তোকে দেখিনা, কতো হাজার বছর হয়ে গেলো...
ম্যাচ শেষ হলেই দর্শকরা চলে যান। ফাঁকা পড়ে থাকে স্টেডিয়ামের সুবিশাল গ্যালারি। এমনই হয়ে এসেছে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু এ দিনই বদলে গেছে চিরচেনা দৃশ্যপট। তাতেও অবশ্য অবাক হওয়ার সুযোগ নেই একটুও।
কারণ- এ দিনই শেষবার মাঠে দেখা গেছে ক্রিকেট-রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতাবান রাজা শচীন টেন্ডুলকারকে! এ দিনই যে খেলা শেষ হওয়ার পরও দেখা বাকি ছিলো ক্রিকেট-রাজাকে; ভারতের, বিশেষ করে মুম্বাইয়ের দর্শকরা কিভাবে পারবেন ওয়েংখেড়ের গ্যালারি ফেলে যেতে? তারা তো বরং মনে মনে চেয়েছেন যাতে লিটল মাস্টারের কথা শোনার অমন ঘোর-লাগা সময়েই থেমে পড়ে পৃথিবী! আর তারা যেনো পান অনন্তকাল তাদের ‘ঈশ্বরের’ বহু বহু প্রত্যাশিত কথা শোনার সুযোগ!
ওয়েংখেড়ের দর্শকদের সে সুযোগ মিলেনি। মিলার কথাও নয়। তারপরও যতোটুকু সময় শচীন মাইক্রোফোন হাতে বলে গেছেন তার পুরো জীবনের গল্প, তাতেই মোহিত ওয়েংখেড়ের দর্শকরা। মোহিত পুরো ভারত। শচীনের কথার সে জাদু ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি একটুও।
আরব সাগর- ভারত সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরসহ পৃথিবীর সব সাগর-মহাসাগর-উপসাগরে তা ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুততম গতিতেই, যাতে ওয়েংখেড়ে আর ভারতের সাথে মোহিত হওয়ার সুযোগ মিলেছে পুরো বিশ্বেরই।
নিজের বিদায়ী টেস্ট শেষে শচীনের ২০ মিনিটের ভাষণ ঐতিহাসিক হয়ে গেছে ‘লাইভ’ সম্প্রচারের সময়েই। পৃথিবীর জন্মের পর থেকে একসাথে এতো এতো মানুষ হয়তো আর কারো ভাষণ শোনেনি। পৃথিবীর নানা প্রান্তের কোটি কোটি মানুষও হয়তো আর কখনোই এক সাথে কাঁদেনি কোনো ভাষণ শুনে। শচীনই তো এক ও একমাত্র ‘চৌম্বক’; যার ক্রিকেট-আকর্ষণে জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষই ছুটে আসে তীব্র থেকে তীব্রতর আবেগি স্রোতে।
সুতরাং ম্যাচ শেষে গ্যালারি ফাঁকা না করার সপ্রযুক্ত উপলক্ষ তো শচীনই হবেন! তার ‘ঘরের মানুষ’ হয়ে এটি কি না বুঝে পারেন মুম্বাইয়ের দর্শকরা?
বুঝেন বলেই, গ্যালারি ফাঁকা হতে দেননি তারা। মাঠে থেকে দেখে গেছেন মহানায়কের সদাপট উন্নত-শির প্রস্থান। দেখে গেছেন ক্রিকেটকেও প্রায় ধর্মসম উচ্চতায় নিয়ে আসা ব্যক্তিটিও কী রকম গভীরতম আবেগে আক্রান্ত হন। আবার পরক্ষণেই নিজের দৃঢ় ও সুসংহত চরিত্রের উজ্জ্বল প্রমাণ দিয়ে বলে দেন, “বিদায়ের কথা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি ‘ম্যানেজ’ করে নিবো।
”
ক্রিকেটের এই অবিসংবাদিত নেতা তো বলবেনই ‘আমি ম্যানেজ করে নিবো’! আসলেই তো তিনি ম্যানেজ করে নিয়েছেন। তা-ই যদি না হতো, তাহলে তো আজন্ম ক্রিকেটপ্রেমী শচীন টেন্ডুলকার ক্রিকেটই ছাড়তেন না! ক্রিকেটের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ তাকে ক্রিকেট ছাড়তেই দিতো না। তিনি দক্ষ-পরিপক্ক এক ক্রিকেট-দেবতা, যিনি ক্রিকেট-প্রেম তার বুকের পাঁজরে রেখে দিয়েই ক্রিকেটকে ‘বাই’ বলে দিতে পারেন।
কিন্তু আসলেই কি তিনি পেরেছেন ক্রিকেটকে ছেড়ে দিতে? গ্যালারিভরা ২৫ হাজার দর্শকের সামনে যখন শেষবার পিচ প্রণাম করে নিলেন, তখন কি ধক্ করে উঠেনি তার মন? হায়, শচীন ক্রিকেট ছেড়ে যাচ্ছেন, শচীন? এসব বলে তো সুদূর বাংলাদেশের বহু শচীনপ্রেমীও কেঁদে উঠেছেন! শচীনও কেঁদেছেন নিশ্চয়। পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটকে এতোদূর নিয়ে এসেছেন তিনি, এ কথা ঠিক।
কিন্তু তাই বলে ক্রিকেট ছাড়ার ক্ষণেও যে তিনি দৃঢ়তার মুখোশে নিজের কান্না চেপে রাখতে পারবেন, তা সম্ভব নয়। আসলেই সম্ভব হয়নি। শচীন কেঁদেছেন। কথা বলতেই বলতেই কেঁদেছেন। যে কান্নার সাক্ষী শতকোটি ক্রিকেট-পাগল।
যারা ছড়িয়ে আছে ভারত-বাংলাদেশ হয়ে পৃথিবীর সুদূরতম কোনো দেশেও।
২০ মিনিটের ভাষণে শচীনের কথা শোনার তৃপ্তি মিটেনি পৃথিবীর। কর্তাব্যক্তিরা তাই সুযোগ রেখেছিলেন আরো। একদিন পর তিনি ফের মুখোমুখি হয়েছিলেন সংবাদ মাধ্যমের। আমন্ত্রিত সকলে প্রত্যাশা করেছিলেন এক বিষণ্ন শচীনকে, সদ্যই ক্রিকেট ছাড়ার যন্ত্রণা স্পষ্ট হয়ে থাকবে যার চোখে মুখে।
কিন্তু একি! তিনি তো এলেন হাসিমুখে! কিছুই যেনো হয়নি তার। অকপট ও বাঙ্ময় এক শচীনকে পেয়ে তার জীবনের বাকি সব কথা জেনে নেওয়ায় ত্রুটি করলেন না সংবাদকর্মীরা। কাউকেই হতাশ করেননি শচীন। দুই যুগে ধৈর্যের যে সুবিশাল উপমা তিনি তৈরি করেছিলেন, তা বজায় রেখেই দিয়েছেন সব প্রশ্নের উত্তর।
ক্রিকেটকে বিদায় বলার পরের দিন সকালটা তার কাছে ছিলো বিশেষ।
স্ত্রীকে এ সকালে দিতে পেরেছিলেন নিজের মতো সময়। তাড়া ছিলো না কোনো। পৃথিবীর সুখীতম মানুষ হিসেবে সকালটা কাটানোর পর এসেছিলেন সংবাদ মাধ্যমের সামনে। কথা বলেছেন মা’কে নিয়েও। জানিয়েছেন কিভাবে তার পুরোটা ক্যারিয়ারজুড়ে ছিলো মায়ের আশির্বাদ।
জানিয়েছেন পরিবারের অতুলনীয় সমর্থনের কথা। বলেছেন, সেঞ্চুরি করলে পরিবার যেভাবে তাকে নিয়ে মেতে থাকতো। ১৫-২০ রান করে আউট হলেও তার হেরফের হতো না কোনো।
শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটারদের তালিকায় শচীনের নাম চিরকাল থাকবে শীর্ষেই। সময়ের সর্বশেষ বিচার তা-ই বলে।
শচীন সেরার তালিকায় থাকবেন মানুষ হিসেবেও। ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজের প্রতিপক্ষ নিয়ে তার মূল্যায়ন, তা শুধুমাত্র সেরা মানুষ বলেই করতে পারেন তিনি। অকপটে বলে দেন, “ক্যারিবীয় দলে বিশ্বমানের কিছু ক্রিকেটার আছেন। তারা যেদিন পারফর্ম করবে, সেদিন আর তাদের জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। ”
নিজের জীবনের সবচেয়ে আলোচিত সংবাদ সম্মেলনে শচীন বলেছেন তার পরিবারের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র, তারই বড় ভাইয়ের কথা।
জানিয়েছেন, কী বিশাল ত্যাগ স্বীকার করে শচীনকে ‘শচীন’ করে গড়ে তুলেছেন তিনি। বলেছেন তার ক্যারিয়ারের বেশ খানিকটা সময় কেড়ে নেওয়া ‘টেনিস এ্যালবোর’ কথা।
সম্ভাব্য বিষণ্ন শচীনকে দেখার অপেক্ষায় থাকা সংবাদকর্মীরা দেখেছেন, শেষ সময়েও কী ভীষণ রসবোধ দেখাতে পারেন শচীন। নিজের চেয়ে অনেক ছোট সতীর্থদের বিষয়ে শচীন বলেন, “যখন খেলতে শুরু করি, ভূবেনশ্বরের তখন জন্মই হয়নি। আমি তাই তাদেরকে বলতাম, আমায় দেখে তোমার গুড মর্নিং স্যার বলা উচিত।
”
বিদায়-বিষাদ মুছে এমনও প্রাণবন্ত শচীনই আমাদের চেনা। যিনি ব্যাট হাতে ছুটান রানের ফোয়ারা, আর মুখের কথায় উদ্দীপ্ত রাখেন তার দলকে।
সূর্য এখনও আগের মতোই উদিত হবে। দিন শেষে আগের মতোই অস্ত যাবে। তারপরও দিন বদলে গেছে সত্য, পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট অনেকটাই রঙ হারিয়ে ফেলেছে শচীনের বিদায়ে।
তারপরও শেষ ভাষণে শচীন যা বলেছেন, শেষ সংবাদ সম্মেলনে শচীন যে প্রাণশক্তির সক্ষমতা দেখিয়েছেন, তা মনে থাকবে বহুকাল। আর এই মনে থাকাই জানাবে এই তো শচীন, আছেন নিজের পুরো অস্তিত্ব নিয়ে, মিশে আছেন ক্রিকেটে। এই পৃথিবীতে ক্রিকেট খেলাটা যতোদিন থাকবে, শচীনও থাকবেন ততোদিন।
মূল লেখা পড়তে ক্লিক করুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।