মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!
হ ম এরশাদের শাসনামল - ৫
---------------------- ডঃ রমিত আজাদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে)
আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারী করেন। এটাই ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসন। এসময়ে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন জেনারেল শফিউল্লাহ। পরবর্তিতে বীর উত্তম জিয়াউর রহমান সেই সামরিক শাসন তুলে নিয়ে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালে এদেশের জনগণ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র তথা বাক স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছিলো।
পরবর্তিতে প্রথমে একদলীয় শাসন ও পরে সামরিক শাসনে দেশে শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এসময়ে জিয়াউর রহমান কর্তৃক গণতন্ত্র তথা বাক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ জেনারেল এরশাদ একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রীক সরকারকে উৎখাত করে দেশে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি করেন। দেশের সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিক এর ভয়াবহতা উপলদ্ধি করতে না পারলেও সুযোগ্য ও বিচক্ষণ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। কথিত আছে যে তিনি এরশাদকে দেশের জন্য গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা বিষয়টি যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাতে চাইছিলেন।
কিন্তু একটি প্রবাদ রয়েছে, 'চোরায় না শোনে ধর্মের কথা। '
১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ সকালে আমার সেজ ফুপু (পেশায় আইনজীবি ছিলেন) বললেন, "শুনেছিস দেশে মার্শাল ল দেয়া হয়েছে, সাত্তার আর প্রেসিডেন্ট নাই। " আমি যদিও তখন বয়সে ছোট, কিন্তু এই অল্প সময়েই দেশে অনেক রাজনৈতিক ডামাডোল দেখেছি। আমার জন্মের এক বছর পরই হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধ যা আমার স্মৃতিতে নেই। কিন্তু '৭৫-এর ঘটনা ঘটেছিলো আমাদের বাড়ীর অদূরেই।
ভোর রাতে গোলাগুলির শব্দও শোনা গিয়েছিলো। তারপর ৩রা ও ৭ই নভেম্বর, তারপর আবার ১৯৮১ সালের ৩০শে মে এইসব চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যেই নাগরিক জীবন কেটেছে। ভাবলাম, এখন আবার কি হলো? আমি বললাম, "কে এখন প্রেসিডেন্ট?" ফুপু বললেন, "জেনারেল এরশাদ চীফ মার্শাল ল' এ্যাডমিনিস্ট্রেটর। " বয়স অল্প থাকায় অত কিছু বুঝতে পারিনি। দৌড়ে গিয়ে একে-ওকে জানালাম, যেন গুরুত্বপূর্ণ এক সংবাদ দিচ্ছি।
মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো। কেউ কেউ বললো, 'এরকম একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো, এরশাদের চলাফেরা সুবিধার ছিলোনা'। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সেনা-প্রধান এরশাদকে প্রধান বা বিশেষ অতিথি হিসাবে দেখা যাচ্ছিলো। কখনো কখনো বিটিভিতেও তা প্রচার করা হতো। এটা আগে কখনো ঘটেনি।
সুঠাম দেহের অধিকারী এরশাদকে দেখে মাঝে মাঝে দু'একজন বলে বসতো, "পাওয়ার নিয়ে ফেলবে বোধহয়'। জনগণের এধরনের মন্তব্য করা ঠিক হয়নি এগুলোই এই জাতীয় লোককে আশকারা দিয়ে থাকে। আবার এমনও হতে পারে যে, খুব সুকৌশলে এসব কথাবার্তা বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছিলো। কেউ কেউ বললো, 'ভালো হয়েছে এখন পিটিয়ে সোজা করা হবে। ' কাকে পিটিয়ে কে সোজা করবে তা অবশ্য ক্লিয়ার ছিলোনা।
আমরা বোধহয় বৃটিশ আমল থেকে এভাবেই প্রোগ্রামড্ হয়ে আছি। স্বাভাবিকভাবে ভালো থাকতে পারিনা। ডান্ডাবাজির প্রয়োজন মনে করি। আবার কেউ যথেষ্ট উষ্মা প্রকাশ করে বললো, 'সামরিক শাসনের কি প্রয়োজন ছিলো? দেশে তো কোন গোলযোগ হয়নি!" যতদূর শুনেছি, সেনা-প্রধান এরশাদকে অবসর দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট সাত্তার। নতুন সেনা-প্রধান কাকে করবেন তাও ঠিক করে ফেলেছিলেন।
এরশাদকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন অবসরের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বভার নিতে। এরশাদ তাতে তো রাজী হনইনি, উল্টা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারপরই ক্ষমতা দখলের ঘটনাটি ঘটে। যাহোক, এদিকে রেডিওতে সামরিক শাসন জারীর ঘোষণা দেয়া হচ্ছিলো, এবং বলা হচ্ছিলো যে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। সবাই সেই ভাষণের অপেক্ষা করছিলো।
এদিকে দুদিন পরেই ছিলো স্বাধীনতা দিবস, ২৬শে মার্চ। ঐদিন ন্যাশনাল প্যারেড হয়ে থাকে। সৈন্যরা কিছুদিন যাবৎ সেই প্যরেডের মহড়া দিচ্ছিলো। হঠাৎ করে সামরিক শাসন জারি হলে প্যারেড ভেস্তে যায়। ঢাকার রাস্তায় তখন নেমে আসে শত শত সৈনিক।
নগরীর বিভিন্ন স্থানে তারা অবস্থান নেয়।
২৪ শে মার্চ দুপুরের দিকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে শুরু করেন জেনারেল এরশাদ। জাতীয় রেডিও ও টেলিভিশনে ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সমগ্র দেশ তখন হুমড়ি খে্যে পড়ে রেডিও-টেলিভিশনের সামনে। সামরিক উর্দি পরিহিত এরশাদের এই ভাষণ ছিলো অতি দীর্ঘ, শুনতে শুনতে অনেকে বিরক্ত হয়ে যায়।
মনে হচ্ছিলো যেন, বলার সুযোগ পেয়ে আর ছাড়তে চাইছেন না, অথবা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আত্মপক্ষের সাফাই গাইতে গিয়ে একথা সেকথা নানা কথা বলতে হচ্ছে তাকে। সচেতন মানুষের মনে একটি প্রশ্নই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিলো, কেন এরশাদ সামরিক শাসন জারী করলেন, কি এমন ঘটলো যে দেশে সামরিক শাসন জারী করতে হবে? সকলেরই মূল আগ্রহ ছিলো এরশাদ নিজে এই বিষয়ে কি বলে তা শোনার।
অতঃপর এরশাদ তার বিরক্তিকর দীর্ঘ ভাষণে যা বললেন তার কিছু অংশ নিচে তুলে ধরছি।
‘যেহেতু দেশে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে যাতে অর্থনৈতিক জীবনে নেমে এসেছে অচলাবস্থা, বেসামরিক প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারছে না, সকল স্তরে যথেচ্ছ দুর্নীতি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ফলে জনগণ অসহনীয় দুর্দশায় পড়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিপজ্জনক অবনতি ঘটেছে, শান্তিস্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন করা মুশকিল হয়ে পড়েছে, রাষ্ট্রীয় কর্তব্যে অবহেলা করে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করেছে।
‘যেহেতু দেশের জনগণ চরম নৈরাশ্য, হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে গেছে,
‘যেহেতু বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এবং জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে কষ্টার্জিত দেশকে সামরিক আইনের অধীনে ন্যস্ত করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে এবং জনগণ ও দেশের প্রতি তাদের কর্তব্যের অংশ হিসেবে এ দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীর উপর পড়েছে,
‘এখন অতএব আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য ও করুণায় এবং আমাদের মহান দেশপ্রেমিক জনগণের দোয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ বুধবার থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সকল ও পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করছি এবং ঘোষণা করছি যে গোটা বাংলাদেশ অবিলম্বে সামরিক আইনের আওতায় আসবে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আমি বাংলাদেশের সকল সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছি।
‘এ ব্যাপারে আমার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা বলে আমি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আরো ঘোষণা করছি যে:
(ক) ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ বুধবার থেকে আমি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করছি।
(খ) আমি যে-কোনো ব্যক্তিকে দেশের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করতে পারি, যিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি অথবা আমার মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণ করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। আমি সময় সময়ে এ মনোনয়ন বাতিল বা রদ করতে পারি এবং আর এক ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান হবেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রূপে আমার উপদেশ অনুসারে কাজ করবেন এবং আমি তাকে যেসব কাজের দায়িত্ব দেব তা পালন করবেন।
’
'দেশের সংবিধান স্থগিত রাখা হয়েছে। আমি নব-নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দিলাম। সামরিক আইন জারির সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার কেউই তাঁদের পদে বহাল নেই, মন্ত্রিপরিষদও নেই। '
এত কিছুর পরেও স্পষ্ট হচ্ছিলো না, এরশাদ তার ক্ষমতা দখলকে জাস্টিফাই করার জন্য কি বলেন। এটাই সবাই বেশী শুনতে চাচ্ছিলো।
এক সময় তিনি বললেন, 'অনেক আশা নিয়ে জনগণ একটি সরকার নির্বাচিত করেছিলো, কিন্তু অল্প কিছুকাল পরেই তাদের আশা-আকাঙ্খা ধুলিস্মাৎ হয়ে যায়। ' তিনি আরো বলেন, "আমি এই মুহুর্তে ক্ষমতা গ্রহন না করলে দেশ এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তো। আপনার ইতিমধ্যেই পত্রিকা মারফৎ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনাহারে মৃত্যুর সংবাদ পাচ্ছিলেন। '
এবার অনেকের চোখই কপালে উঠে গেলো। চুয়াত্তরের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখার পরে আর কোন দুর্ভিক্ষের মুখোমুখী হয়নি বাংলাদেশ।
তবে সেই দুর্ভিক্ষের স্মৃতিও মুছে যায়নি। ঐ ভয়াবহ দিন আবার কেউ দেখতে চায়না এটা নিশ্চিত। এখানেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো। অনেকে বললো, 'যাক বেঁচেছি, দুর্ভিক্ষের হাত থেকে দেশ বেঁচে গেলো'। অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা গেলো, কবে আবার অনাহারে মৃত্যুর সংবাদ এলো? খ্যাতিমান কোন সংবাদপত্রে তো সেরকম কিছু পাইনি।
অখ্যাত সংবাদপত্রের সংবাদকে কতটুকু গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে? আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যদিওবা দারিদ্রের কারণে এমন দু'একটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেও থাকে, সেটা দুঃখজনক নিঃসন্দেহে, কিন্তু ব্যাপক খাদ্যাভাবের কথাতো কেউই শোনেনি।
ঠিক বললেন কি ভুল বললেন, কিছুই আমরা বুঝলাম না। তবে এটুকু নিশ্চিত বুঝলাম যে, এরশাদই এখন দন্ডমুন্ডের কর্তা। দেশের আট কোটি মানুষ এখন তার হাতে জিম্মি হয়ে গেলো। ২৪ শে মার্চ সন্ধ্যা থেকে একের পর এক এরশাদী ফরমান জারী হচ্ছিলো।
ঘোষক অবিরাম পড়ে যাচ্ছিলো, 'মার্শাল ল নাম্বার ওয়ান ............, মার্শাল ল নাম্বার টু ............, মার্শাল ল নাম্বার থ্রী ....................। ' আমাদের কাজের মেয়েটি হঠাৎ বলে উঠলো, "খালাম্মা, মশল্লা মশল্লা করে ক্যান?"
পর দিন ২৫ মার্চ থেকেই জারি করা হয় সান্ধ্য আইন। সেদিন থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয় ৬১৩ জনকে। ৯ এপ্রিল মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৪২ থেকে নামিয়ে আনা হয় ১৭-তে। ১১ এপ্রিল ঢাকা জেলা ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের উদ্দেশে তিনি দম্ভের সঙ্গে বলেন, 'আমি এমন এক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব, যা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
'
পরবর্তিতে কি গণতন্ত্র এরশাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এবং কি ইতিহাস হয়ে আছে তা আমরা সকলেই জানি।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।