জুলাইয়ে কিসিঞ্জার গোপন সফরে গেলেন চীনে। যাত্রাবিরতি করলেন ইসলামাবাদে। ফিরে এলেন কিসিঞ্জার। ১৫ জুলাই জাতীয় টেলিভিশনে নিঙ্ন ঘোষণা দিলেন চীন করবেন তিনি। খবরটা নয়াদিলি্লকে স্তম্ভিত করল এ জন্য যে, এবার হয়তো আর ঠেকিয়ে রাখা গেল না চীনের হস্তক্ষেপ।
শুধু হস্তক্ষেপ কেন, পাকিস্তানকে কোনো দেশের ওই মুহূর্তে সমর্থন দেওয়া ছিল ভারতের জন্য হুমকি। চীনের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার আলোর ঝিলিক চোখে পড়ল কিসিঞ্জারের। এটি নিঙ্ন ও কিসিঞ্জারের জন্য সর্বোপরি হয়ে উঠল একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তারা চীনকে বোঝাতে চাইলেন, যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই তাকে যে কোনো ক্রাইসিসে সমর্থন-সহযোগিতা করবে, যে কিনা পাকিস্তানের মিত্র। আগস্টের শেষ দিকে ভারতীয়রা নিল নতুন সিদ্ধান্ত।
ধাপে ধাপে তাদের সম্পৃক্ততা ও মুক্তিবাহিনীর প্রতি গোপন সমর্থন বাড়াতে চাইল তারা। কারণ এটি করা গেলে পাকিস্তানিদের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে আনা যাবে পূর্বাংশকে। গোপন পলিসির অংশ হিসেবে সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে 'পিস অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ' চুক্তি করতে উদ্যত হলেন ইন্দিরা গান্ধী। আন্তর্জাতিক জনমত বস্তুত ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে। তাই বিশ্ববিবেক জাগ্রত করতে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে আগস্টে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হলো 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। ঝড়োগতির সফর শেষে ফিরলেন ইন্দিরা। ফিরেই পাকিস্তান ভূখণ্ডে ভারতীয় সেনা নামানোর নির্দেশ দিলেন আক্রমণাত্দক অপারেশন পরিচালনার জন্য। তিনি জেনারেল মানেকশকে বললেন, পাকিস্তানের মাটিতে পূর্ণ শক্তিতে অভিযান পরিচালনার। অপারেশনের সময় নির্ধারিত হয়েছিল ৪ ডিসেম্বর।
কিন্তু ইয়াহিয়ার টাইমিং ছিল নিখুঁত। নির্দিষ্ট সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। পাকিস্তানি বিমানবাহিনী আঘাত শুরু করল ৩ ডিসেম্বর রাতে। আক্রমণ চলল দক্ষতার সঙ্গে, দ্রুতগতিতে। তবে ভারতের সতর্ক দৃষ্টি ছিল এ আক্রমণের প্রতি।
কিসিঞ্জার ও তার সহায়তাকারীরা গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর মাধ্যমে জানতে পারলেন, ভারত চাইছে পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দিতে। বিষয়টি জানার পরপরই তারা বিস্তৃত করল পাকিস্তানের প্রতি তাদের সামরিক সহায়তা। ভারতকে ভীতিকর অবস্থায় ফেলতে বঙ্গোপসাগরে ঘাঁটি গাড়ল মার্কিন সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে সপ্তম নৌবিহার। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র অনুরোধ জানিয়ে গোপন বার্তা পাঠাল চীনের কাছে, যেন তারা বিপুলসংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ ঘটায় তাদের ভারতীয় সীমান্তে। অন্যদিকে ভারতীয় অভিপ্রায় ছিল ভিন্ন।
দেশটির নেতারা নিঙ্ন ও কিসিঞ্জারের চেহারাকে অাঁকলেন ধড়িবাজ ও উচ্চাভিলাষী হঠকারী হিসেবে। তারা নির্ভর করলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর। কারণ মহাশক্তিধর দেশটি পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে সমর্থন করেছিল ভারতকে। তারা সামরিক প্রচারাভিযান চালাতে লাগল পাকিস্তানের বিভক্তি নিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে অনুরোধ জানাতে থাকল মার্কিন প্রতিনিধি বহিষ্কারের।
এমনকি বিশ্বজুড়ে স্বার্থসিদ্ধির জন্য মার্কিন অন্তর্ঘাতের বিরুদ্ধেও প্রচার চালাতে থাকল ভারত। 'বুঝলে হেনরি (কিসিঞ্জার), আমরা ভারতের এই সব গান্ডুশ আর বকধার্মিককে ছেড়ে দিতে পারি না। কারণ এরা শুধু এখানে নয়, ভিয়েতনামেও আমাদের ওপর পাঁচটি বছর নিজেদের গরম জল ঢেলেছে'_ পরামর্শককে বললেন নিঙ্ন।
ইন্দিরা গান্ধী ও তার উপদেষ্টারা খুব ঠাণ্ডা মাথায় হিসাব কষছিলেন সমর-নায়কদের কাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া যায় তা নিয়ে। তবে চূড়ান্ত পরিকল্পনা তারা অাঁটেননি ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কিংবা একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টির।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন আগে, ১১ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে, বিশেষ করে ঢাকায় সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ করেনি ভারত। পরিস্থিতি ক্রমশই অবনতি হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র অাঁচ করতে পারল এ যুদ্ধে পাকিস্তানকে জিতিয়ে আনা কঠিন হবে। ৪ ডিসেম্বর ডাকা হলো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন। সেখানে যুদ্ধবিরতি ও দাবি-সংবলিত মার্কিন প্রস্তাব পেশ করার প্রস্তুতি নিলেন কিসিঞ্জার।
উপমহাদেশের এ সংঘাতের জন্য মুখ্যত ভারতকে দায়ী করে বিবৃতি দিল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিলেন জর্জ এইচ ডবি্লউ বুশ। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য নিজ নিজ সীমান্তের ভেতরে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি উত্থাপন করলেন তিনি। একই সঙ্গে এ সিদ্ধান্ত কার্যকরে জাতিসংঘ মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাবও উপস্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে ভেটো দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবকে 'একতরফা' অভিহিত করেন সোভিয়েত প্রতিনিধি। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় পোল্যান্ডও। ফ্রান্স ও ব্রিটেন ছিল মাঝামাঝি অবস্থানে। দেশ দুটি বিরত থাকল ভোটদানে। পরদিন ৫ ডিসেম্বর আবার বসল অধিবেশন।
এতে সোভিয়েত ইউনিয়ন দিল পাল্টা প্রস্তাব। এতে বলা হলো, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, এ জন্য অবিলম্বে সেখান থেকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে তাদের। সোভিয়েতের এ প্রস্তাব সমর্থন করল না কেউ পোল্যান্ড ছাড়া। চীন ভোট দিল বেশ জোরেশোরে। আর অন্যরা বিরত থাকল ভোটদানে।
একই সময় রুশ সরকার তার নিজস্ব সংবাদমাধ্যম 'তাস' মারফত বিবৃতি দিল। এতে দাবি জানানো হলো, পূর্ববাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের। বিবৃতিতে এমনকি উল্লেখ করা হলো, এ সংঘর্ষের সঙ্গে সোভিয়েতের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।