চৌবাচ্চার ভেতরে পানি ধরে রাখতে দেখেছি- দেখেছি বিশাল দীঘির বক্ষ ভরা পানিও। পানির স্রোতে ছাপিয়ে যেতে দেখেছি নদীর দু কুল। পদ্মার পাড় ঘেঁসে গড়ে ওঠা মানুষের কোলাহলও শুনেছি আরিচার ধারে। কিন্তু বিশাল পাহাড়ের বক্ষ ভরা পানির দেখা এই প্রথম। একটু চোখ বুজে ভেবে দেখুন বিশাল স্রোতে ভেসে যাওয়া পানির মাঝখানে আপনি আর আপনার চারপাশে বিশাল দানবীয় সব পাহাড়ের পাড়।
কি খুব শিহরণ জাগছে এইরকম পানিতে অবগাহন করতে, নাকি ছুঁয়ে দেখতে মন চাইছে এই পাহাড় ঘেরা পানির চৌবাচ্চাদের। তবে চলে আসুন তিন পার্বত্য জেলার একটিতে। চলুন ঘুরে আসি লাল পাহাড়ের দেশ থেকে রাঙামাটির দেশ থেকে।
(১)
(২)
লাল পাহাড়ের এই দেশে এই আমার প্রথম আসা। পাহারে ঘেরা এখানে যে এভাবে পানির দেখা পাবো তা আগে ভেবে দেখিনি।
আমার শ্রুতপূর্ব যে জ্ঞান তা থেকে শুধু ঝুলন্ত সেতুর কথা শুনেছি আর তাকে দেখার বাসনায় কত প্রহরই না গুনেছি। আমার ধারণা ছিল পাহাড় থাকবে সেই সাথে এই এলাকার মানুষ আর প্রকৃতি। প্রকৃতির এই বিশাল বক্ষে নিজেকে খুঁজে নেয়ার মানসে এখানে আসা । কিন্তু এসেই দেখি চারপাশ জুড়ে শুধু পানি আর পানি।
(৩)
চড়ে বসলাম শুভলং খালের বক্ষে।
ছোট একটা স্পীড বোট আর সাথে চালক এই আমার সাথী। নদীর ওপর চড়েই মনে পড়ে গেল সেই ছোট বেলার গান। আমাদের দেশটা সপ্নপুরি। সত্যি এক অপরূপ রূপ আমার দেশের। আর তা আবার উপভোগ করা শুরু করলাম এখানে এসে।
এখানে এখন বর্ষা মৌসুম একেবারে শেষ। শীতের আগমনী বার্তা যেন কড়া নেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে কি হবে বর্ষা এখানে বাংলালিংক দরেই পাওয়া যায়। বোটে যেতেই কিছু দূর পর পর বৃষ্টির শিহরণ জাগানো ফোঁটা কেন যেন ছুঁয়ে যেতে লাগলো । বৃষ্টি তাই বলে থেমে নেই এখানকার জীবনের কোলাহল।
মাছ চাষই এখানকার মানুষের অন্যতম পেশা অন্তত বর্ষা মৌসুমে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর ছোট ছোট ডিঙি নৌকা সেই সাথে সম্বল মাছ ধরা জাল। এ যেন জাল দিয়ে ধান বুনে চলেছে পানির উপর। কখনো একা আবার কখনো একসাথে দল বেঁধে খুব শক্ত করে তড়িৎ বুনন চলছে পাছে কেউ আগে এসে তার জায়গা দখল করে।
(৪)
(৫)
আমার মত এরকম অনেককেই দেখলাম সেখানে ঘুরতে বেরিয়েছে ।
সবাই মনে হল পাহাড় ঘেরা প্রকৃতি আর জালের মালা ঘেরা পানি দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। একটা বড় এলাকা জাল দিয়ে মালার মত ঘিরে রাখা হয়েছে। হয়তো এই জায়গাতেই চলে নানা সাইজের নানান রকমের মাছের আনাগোনা। কোন এক সুযোগে টেনে তোলা হবে সেই জাল।
(৬)
(৭)
(৮)
স্বভাবতই সকালে জাল পেতে তা আবার বিকালে টেনে তোলা হয়।
তবে কেউ যদি বিশাল সাইজের রুই কাতল দেখতে চান তাহলে সেই মৎস্য পিয়াসী মানুষের অবশ্যই এখানে আসা উচিৎ। আমি দারুণ মাছ পাগল মানুষ। তাই বাঘা আইর আর অগণিত মলা ঢেলাই পেট চুক্তি খাওয়া দিয়ে দিলাম মধ্যাহ্নে।
তবে নৌকার ভেতরে জাল টানায় মত্ত এই মানুষগুলো খেয়েছে কিনা তা জানা গেল না। ওদের নেশা কেবল মাছ ধরা।
ছুটে চলেছে শুভলং খালের এইপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। তবে মাছ ধরার ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়ম কানুন খুব শক্ত ভাবে মেনে চলে এখানকার মানুষ। খালের মাছগুলোকে বেড়ে ওঠার জন্য বেশ কিছু নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়। শুনেছি জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এই সময়ে কেউ মাছ ধরে না। খুব কঠোর আইন এই তিন মাস।
কেউ ধরা খেলে একেবারে সোজা জেলের ভাত। তাই এই তিন মাস খুব বড় কোন মাছ পাওয়া যায় না রাঙামাটিতে। আবার সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে যতদিন পানি থাকে ততদিন চলে এই মাছ শিকার।
(৯)
খালের উপর দিয়ে যাবার পথেই চোখে পড়বে মাছ ধরার নানা দৃশ্য। সব বয়সী মানুষেরাই ধরছে মাছ।
অনেক জায়গায় চারপাশে বাঁশ দিয়ে ঘিরে বেঁধে দেয়া হয়েছে জাল। অনেকটাই সেই মালার মত। বেশ লোভনীয় সেই মাছ শিকার। রাতের পর রাত দিনের পর দিন এভাবে অবিশ্রান্ত জেলেরা তাদের স্বপ্নের জাল বুনেছে এই খালের বুকে।
(১০)
বেশ বেলা হয়েছে তারপরও নৌকার ফাঁক দিয়ে অনেককেই ঘুমিয়ে থাকতে দেখলাম।
আর এক পাশে আবার চলছে রান্নার কাজ। সন্ধ্যার খাবার বেশ আগে ভাগেই রান্না করে নিচ্ছে পাছে আবার আলোর স্বল্পতা দেখা দেয়। বেশ রোমাঞ্চকর এই জেলেদের জীবন। দিনের বেলার কাঁচামিঠে রোদের হাসি আর রাতের জ্যোৎস্নার রুপালি স্নিগ্ধতা খুব ভালোভাবেই উপভোগ করে এরা।
শুভলং খালের উপর দিয়ে বয়ে গেলে চোখে পড়বে নানা রঙের প্লাস্টিকের বোতল কেবল উপর দিকে বাঁশের মাথার উপর মাথা উঁচু করে ভাসছে।
এদের দেখে বোঝার উপায় নেই যে বিশাল জালের ভার বয়ে নিয়ে বেড়ানো অনেকের মাঝে তারাও প্রত্যেকে এক একজন। সেই সময় মানুষ পারাপারে ব্যস্ত মাঝিদের একটু সমস্যায় পড়তে হয় বৈকি। কিছুক্ষণ পর পরই কেবল জায়গা পরিবর্তন করে এই জাল বাহী বোতলদের জন্য জায়গা ছেড়ে চলতে হয় আর কি। কিছু করার নেই কারণ এই মৌসুম যে জাল আর জেলেদের।
(১১)
(১২)
থেমে থাকেনা এই কমাস মাছ ধরা।
বেশ কজন একসাথে জাল টানছে। সারা রাত ধরে জাল গুলো পানির বেশ গভীরে নিজেদের মেলে দিয়েছিল। এবার হয়তো আটকে পড়া মাছদের খুব হতচকিত হয়ে ধরা দেবার পালা। প্রচুর মাছ পাওয়া যায় শুভলং, বরকলের এই লেক ঘেঁষা জায়গাগুলোতে। খুব মজা করেই এলেরা এইসব মাছ ধরছে।
জীবিকার তাগিদের বাইরেও একটা নেশা গ্রস্থতার বিষয় লক্ষ্য করলাম এখানকার জেলেদের মাঝে। গল্প , গান আর রান্না কড়া পাশাপাশি চলছে খাওয়া ঘুম আর মাছ শিকার। বেশ ছকে বাঁধা কয়েক মাস কেটে যায় এদের। পানি কমার সাথে সাথেই ছকে আসে কিছুটা পরিবর্তন। তখন জুম চাষের দিকে পূর্ণ মাত্রায় মনোনিবেশ।
এই চাষ নিয়ে কথা হবে আর একদিন।
(১৩)
প্রকৃতি বেশ উদারভাবেই যেন ঢেলে দিয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ। লেকের ভেতর দিয়ে চলে গেলে চোখে পড়বে নাম না জানা হাজারো গাছ। ভেষজ নানা গাছ গাছালী নিয়ে যদি কেউ গবেষণা করতে চাই তাহলে সে এখানে এসে অভিভূত হয়ে পড়বে। নিজ দেশের একেবারে দক্ষিণে ভেষজ সম্পদের এত বিশাল ভুমি সত্যি বেশ অবাক লাগে।
সেই সাথে যুক্ত করা যায় নানা জাতের পাখি আর নাম না জানা অজস্র জীব।
লেকের উপর দিয়ে বয়ে চলার সময় মোহনীয় হরেক রকমের সৌন্দর্য চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে পাহাড় আর নদীর খুব নিবিড় সম্পর্ক না বললেই নয়। নয়নাভিরাম দুই একটা চিত্র দেখে নেয়া যাক।
(১৪)
(১৫)
(১৬)
এইরকম রূপ আর সম্পদে ভরপুর একটা জায়গাতে ঘুরতে এসে বোঝা যায় আমরা কত দিক দিয়ে কত সম্পদের মালিক।
এখন দরকার এগুলোর যথার্থ ব্যবহার। ব্যাবহারের মধ্যে এই জায়গায় পর্যটন ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করার কথা বলছি। দর্শনীয় সব জায়গা ঘুরে ঘুরে বের করে এক একটা নান্দনিক স্পটে রূপান্তর করার উদ্যোগ সহসায় গ্রহণ করা যায় এই শুভলং খালের পাড়েই।
অমি_বন্যা
আগের পর্ব এখানে
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/50537
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।