিন চলে গেলো। তিনিও আর ফোন দেননি, আমিও না।
একদিন সকাল বেলা বাসা থেকে বের হয়েই দেখি শিউলি ফুল টপটপ করে একের পর এক ঝড়ে পড়ছে মাটিতে। কি যে সুন্দর দৃশ্য। মনটা কাব্যরসে টইটুম্বুর হয়ে গেলো। সাথে সাথে কবির কথা মনে পড়লো। ভাবলাম আজ যে করেই হোক কবির সাথে দেখা করতেই হবে।
ঐদিন ফোন ধরলেন না। কোন সমস্যা কি না কে জানে।
যা ভেবেছিলাম তাই। কবি অসুস্থ। বাসার কাজের মেয়েটা ফোন ধরে জানালো।
সন্ধার পর গিয়ে হাজির হলাম কবির বাসায়। তিনি অসুস্থ শরীর নিয়েও কবিতার ডায়েরী খুলে অনেকগুলো কবিতা শুনালেন।
কবিতাগুলোতে আবেগ ও জ্ঞান বেশী কিন্তু কাব্যগুন নেই। উদাহরণ দেই,
মানুষ খাইতো মাংস কাঁচা
মিছা না মিছা না কথা কিন্তু হাচা
লগলো বনে আগুন একদিন
ভয়ে দৌড়ায় সবায়, বুকের ভিতর করে চিন চিন
পরে বনে পুড়া মাংস খায়
কাঁচা মাংসের চেয়ে তারা পুড়া মাংসে অনেক মজা পায়।
আরেকটা কবিতা অনেকটা এমন
ভালোবাসা আমার মনে, দেহের কারনে
দেহ চাই, দেহ চাই, কি হবে বলো মনে
অনেক কিছু ভাবা যায় কিন্তু বলা ঠিকনা।
এই ঠিকনা বিষয়গুলোও তিনি বিনা দ্বিধায় লিখে গেছেন। কথ্যভাষা একেবারে বিনা প্রয়োজনেও শুদ্ধ ভাষার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন।
দুই একটা কবিতায় কিছুটা খটকা লাগলো মানে বুঝতে। প্রশ্ন করে জেনে নিলাম। আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক শিশুদের মত উচ্ছল হয়ে উঠলেন।
অসুস্থ শরীরেও মন খুলে মিটিমিটি হাসছেন। এক ফাঁকে বল্লেন-
-ভাই এত বছর ধরে কবিতা লেখি। বন্ধুবান্ধদের কবিতা শুনাই। কেউ প্রশ্ন করে না। আমি ঠিক বুঝতে পারি, এরা বিরক্ত হয়।
মানে টানে বুঝে না, বুঝার চেষ্টাও করে না। কবিতা শেষ হইলেও বুঝে না যে কবিতা শেষ। সৃষ্টিতত্ব নিয়ে কবিতা শুনাইলেও শুনার পর শুক্না মুখে বলে, ভালো হইছে, রোমান্টিক কবিতা।
কবির কবিত্বের মূল গাঁথা হয় নবীন যৌবনে। এর পর কান্ড, শাখা প্রশাখা ধীরে ধিরে হয়।
বৃদ্ধকালে যারা কবিতা শুরু করেন তাদের কবিতার মূল থাকে না। লতার মত পরজীবি হয় কবিতাগুলো। আশেপাশের শ্রোতাদের রসদেই তাদের কাব্য-সান্ত্বনা চলে। শ্রোতা নেই তো নিজেকে কবি বলতেও লজ্জা হয়। তবু তারা তাই ভাবেন।
প্রায় ঘন্টা তিনেক কবিতা শুনলাম। কবিতার অন্তরের ইতিহাসের ব্যাখ্যা সহ কবিতা শুনার মধ্যে এক ধরনের মজা আছে। কিছুটা কাব্যরস যদি হৃদয়ে থাকে তবেই তা বুঝা যায়। না হলে আগাগোড়া বিরক্তই লাগে। পরে বিদায় নেবার পালা আসলো।
ভদ্রলোক দড়জা পর্যন্ত এগিয়ে আসলেন অনেক কষ্ট করে। দড়জায় এসে বল্লেন-
-ভাই, বিয়ার পর কবিতা লেখা শুরু করছি আপনার ভাবীরে পাওয়ার পর। তিনি কবিতা পছন্দ করতেন না। লুকায়ে লুকায়ে কবিতা লেখতাম। তারে নিয়াই কবিতা লেখি অথচ সে আগ্রহ পায় না।
ভাবতাম, সে যদি কোথাও বেড়াইতে যাইতো। তখন অনেক অনেক কবিতা লেখতে পারতাম। জীবনে কোনদিনও আমারে ফালায়ে কোথাও থাকতে পারে নাই। যত রাতই হোক, বাপের বাড়ী গেলেও দিনে দিনে ফেরত আসছে।
এতটুকু বলে ভদ্রলোক থামলেন।
আমি মনে মনে ভাবলাম, ভারী অন্যায় হয়ে গেছে, গিন্নির ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন ছিলো। বয়স্ক মানুষ একটু আবেগী হন। ভদ্রলোকও তার ব্যাতিক্রম না। দির্ঘ একটা শ্বাস ফেল্লেন, চোখের পানি মুছলেন। একটু থেমে আবার বলা শুরু করলেন,
-যিনি আমারে ছাড়া একদিনও থাকতে পারতেন না তিনি এখন আমারে ছাড়া কিভাবে আছেন এই সব ভাবি আজকাল।
মৃত্যুর পর মানুষজন হারায়ে যায় ভাবতাম এত দিন। এখন আমি নিশ্চিৎ যে, তারা সব দেখেন।
ঠিক এই মুহূর্তগুলো আমি খুব অপছন্দ করি। কিছু বলার থাকে না, কিন্তু থাকতে হবে, শুনতে হবে। ভদ্রলোকের কথা শেষ হয়নি
-জানেন মৃত্যুর পর সে আমার কবিতা পছন্দ করা শুরু করছে।
নতুন কিছু লেখতে পারি নাই মরার পরে। পুরনোগুলা শুনতে চায় খালি। নিজের লেখা এখন নিজে মুখ্স্থ করতেছি।
এই কথা বলেই ভদ্রলোক হাহা করে হাসতে থাকলেন।
- মারার পর মন তো আর মরে না ভাই।
নতুন কিছু যদি লেখতে না পারি তো পুরানোগুলোই না হয় শুনাবো তারে। বড় আজব এই মেয়ে মানুষ ভাই, সব ঠিক ছিলো, শুধু কবিতা শুনাইতে গেলে বিরক্ত হইতো। আহারে মনে মনে কত অভিমান করছি। আসলে বিরক্ত হইতো না, এইটাও এক ধরনের মেয়েমানুষী ভালোবাসা ভাইজান।
মেয়েমানুষী ভালোবাসার সঙা শুনে অসুস্থ কবিকে রেখে রাস্তায় নেমে এলাম।
জীবনসায়াহ্নে এসে ভদ্রলোক আবিষ্কার করলেন, বিরক্তি দেখায়েও মেয়ে মানুষ ভালোবাসা চেপে রাখে মনে মনে। আবার নিশ্চয়ই তাহলে ভালোবাসা দেখায়েও চরম ঘৃণা পুষে রাখে মনে। নারীমন বুঝা হয়ে গেলে নিশ্চয়ই আর কবিতার জন্ম হবে না কবিমনে। নিশ্চয়ই তখন মেয়ে মানে দুই এ দুই এ চার ছাড়া বেশী কিছু নয়। মেয়েদের মন না বুঝি এতে কষ্ট নেই, অন্তত সহজে নারীহৃদয় বুঝা যাবে এতটা সহজ যেন না হয় কোন দিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।