আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আসুন এক কাতারে দাঁড়িয়ে দৌড়াই

রাজা যদি প্রজা পালন না করে প্রজা বিনাশ করে তাহলে সে দেশ ও জাতি ধিক, সে গণতন্ত্রও ধিক। আমরা এমন একটি দেশে এখন বাস করছি এবং বাজারমূল্যে জীবিকা নির্বাহ করছি, তা ভাবতেও অবাক হতে হয়। যে শাসনে বেঁচে আছি তা অতি বড় মন্দ ভাগ্যের জন্যও দুশ্চিন্তার বিষয়। দ্রব্যমূল্যের কথা যখন উঠল তখন বলা যায়, আমাদের পাশর্্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গে একইভাবে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা কিছু নিত্যপণ্যের রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে।

মুখ্যমন্ত্রী নিজে প্রায়ই বাজারে যাচ্ছেন। লবণের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। জনগণকে সচেতন করছেন, বাজারে আইনও প্রয়োগ করছেন। একে বলে সুশাসন। রাজা প্রজার জন্য চিন্তা করেন।

আর আমরা বর্তমান অবস্থায় কি পদক্ষেপ নিয়েছি বাজার দরের জন্য। এখানে শাসনের সমালোচনা করাও মনে হয় দণ্ডনীয় বিষয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমাদের দেশের রাজনীতিও বর্তমানে অতি বড় নাবালকদের হাতে। রাজনীতিবিদরা মনে করেন, সাধারণ মানুষ বোকা এবং নির্বোধ। কিন্তু বর্তমান দৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আজ থেকে এক বছর আগে থেকে বলে আসছে যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কোনোক্রমেই ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন করবেন না।

কিন্তু বিরোধী দল বোকার মতো এই একটাই দাবি করে আসছে বা করে যাচ্ছে। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন সরকারের ইশারায় পরিচালিত হচ্ছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে ধীরলয়ে। সরকার র্যাব, পুলিশ প্রভৃতি বাহিনীকে বেতন-ভাতা ও পরিতোষ দিয়ে নিজেদের দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করছে এবং তার উপরেও '৭৩, '৭৪ সালের মতো লাল বাহিনী, সবুজ বাহিনী ইত্যাদি সৃষ্টি করছে। জনগণের দেওয়া সুরক্ষা গ্রহণ না করে সরকারকে বিভিন্ন বাহিনীর বেষ্টনে থাকতে হচ্ছে।

যারা বিরোধিতা করছে তাদের জেল-জুলুম, গুম করে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হচ্ছে। অত্যাচার যত কঠিন ও নির্মম হোক না কেন, এরও পরিসমাপ্তি এক সময় হয়। সরকার কখনো একদলীয় হচ্ছে, কখনো অনুগত বিরোধী দলকে নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন করছে। সরকারি কর্মচারীদের সবরকম ছাড় দিয়ে এমনকি দুর্নীতি দমন আইন সংশোধন করে তাদের অবৈধ কাজকে বৈধ রূপ দিতে বাধ্য করছে। সাধারণ মানুষের হতবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

তবে কিছু কিছু লোক সরকারের বিষোদগার করতে করতে সরকারের মিছিলে মিশে যাচ্ছে জনগণের জন্য এটা কোনো অবাক করার বিষয় নয়। এখন মনে হয় এসবের প্রয়োজন কি ছিল। এর চেয়ে ১৯৭৫ সালের মতো ঘোষণা দিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা যেতে পারে। ব্যাসদেব মহাভারত রচনায় বীর যোদ্ধা অর্জুনকে যুদ্ধে নামানোর আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পাশে বসিয়েছেন। তার পরও স্বস্তি না পেয়ে শিখণ্ডীকে এনে ষোলকলা পূর্ণ করলেন।

বিপরীত দলের সেনাপতি বীরযোদ্ধা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি কখনো স্ত্রীলোক বা স্ত্রী জাতীয় পুরুষকে শর নিক্ষেপে হতাহত করবেন না। তাই শিখণ্ডীকে রথ চালানোয় নিযুক্ত করা হয়েছিল, যাতে ভীমের শর নিক্ষেপে হত না হয়। যে দলে ভগবান থাকেন তাকে যুদ্ধে কে পরাজিত করবেন? আমাদের সরকারের পেছনে যদি ভগবানের শ্রীহস্ত থেকে থাকে তাহলে শিখণ্ডীকে নতুন করে দলে টানার কি প্রয়োজন ছিল। জনগণ এটাও বোঝে। সরকারের এসব কর্মকাণ্ড দেখে অবাক না হয়ে দেখতে হয় অতীতে এ রকম কখনো হয়েছিল কিনা।

বিগত সময়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যেভাবে জরুরি আইন দিয়ে দেশ শাসন করেছিলেন, যেভাবে তার পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর মঞ্চ নামে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে একটি প্রাইভেট বাহিনী তৈরি করে সে দেশে বিরোধী দলের ওপর নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচারের পথ বেছে নেওয়া হয়েছিল। দীক্ষিত ও হাসকারার মতো সচিবদের দিয়ে প্রশাসনকে চরমভাবে দলীয়করণ করা হয় সে সময়। শুক্লার মতো মন্ত্রীকে দিয়ে জনসাধারণের ওপর জোরপূর্বক জন্ম নিয়ন্ত্রণের অপারেশন করা হয়। তাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়তো কিছু রোধ হয়েছিল। আমাদের সরকার বিরোধী দলকে ছাঁটাই করছে, কথা বলার অধিকারকে সীমিত করছে।

গণতন্ত্রকে শাসকের অনুকূলে বিরোধিতা নিরোধ করেছে। তারা দীক্ষিতদের মতো প্রশাসনকে গণতন্ত্রের নামে একদলীয় শাসনের ছাঁচে ঢালাই করছেন। সঞ্জয় মঞ্চের মতো ভাড়াটে অস্ত্রধারী আমদানি করে সরকার বিরোধীদের নিমর্ূল করছে। ইন্দিরা গান্ধীপুত্র সঞ্জয়কে রাজনীতিতে এনেছিলেন। আর আওয়ামী লীগ এনেছে জয়কে।

সেই একই ছাঁচে খেলা চলছে। দেশে অলিখিত ইমার্জেন্সি শাসন অব্যাহত গতিতে চলমান। এরূপ অবস্থা অতীতে আগেও দেখা গেছে রাশিয়ায় বিপ্লবের সময়। তখন জারিনা ক্যাথেরিন দেশে শাসন করতেন। তাকে বলা হয়ে থাকে ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট।

তাকে ক্ষমতায় আনে চার্চের পুরোহিতরা। যাদের সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। জারিনা ক্ষমতায় এসে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন এবং তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেননি। তাকে বলা হয়েছিল ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিতে। কিন্তু তিনি উত্তরে বলেছিলেন, যদি আমাকে শাসন করতে হয়, তাহলে কোনোরূপ ভাগাভাগি নয়, আমি একাই শাসন করব এবং তাই করেছিলেন।

সেদিনও আমাদের মতো দরিদ্র কৃষকরা সরকারের ওপর বিরূপ ছিল। প্রধানমন্ত্রী তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, দেশ ছেড়ে চলে যেতে বা বিপ্লব আনতে। জারিনা এই বিপ্লবীদের সঙ্গে মিশে যান এবং যতটুকু সুবিধা আদায় করার করে নিয়ে সময়মতো বিচারকদের দিয়ে বিপ্লবীদের হত্যা করেন। নিজের অনুগত লোকদের আর্থিক সুবিধা যতটুকু সম্ভব দেওয়ার পর তাদের নির্মমভাবে পরিত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগও অতীতের পুনরাবৃত্তি করবে।

অর্থাৎ এরশাদ সাহেব যে লোভে ছুটছেন বা যারা মহাভারতের শিখণ্ডী হয়েছেন তাদের বলতেই হবে যে, ক্ষমতার কোনো ভাগাভাগি হবে না। এই লোভ পূরণ হবে না। তারা যেভাবে সম্পূরক পরিচয়ে ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার সেই সম্পূরক হতে হবে। অতীতে তারা কখনো অজেয়-অমর হয়নি। ইতিহাস এ শিক্ষাই দেয়।

আমরা অনেক সময় বলে থাকি, আমি অমুক ভুল করেছি, অমুক ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে এ কথাটি সত্য নয়। নিয়তি ওই ভূমিকা পালনের জন্য আকর্ষণ করে বা টেনে আনে। প্রকৃতি সব কার্যকরণের গুণাগুণ তুলাংশে পরিমাপ করে এবং নির্দিষ্ট পরিণামের দিকে ধাবিত করে। সব শাসকই অবহিত যে, সুশাসন শাসককে অমর করে এবং গণতন্ত্রে পরমতসহিষ্ণুতা শাসকের পরিহার্য পরিচ্ছেদ। জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত হলে তাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হয়।

কৌশল করে রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করে ভোটে কারচুপি করা যায় কিন্তু জনসাধারণের হৃদয় জয় করা যায় না। বর্তমানে সরকার শিখণ্ডীসম কিছু লোক জোগাড় করতে পেরেছে। এদের দিয়ে বহুদলীয়, সর্বদলীয় বা অন্তর্বর্তীকালীন বা নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেছে। কিন্তু শূন্যের সঙ্গে যত শূন্য বসাবেন তার যোগফল শূন্যই থাকে। এ কথা বোঝার জন্য যাদব বাবুর পাটিগণিত অনুশীলন করতে হয় না।

বিগত নির্বাচনে এই আওয়ামী লীগ সরকার দরিদ্র ও বেকার ছেলেদের নির্বাচনে ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার নামে আকর্ষিত করতে পেরেছিল। সে কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। এরা চরম দরিদ্রতার হতাশায়, বঞ্চনা, আঘাতে মর্মাহত এবং চরম বিরূপ হয়ে আছেন। সারা দেশ হতাশার কুয়াশায় আচ্ছন্ন। র্যাব, পুলিশ দিয়ে মানুষ হত্যা করা যায় কিন্তু তার মন নিজের দিকে ফেরানো যায় না।

আর আমার দেশের রাজনীতিবিদরা নির্বাচনের জন্য যে ম্যানুফেস্টো তৈরি করেন তা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য অনেক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়ে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসার পর পূরণ করা সম্ভব হয় না। সে জন্য পরিচ্ছদ তৈরি করার সময় কাপড়ের হিসাব করে তৈরি না করলে পা ঢাকতে মাথা বেরিয়ে যায়। যখন লড়াইটা অস্তিত্বের হয় তখন সংলাপ করে কোনো সমাধান হয় না। স্বার্থে অন্ধ হয়ে সরকার বা বিরোধী দল কারও ছুটে যাওয়া উচিত নয়। নিজ স্বার্থকে জনস্বার্থের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার করতে পারলে মানুষকে আয়ত্তে রাখা যায়।

নির্বাচনে ঝুঁকি নিতে হয়। মুরবি্বদের ওপর ভর না করে জনসাধারণের ওপর বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যেতে পারলে কিছু কাজ হয়। সালিশি শক্তির ওপর নির্ভর না করে নিজের ওপর নির্ভর করতে হয়। কারণ মানুষ এতই পোড় খেয়েছে যে, কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, কারও কথাতে প্রভাবিত হয় না।

সময় থাকতে সাধারণ মানুষের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রেখে তার কাছে এগিয়ে যাওয়া সঠিক পথ।

দেশ কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর নয়, জনগণ মালিক মোক্তার। ক্যাথেরিনের পরিণতি কখনো কাম্য নয়। ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল, সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছিল এবং এর চেয়ে করুণ আর কি হতে পারে। এর থেকে পরিত্রাণের পথ হলো যত দ্রুত মানুষের কাছে যাওয়া। মানুষকে কৌশলে টানার চেষ্টা না করা।

অতীতে যারা ভুল করেছিলেন তাদের খেসারত দিতে হয়েছে। একদলীয় শাসন বা রিমোট কন্ট্রোলে নির্বাচন করা বা ভোটারবিহীন ভোটে পাস করা আমাদের দেশের পোড় খাওয়া মানুষের ভীতির সঞ্চার করবে। তাই আসুন দৌড় প্রতিযোগিতায় সরকার বা বিরোধী দল সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে কাতার সোজা করে একসঙ্গে দৌড় শুরু করি।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

 

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।