পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন শেষ পর্যন্ত যে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে, তা বিশ্বের জন্য স্বস্তির কথা। সম্মেলনের শুরু থেকেই কয়েকটি বিষয় নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছিল। এর মধ্যে একটি হলো লস অ্যান্ড ড্যামেজ, অর্থাৎ পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ-পদ্ধতি কী হবে। আর দ্বিতীয়টি হলো জলবায়ু তহবিলে (ক্লাইমেট ফান্ড) উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি আদায়। জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কৃষির ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
সুতরাং, এ বিষয়টিও সামনে আনার প্রশ্ন ছিল।
অনেক তর্ক-বিতর্কের পর কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা কম সাফল্য নয়। অনেকেই ভাবছিলেন, কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই সম্মেলন শেষ হবে। সে রকম হলে মারাত্মক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতো।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে দর-কষাকষি করতে নির্ধারিত সময় বাড়ানো হয়। অতিরিক্ত প্রায় ৩০ ঘণ্টা ধরে আলোচনা চলে। উন্নত দেশগুলো নতুনভাবে অর্থায়নে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে সম্মত ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু শব্দের হেরফের করে সিদ্ধান্ত হয়।
যেমন, ২০১৫ সালে প্যারিসে যে জলবায়ু সম্মেলন হবে, তাতে একটি নতুন চুক্তি হওয়ার কথা, যা ২০২০ সাল থেকে কার্যকর হবে।
এই চুক্তির খসড়া প্রণয়ন ও পথনকশা তৈরি করার বিষয়ে সম্মেলনে অনেক শব্দ, বাক্য নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ হয়। গ্রুপ-৭৭ + চীনের অবস্থান ছিল যেন উন্নত দেশগুলো অর্থায়নে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু উন্নত দেশগুলো জলবায়ুসংকট মোকাবিলায় উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি চাওয়া হয়। এই ‘প্রতিশ্রুতি’ শব্দটি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। চীন ও ভারত আপত্তি তুলে বলে, শুধু উন্নত দেশগুলোকে ‘প্রতিশ্রুতি’ দিতে হবে, আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর থাকবে সহায়তামূলক পদক্ষেপ।
শেষ পর্যন্ত ‘প্রতিশ্রুতি’ শব্দের স্থলে ‘অবদান’ শব্দটি গ্রহণে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়।
দর-কষাকষির সময় বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল বিভিন্ন পর্যায়ে বেশ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। মালদ্বীপ, কোস্টারিকাসহ ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত সিভিএফের (ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম) সঙ্গে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিরা বৈঠক করে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে কার্যক্রম গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ২০০৯ সালেই ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ৩৮৫ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
একই সঙ্গে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর অর্থায়নে আলাদা একটি তহবিল গঠনের মাধ্যমে অ্যাডাপ্টেশন ও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনার জন্য (মিটিগেশন) বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
দুটি জলবায়ু তহবিল গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের উদ্যোগ গ্রহণ সবাই প্রশংসা করেন। ১৮ নভেম্বর সম্মেলন ভেন্যুতে বাংলাদেশ আয়োজিত এক সাইড ইভেন্টে এলডিসি গ্রুপের চেয়ার প্রকাশ মাথেমা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণে বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেন, প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে। এ জন্য পুরো কৃতিত্বের দাবিদার বাংলাদেশ। এমনকি তিনি এটাও বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলো ওয়ারশ জলবায়ু সম্মেলনে যে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে, তার পেছনে বাংলাদেশের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় অভিযোজন হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। তাই কানকুন অ্যাডাপ্টেশন ফ্রেমওয়ার্কের দ্রুত বাস্তবায়ন চায় বাংলাদেশ। ১৯৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হলো চতুর্থ রাষ্ট্র, যে গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর বিষয়ে কিওটো প্রটোকলের সেকেন্ড কমিটমেন্ট পিরিয়ড অনুস্বাক্ষর করেছে। এ জন্য সম্মেলনে বাংলাদেশ বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের (ইউএনএফসিসিসি) নির্বাহী পরিচালক মিজ ক্রিশ্চিয়ানা ফিগারিস তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের এই পদক্ষেপের প্রশংসা করে অন্যান্য দেশের প্রতিও এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যৎ ক্ষতি মোকাবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য একটি পদ্ধতিগত কাঠামো তৈরির বিষয়ে প্রতিনিধিরা ঐকমত্যে পৌঁছান। সম্মেলনে ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজম ফর লস অ্যান্ড ড্যামেজ-এর ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়েছে। যেসব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করে, তাদের থেকেই নির্বাহী কমিটির সদস্য নেওয়া হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই শতাব্দীর বাকি সময়টুকুতে প্রতি দশকে শস্য উৎপাদন অন্তত ২ শতাংশ হারে কমবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন।
অথচ এই সময়ে প্রতি দশকে খাদ্যের চাহিদা অন্তত ১৪ শতাংশ হারে বাড়বে। কারণ, জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের জনসংখ্যা বর্তমানের ৭২০ কোটি থেকে বেড়ে ২০৫০ সালে দাঁড়াবে ৯৬০ কোটিতে। আর তাদের অনেকেই উন্নত মানের খাদ্য কেনার মতো সক্ষমতা অর্জন করবে (নিউইয়র্ক টাইমস, ১ নভেম্বর, ২০১৩)। সুতরাং, জলবায়ু পরিবর্তন যে কত বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে, তা সহজেই বোঝা যায়।
আগে যুক্তরাষ্ট্র উদাসীন ছিল।
জলবায়ু পরিবর্তন যে বিশ্বের জন্য সমস্যা হয়ে উঠবে, সেটা তাদের বিবেচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল না। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রও নতুনভাবে চিন্তা করছে। সম্প্রতি হোয়াইট হাউস গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ২০২০ সালের মধ্যে ১৭ শতাংশ কমিয়ে আনার (২০০৫ সালের মাত্রার তুলনায়) লক্ষ্যমাত্রার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে যেসব গাড়ি বিক্রি হবে, ওগুলো যেন প্রতি গ্যালনে সাড়ে ৫৪ মাইল চলে, তা ২০২৫ সালের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, সব দেশেই যে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝাপটা লাগবে, সেটা উন্নত দেশগুলোও উপলব্ধি করতে শুরু করেছে।
এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি ওয়ারশ সম্মেলনে ইতিবাচক ছাপ ফেলেছে।
সম্মেলনে জলবায়ু অভিযোজন তহবিলের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ১০ কোটি ডলার সঞ্চিত হয়। উন্নত দেশগুলো জলবায়ু তহবিলে তাদের অবদান আরও বাড়াবে বলে আশা করা যায়। তহবিল আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে।
ওয়ারশ সম্মেলনের আগ মুহূর্তে ফিলিপাইনে সুপার টাইফুন হাইয়ানের আঘাতে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, প্রায় সব দেশের প্রতিনিধি তাঁদের ভাষণে তা উল্লেখ করেন।
জলবায়ুর উন্মত্ত আচরণ সবাইকে বিচলিত করে তোলে। এমনকি ফিলিপাইনের ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য সম্মেলন অনুষ্ঠানস্থলে স্বেচ্ছাসেবীরা দানবাক্স নিয়ে নেমে পড়েন। অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
২০১৫ সালে প্যারিসে সম্মেলনে জলবায়ু চুক্তি সম্পাদনে কোনো গড়িমসি করার সুযোগ নেই। সম্মেলনে প্রতিনিধিরা বারবার বলেন, জলবায়ু বিপর্যয় রোধের কাজ আগামীকালের জন্য ফেলে রাখা যাবে না, এমনকি আজ করব বলেও নিশ্চিন্তে বসে থাকা যাবে না।
পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।