রাত্রিশেষের হাওয়ায় কেঁপে উঠলেন রোহিতাশ্ব। বাতায়নপথে চেয়ে দেখলেন অরণ্যশীর্ষে ঢলে পড়েছে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণ চাঁদ। হেমন্ত শেষ হয়ে এলো, রিক্ত ধানক্ষেতে হু হু করে বেড়ায় হাওয়া। উৎস
রোহিতাশ্ব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁসের পালকের কলমটি নামালেন। উঠে দাঁড়ালেন, উত্তরীয়টা একটু ভালো করে জড়ালেন।
বাতায়নবর্তী হয়ে দৃষ্টি মেলে দিলেন দূরে। ক্ষীণ জ্যোৎস্না আর কুয়াশা মিশে আদিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত অদ্ভুত অলীক দেখাচ্ছে। যেন অপার্থিব!
পাঁচ বছর হয়ে গেল। এইরকম এক হেমন্তে সদানীরা ছেড়ে গেছে তাকে। শ্রুতি আর স্মৃতি --এই দুই যমজ কন্যাকে রেখে।
ওরা তখন তিন বছরের শিশু। কে ভেবেছিল ঐভাবে মাত্র তিনদিনের অসুখে পূর্ণযুবতী সদানীরা এই অনেক ভালোবাসার সংসার সন্তান স্বপ্ন -সব ছেড়ে চলে যাবে? এই সন্তান দুটি জখন গর্ভে এলো তখন কী তীব্র আনন্দে জ্বলজ্বলে হয়ে উঠছিল সদানীরা, এরা যখন জন্মালো তখন তাদের কী সুখ, কী অনাস্বাদিত বাৎসল্যের প্রথম অমৃত অনুভূতি! এইসব হঠাৎ করে ছেড়ে দিয়ে তাকে এত নির্মমভাবে একা করে দিয়ে চলে গেল নীরা!
রোহিতাশ্ব পাশের ঘরে ভেজানো দরজাটার দিকে তাকান, তারপরে আস্তে আস্তে সেদিকে যান, দরজা আস্তে করে ঠেলা দিতেই খুলে যায়। ঘরে ঢোকেন। মেয়ে দুটি ওদের ঠাকুমার পাশ ঘেঁষে শুয়ে আছে বিছানায়। তিনজনেই ওরা গভীর ঘুমে মগ্ন, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দোময় শব্দ শোনা যায়।
ঘুমের মধ্যে শ্রুতি পাশ ফেরে, গায়ের চাদর খানিকটা সরে যায়, এলোমেলো ফুরফুরে রেশমীচুলে ঘেরা কচিমুখটি দেখা যায়, পাতলা রাঙা ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক, কচি দু'খানা দাঁত দেখা যাচ্ছে। রোহিতাশ্বের বুকের ভিতরে ছলছল করে, আস্তে করে পাশে বসে মেয়ের গায়ের চাদর ঠিক করে দেন। ঘুমের মধ্যে আদর করতে নেই, নইলে ওর কপালে একটা চুমু খেতে খুব ইচ্ছে করছিল রোহিতাশ্বের। মেয়ের কপালের থেকে চুলগুলো যত্ন করে সরিয়ে মাথায় হাত হাল্কা করে বুলিয়ে সরে এলেন তিনি। লোকে বলে শ্রুতি আর স্মৃতি ওদের মায়ের মুখ পেয়েছে, মায়ের চেহারা পেয়েছে।
রোহিতাশ্বকে নতুন স্ত্রী গ্রহণ করতে অনেকেই পরামর্শ দেন, এমনকি রোহিতাশ্বের মা ও। কিন্তু তিনি মনস্থির করতে পারেন না। হয়তো আর কিছু বছর পরে সত্যি করেই নতুন বিবাহ করতে হবে তাকে, কিন্তু এখন এই কচি মেয়ে দুটি সৎমায়ের হাতে পড়ুক, এ তিনি চান না। অনেকে বলে যে সব সৎ মা যে খারাপ হয়, তা কে বললো? কোনো কোনো সৎ মা এত ভালো হয় যে সতীনের সন্তানদের যত্ন করে নিজের সন্তানের মতন। কিন্তু রোহিতাশ্ব জানেন তেমন সৎ মা বিরল ব্যাপার।
মেয়েদের ঘর থেকে নিজের লেখার ঘরে ফিরে এলেন রোহিতাশ্ব, ফিরেই চমকে উঠে থমকে গেলেন। কুশাসনটির কাছে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবতী, আগে কখনো একে দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না তিনি। এর পোষাক ও মুখ অদৃষ্টপূর্ব। মেয়েটি শান্ত মুখে কৌতূহলী দৃষ্টি তুলে চেয়ে আছে রোহিতাশ্বের দিকে। এ কী আশ্চর্য কান্ড! জাদু নাকি অন্যকিছু? ইনি কে? কোথা থেকে এলেন? স্বর্গ থেকে আসা কোনো দেবদূতী?
রোহিতাশ্ব নিজের জায়্গায় অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, গলা শুকিয়ে আসছে তৃষ্ণা।
চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। যুবতী এক পা এগিয়ে এসে খুব কষ্ট করে করে শব্দ মনে করে করে কথা বলার মতন করে বলল, "আপনি রোহিতাশ্ব, না? প্রসিদ্ধ ভিষক? বর্তমানে আয়ুর্বেদ সম্পর্কে গ্রন্থ লিখছেন? "
রোহিতাশ্ব কিছু বলতে পারলেন না, দেখলেন মেয়েটির মুখে সদানীরার মুখ জ্বলজ্বল করছে। তিনি অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন ভূমিতে।
*****
স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠে অদীনা। এই স্বপ্ন সে দেখছে বেশ কিছুদিন।
ডক্টর হপকিন্সের কাছে সে গিয়েছিল হিন্দোলের সঙ্গে, ডাক্তার ভদ্রলোক আগেও ওর চিকিৎসা করেছেন। নতুন নতুন সমস্যাগুলো সব শুনে তিনি কিছু ওষুধ দিলেন আর রিল্যাক্স করার কিছু টেকনিক শেখালেন। দিনে একবার আর রাত্রে আরেকবার মনকে সম্পূর্ণ চিন্তাশূন্য করে দেহকে শিথিল করে ফেলতে হবে। এখন হিন্দোল আর অদীনার শোবার ঘর আলাদা, অদীনাকে কোনোভাবে ডিস্ট্র্যাক্ট করা চলবে না বলে ডাক্তারের পরামর্শেই হিন্দোল এই ব্যবস্থা করেছে।
দেহমন শিথিল করে মনকে চিন্তামুক্ত করার চেষ্টায় প্রথম কিছুদিন একেবারেই সাফল্য পায়নি অদীনা।
যত মনকে চিন্তাশূন্য করতে যায় তত দেওয়ালির সময়ের শ্যামাপোকার মতন পিল পিল করে চিন্তাভাবনা, সুখ দুঃখের স্মৃতি সব উড়ে আসে। জটলা পাকায়, সব ঘুলিয়ে দেয়। বেশ কিছুদিনের প্রবল চেষ্টার পরে এখন অদীনা মনকে চিন্তাশূন্য করে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আর ঘুমোলে সে ধারাবাহিকভাবে রোহিতাশ্বের জীবনের ঘটনাক্রম দেখতে পায়, একদম জীবন্ত স্বপ্ন, স্পষ্ট সব দেখতে পায় সে।
ঘুম ভেঙে সে খুব অবাক হয় প্রতিবারই।
কে রোহিতাশ্ব? কেন সে তাকে স্বপ্নে দেখে? গতজন্ম সে বিশ্বাস করে না সচেতনভাবে, তাই এটাকে বিগত কোনো জন্মের কথাও সে ভাবতে পারছে না। তাহলে এর ব্যখ্যা কী? হয়তো ডক্টর হপকিন্স কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। কিন্তু অদীনা ঠিক করতে পারছে না সে কীভাবে ডাক্তারকে এসব বলবে অথবা আদৌ বলবে কিনা! ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে অদীনা।
সকালে ওকে ডেকে তোলে হিন্দোল, হাতে গরম ধোঁয়াওঠা সাদা টার্কিশ তোয়ালে। অদীনার হাতে সেটা দেয় হিন্দোল, অদীনা গরম তোয়ালে মুখের উপরে হাল্কা চেপে ধরে ঘুম থেকে বেরিয়ে আসে, এই গরম ভাপটুকু আর কোমল স্পর্শটুকু ভারী আরামদায়ক।
তারপরে মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে একেবারে স্নান সেরে বেরোবে অদীনা। হিন্দোলের আগেই সেসব হয়ে গেছে, সে তখন ব্রেকফাস্ট বানায়।
অদীনার ভালো লাগে এই যত্ন, আবার মাঝে মাঝে কেমন অপরাধী অপরাধী মনে হয় নিজেকে। যেন দাম না দিয়ে এত যত্ন চুরি করে নিচ্ছে সে। অদীনার এমন কী আছে যে এইভাবে জীবনপাত করে ওকে যত্ন করছে হিন্দোল? নিজের সম্পর্কে উদাসীন অদীনার চোখে পড়ে না আয়নার ভিতরের সুন্দরী যুবতীর দিকে, তার বুদ্ধিদীপ্ত জ্বলজ্বলে চোখের দিকে, সুন্দর পদ্মকলির মতন আঙুলগুলোর দিকে, রেশমের ঝর্ণার মতন একঢাল সুন্দর চুলের দিকে।
আনমনে গুনগুন করতে করতে স্নান করে অদীনা, ফেনা করে সাবান মাখে, চুলে শ্যাম্পু ঘষে আস্তে আস্তে, শাওয়ারের জলধারার নিচে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ভারী আরামে ভাবতে থাকে স্বপ্নে দেখা যমজ মেয়ে দুটির কথা। আহা, মাত্র তিন বছর বয়স থেকে ওরা মা ছাড়া। কী হলো ওদের তারপরে? ঠিক যেন একটা ধারাবাহিক গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েছে অদীনা।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।