সেদিনও অন্তু বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। এমন সময় হিরু ভাই এসে হাজির।
তোমরা যাচ্ছ তো দৌড় প্রতিযোগিতায়?’
অন্তু হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। দৌড় প্রতিযোগিতা!
অন্তুদের এলাকায় প্রতিবছরই কোনো না কোনো প্রতিযোগিতার আসর বসে। এই তো গেল বছর ছিল চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।
অন্তু ওর বন্ধুদের সঙ্গে খেলাচ্ছলেই নাম লিখিয়েছিল। কিন্তু ওর আঁকা গাছটা হয়ে গিয়েছিল অক্টোপাস আর ঘরটা দেখে মনে হচ্ছিল এই বুঝি কোনো শুঁড় ছাড়া হাতি এসে টুপ করে ওর খাতায় বসে পড়েছে! মানিক, সজল আর বলগা তো হেসেই খুন। সেবার সজলের ছোট বোন পেয়েছিল প্রথম পুরস্কার। মেয়েটা আঁকেও বেশ!
সেসব কথা মনে পড়তেই অন্তু ভাবল, খুব তো আমাকে নিয়ে হেসেছ, এবার আমিও দেখিয়ে দেব! দৌড়ে অন্তু বরাবরই ভালো। স্কুলে তো প্রতিবার ও-ই চ্যাম্পিয়ন হয়।
হিরু ভাইয়ের কাছে পাওয়া গেল আরও মজার খবর। এবার যে প্রথম হবে, তাকে দেওয়া হবে একটা সাইকেল। যে-সে সাইকেল নয়, লাল সাইকেল! অন্তুর অনেক দিনের শখ, লাল সাইকেলে করে পাড়া চষে বেড়াবে। এবার বুঝি সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলল।
অন্তুরা দলবেঁধে হই হই করতে করতে চলল নাম নিবন্ধন করতে।
গিয়ে দেখে, ওদের আগেই লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে আরেকটা ছেলে। এই এলাকায় ওরা তাকে আগে কখনো দেখেনি। চুলগুলো উষ্কোখুষ্কো, রিনা ম্যাডাম দেখলে নির্ঘাত তাঁর চিকন বেতের বাড়ি পড়ত এই ছেলের পিঠে। চোখ দুটো বড় বড় করে চারদিকে তাকিয়ে দেখছে, যেন কোনো আজব শহরে ঢুকে গেছে ভুল করে। পরনে একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, তাও কয়েক জায়গায় ছেঁড়া।
চিকন দুটো পা দেখে যে কারও মনে হতে পারে, এক্ষুনি হয়তো ধুপ করে পড়ে যাবে। কী অদ্ভুত ছেলেটা! অন্তুরা ভাবল, বুঝি না জেনেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল।
‘কী নাম তোমার?’
আকস্মিক প্রশ্ন শুনে ছেলেটা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
‘রতন।
’ উত্তর এল।
‘এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? জানো, এটা কিসের লাইন?’
‘দৌড়ামু। ’
অন্তুরা ভীষণ অবাক হলো ছেলেটার কথায়। বলগা ঝুঁকে এসে বলল, ‘তুমি দৌড়াবে!’
রতন মাথা ওপর-নিচে ঝাঁকাল।
এবার প্রথমে সজল, তারপর মানিক সবশেষে বলগা হেসে উঠল হো হো করে।
হাসতে হাসতে মানিক তো পেট চেপে ধরে মাঠে বসেই পড়ল।
অথচ রতনের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। বলগা নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে বলল, ‘তুমি কোত্থেকে এসেছ ভাই? কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না! আর তোমার যে অবস্থা, তাতে তো মনে হচ্ছে তোমার দাঁড়িয়ে থাকতেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে, ১০০ মিটার দৌড়াবে কীভাবে?’
‘পারমু। পারতে হইব। ’ রতনের দৃঢ় কণ্ঠে এবার সবাই একটু নড়েচড়ে ওঠে।
এদিকে অন্তু প্রথম থেকেই ছেলেটাকে লক্ষ করছে, কী যেন একটা ব্যাপার আছে তার মধ্যে।
সেবার আর রতনকে কেউ ঘাঁটাল না। সবাই যার যার মতো নাম নিবন্ধন করে বাড়ির পথ ধরল। মানিক-বলগারা চলে যাওয়ার পর অন্তু রতনের পিছু নিল। রতন থাকে একটা ঘুপচি মতো বাসায়।
ওপরে ছাদের বদলে পলিথিন বসানো। অন্তু অবাক হয়ে সব দেখছিল। এমন সময় কে যেন খপ করে ওর কাঁধে হাত রাখল।
পিছে তাকাতেই দেখে রতন ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। ‘কী করছিস এখানে?’
অন্তু কাঁধ ডলতে ডলতে বলল, ‘এত জোরে কেউ ধরে?’
‘করছিস কী এখানে?’ রতনের সেই একই প্রশ্ন।
‘দেখতে এসেছি, তুমি কোথায় থাকো। ’
‘ক্যান? আমারে মারবি?’
‘মারব কেন? এমনিই! তোমাকে কখনো দেখিনি তো, তাই দেখতে এলাম তুমি কোন বাসায় থাকো। ’
রতন মনে হয় কিছুটা শান্ত হলো।
‘তুই অনেক ভালো দৌড়াস, না? সবাই বলাবলি করতেছিল। ’
‘একটু-আধটু পারি আর কি।
’ অন্তু মনে হয় কিছুটা লজ্জাই পেল!
‘হুম্!’
‘আমি যাদের চিনি, তাদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ভালো দৌড়াই। কিন্তু যাদের চিনি না, তাদের মধ্যে আমি কতটা ভালো পারব, জানি না। ’ বলে অন্তু বোকার মতো হাসল।
এই প্রথম রতনের মুখেও হাসি ফুটল। ‘তুই ফার্স্ট হইতে চাস?’
‘তা তো চাই-ই! জানো, আমার কত দিনের শখ একটা লাল সাইকেলের।
ওটায় চড়ে আমি স্কুলে যাব, মাঠে যাব, হিরু ভাইদের সঙ্গে রেস লাগাব, আরও কত কী! আচ্ছা, যদি তুমি ফার্স্ট হও, তাহলে সাইকেলটা দিয়ে তুমি কী করবে?’
‘বেইচা দিমু। পাঁচ-ছয় হাজার টাকা তো পাওয়া যাইবই। ’
অন্তু তাকিয়ে থাকল রতনের দিকে। কেমন যেন বোকা বোকা লাগছিল ওর নিজেকে।
দৌড় প্রতিযোগিতার আগের পাঁচ দিন চলল কঠিন প্রস্তুতি।
অন্তু খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠল, রোজ নিয়ম করে এক ঘণ্টা মাঠে সময় কাটাল। এবার ওকে জিততেই হবে!
অবশেষে এল প্রতিযোগিতার দিন। বড় মাঠে সবাই হাজির। ছোটরা তো বটেই, বুড়োরাও এসে গেছে। প্রতিযোগীরা প্রস্তুত।
সবার বুক ধকধক করে!
‘রেডি...গেট সেট...গো!’
শাঁ করে ছুটল সবাই। চোখের পলকে একেকজন দূরত্ব কমিয়ে আনছে শেষ লাইনের সঙ্গে। মাঠজুড়ে পিনপতন নীরবতা। পপকর্ন মুখে দিতে ভুলে গেল দাদু, হাতের ঝুনঝুনিটা বাজাতে মনে থাকল না ছোট্ট বাবুটার—সবার চোখ স্থির হয়ে আছে প্রতিযোগীদের দিকে।
খুব কম সময়ের ব্যবধানে প্রথম দুজন শেষ লাইন অতিক্রম করল।
অন্তু আর রতন।
এখন ঘোষণার অপেক্ষা। সবাইকে তাক লাগিয়ে প্রথম হয়ে গেল রতন, অন্তু দ্বিতীয়।
মানিক-সজল-বলগা রে-রে করে উঠল। অন্তুর কাছে গিয়ে সবাই ওকে সান্ত্বনা দিল।
এমন সময় রতন এগিয়ে এল পায়ে পায়ে। অন্তুর হাত ধরে বলল, ‘কী বস, পাস করছি?’
অন্তু আর রতনের হাসিমুখ দেখে বাকিরা তাজ্জব বনে গেল। রতন চলে যেতেই অন্তুকে ছেঁকে ধরল ওরা। ‘ঘটনা কী?’
অন্তু ফাঁস করল ঘটনা, প্রতিদিন সকালে এক ঘণ্টা করে দৌড়াত ও আর রতন, এভাবেই রতন অন্তুকেও দৌড়ে ছাড়িয়ে যেতে শিখেছে।
‘আর তোর লাল সাইকেল?’
‘একটা সাইকেলই তো! দেখ তো রতনের দিকে তাকিয়ে।
ওর হাসি দেখে কি মনে হচ্ছে যে আমি হেরে গেছি?’
বলগা এখনো পুরো ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না। ‘কিন্তু...কিন্তু তুই সত্যি করে বল তো, দৌড়ে রতনই তোর আগে ছিল?’
অন্তু কিছু বলল না, শুধু মুচকি হাসল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।