সন্ধ্যার এই সময় টা বড়ই বিরক্তিকর। রাস্তায় এত বেশি চাপ থাকে কল্পনার বাইরে। কোন বাসে খালি সিট পাওয়া শুধু অসম্ভবই না,অকল্পনীয়ও বটে। কোন মতে বাসের পা দানি তে দাড়ানোর একটা জায়গা পাওয়াও রীতিমত সৌভাগ্যের ব্যাপার।
বাবার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম অফিসে।
জরুরী কাজে আজ রাতেই যেতে হবে সাভারে,মায়ের কাছে। মায়ের কাছে জরুরী প্রয়োজনে যেতে হবে-মানে বুঝলেন না?মানে আমার মা-বাবা আলাদা থাকেন। মা থাকে মামার সাথে সাভারে,আমি আমার বাবার সাথে ঢাকাতে। বাবার থেকে কিছু টাকা নিলাম। বাবার অফিসে আমি খুব একটা আসিনা,কেমন যেন অপ্রস্তুত লাগে।
তাছাড়া যায়াগাটাও বড় বেখাপ্পা। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউশন,না না বাবা ইঞ্জিনিয়ার না,এখানে চাকরি করেন। তো শাহবাগ ছাড়া বাস পাবার কোন উপায় নাই,যদি জ্যামে বাস আটকে থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।
ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র হলেও শাহবাগের ওপাশে আসা হয়না সচরাচর। এখন এই সন্ধ্যায় অপেক্ষা করছি বাসের জন্য।
সুবিধা মত একটা খালি বাস পাওয়া যাচ্ছেনা। যাও বা আসছে,গেটে দাড়ানোর জায়গাটাও নেই। আমি দৌড়াদৌড়ি করে বাসে উঠতে পারিনা। ভয়?হ্যা ভয়ই বলতে পারেন।
মনটা খুব ভাল না।
মা অসুস্থ। কেমন একটা অদ্ভুত অবস্থা তাইনা?মা আছেন,বাবাও আছেন কিন্তু যে কোন একজন উপস্থিত তো অন্য জন নেই। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে পুরানো ফ্যামিলি ফটো গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার বয়স কম,আমার ছোট বোনের বয়স আরো কম। আমরা হাসিমুখে মাঝখানে,দুপাশে বাবা আর মা।
এই সময় গুলোও তো জিবনে ছিল তাইনা?ঐ ছবি তোলার মুহুর্তটা,ছবির হাসিটা-ওগুলোও তো একসময় সত্যি ছিল।
কি ভাবছি এগুলো?বারবার যেগুলো ভুলে থাকতে চাই সেগুলোই কেন মস্তিষ্কে এসে ভীড় করে?না আর না। ঐ যে একটা বাস দেখা যাচ্ছে,এটা কোন ভাবেই মিস করা চলবেনা। দৌড় লাগালাম,যে করেই হোক উঠতেই হবে।
উফ!যাক অবশেষে পারলাম তাহলে!এই সময় বাসে উঠতে পারা আর যুদ্ধ জয় করা অনেকটা একই ব্যাপার।
বাসে ভীড় কম,কেন কে জানে?একটা কারন হতে পারে ভয়ে মানুষজন নামছে কম ঘর থেকে। আসলেই দেশের যে অবস্থা,কখন কে কোথায় মরে পড়ে থাকবে কোন নিশ্চয়তা নেই।
আজ মনে হয় কপাল ভালই। আমি ওঠার সাথে সাথে এক লোক নেমে গেছে,ভাগ্য ক্রমে সিটও পেয়ে গেলাম!যাক ভালই হল,জানালার পাশে বসে যাওয়া যাবে,ভাবতে ভাবতে।
কি ভাবব?ভাবার জিনিসের কি আর অভাব আছে?দেশ,সমাজ,রাজনীতি,বন্ধু ,পরিবার আর তার কথা।
হ্যাঁ এ কদিন শুধু তার কথা ভাবতেই বেশি ভাল লাগে। ২০ বছরের ছেলে আমি অথচ তার কথা ভাবলেই যেন কিশোর হয়ে যাই। যদিও ওকে সামনা সামনি দেখিনি এখনো। কিন্তু ওর কথা শুনেছি,শুনেছি গানও। খুব সুন্দর গান গায় ও।
নাকি আমার কাছে সুন্দর লাগে?মোবাইলে রেকর্ড করে রাখা গান গুলো কতবার যে শুনি দিনের মধ্যে-হিসাব নেই। আমার বড় বোন এনিয়ে খোচা দিতে ছাড়েনা। ভাবছেন বড় বোন আবার এল কোথা থেকে?সৃষ্টিকর্তাই পাঠিয়ে দেয়রে ভাই। মায়ের পেটের বোন না হলে কি আপন বোন বলা যাবেনা?কিছু কিছু ব্যাখ্যাতীত সম্পর্ক সৃষ্টি হয় আমাদের জিবনে,জীবনের প্রয়োজনে।
ভাবছি ওর গান শুনব কিনা।
হেডফোন নেই,গান ছাড়লে অন্যান্য লোকদের বিরক্তির কারন হতে পারি। কি দরকার?পাশের লোকটাকে লক্ষ করলাম। মধ্যবয়স্ক লোকটা কিসের যেন চিন্তায় মগ্ন। পিছনের সিটে কে যেন জোড়ে জোড়ে ফোনে কথা বলছে। এই বিষয়টা আমার এত বিরক্ত লাগে,বলার বাইরে।
কেন রে ভাই একটু আস্তে কথা বলা যায়না?কোথায় কোন মাল ডেলিভারি দিতে হবে সেসবের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে লোকটা।
"মামা ভাড়াটা দিয়েন,"কনডাক্টরের কথায় চিন্তার রশিটা ছুটে গেল। ৫ টাকা ধরিয়ে দিলাম। "মামা দশ টাকা দেন",কন্ডাক্টর কি বুঝেনা আমাদের বয়সি পোলাপান ৫ টাকার বেশি দেয়না। আমি বললাম,"স্টুডেন্ট।
"
কন্ডাক্টর চলে গেল,মনে হয় বুঝল আমার থেকে আর টাকা পাবার আশা নাই। আচ্ছা এই যে পাচ টকা কম দিলাম এতে কি আমার খুব লাভ হল?জানিনা,কখনো ভেবে দেখিনি,ব্যাপারটা আসলে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। যেখানেই যাই,৫ টাকা!
রাস্তার দুপাশের ল্যাম্পপোস্ট গুলো দ্রুত বিপরীত দিকে ছুটে যাচ্ছে। বারবার কেন ওর কথা মনে পড়ছে?আমার তো ভাবার আরো অনেক কিছু আছে। আমার ছোট বোন যে এত অল্প বয়সেও মাকে ছাড়া দিব্যি হাসিমুখে থাকতে পারছে,আমার মা-আমাদের কে ছেড়ে থাকতেও পারছেনা আবার আমাদের সাথে থাকারও কোন উপায় নেই,বাবা-দিন রাত আমাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন কিংবা আমার বন্ধুরা-যারা আমাকে অনেক অনেক বেশি ভালবাসে।
আমার বড় বোনের কথাও ভাবতে পারি যাকে মজা করে "বোনটি" বলে ডাকি। তার বান্ধবিরা এটা নিয়ে তাঁকে ক্ষ্যাপায়-বোনটি চকলেট খাব,বোনটি আইস্ক্রিম খাব-এসব বলে। আমার শুনে খুব মজা লাগে। সেও যে আমাকে ভাইটি ডাকে এটা নিয়ে অবশ্য আমার কোন ফ্রেন্ড আমাকে ক্ষ্যাপায় না।
ভাবনা গুলো আসলে আমাদের ইচ্ছা মত আসেনা।
সেলুলয়েডের মত একটার পর একটা আসতে থাকে মনের চোখের সামনে। তাই বারবার ঘুরে ফিরে ওর কথাই মাথায় আসছে!কি যে করি!
এই ভালবাসা ব্যাপারটা কি আসলে মধুর নাকি যন্ত্রনাদায়ক?নাকি দুটোই?
দুজন লোকের ঝগড়ায় ভাবনায় বাঁধা পড়ল। সেই রাজনীতি নিয়ে ক্যাচাল। দুপক্ষের দুজনের মধ্যে লেগে গেছে!এ বলছে তোমার দল এটা করেছে তো ও বলছে তোমার দল ওটা করেছে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে কেউ একচুলও নড়ছেনা।
বাসে টেম্পুতে এই রাজনৈতিক ঝগড়াটা আমার বেশ মজা লাগে। দুজন সম্পূর্ন অপরিচিত লোক ঝগড়া করে যায়,অথচ যাদের জন্য ঝগড়া করে সেই নেতা নেতৃরা জানতেও পারেনা তাদের এত গুন্মুগ্ধ সমর্থক এখানে তাদের হয়ে লড়ে যাচ্ছে। বাস থেকে নামার পরই আবার যে যার মত,হয়তো ঐ দুজনের আর দেখাও হবেনা। এরকম যানবাহন টক-শো তে আমি সাধারনত নিরব দর্শক হিসেবেই থাকি।
প্রতিটা বাসের প্রতিটা ট্রিপ মানে অনেক গুলো কাহিনি।
এই যেমন সামনের মহিলা সিটে এক লোক গ্যাট হয়ে বসে আছে,সে যেন পণ করেছে কোন ভাবেই সিট ছাড়বেনা। যদিও কোন মহিলা দাঁড়িয়ে নেই তারপরো কন্ডাক্টর তাকে পিছনের খালি সিটে গিয়ে বসতে বলছে। লোকটাও নাছোড়বান্দা।
সামনের সিটে যে মেয়েটা বসে আছে,মেয়েটা দেখতে বেশ। উহু,আমার এসব চিন্তা করা ঠিক হচ্ছে কি?আমি না একজনের প্রেমে পড়েছি?আবার ভাবলাম,সুন্দর কে সুন্দরতো বলা যেতেই পারে।
ওমা,মেয়েটা কি আমার মনের কথা বুঝতে পারলো নাকি?না হলে ওরকম হঠাৎ ঘুরে তাকালো কেন?
কিজানি,আমার অত্তসব ভাবার দরকার নাই। এত ভাবনা আসে কোথা থেকে আল্লাহই জানেন।
অনেক দিন পর আজ মায়ের সাথে দেখা হবে। বাসায় গিয়েই তাড়াতাড়ি রওনা দিতে হবে,বেশি রাত হলে সমস্যা। মার জন্য কি নেয়া যায়?ফল ফ্রুট নিয়ে লাভ নাই।
এমন কিছু যা দেখেই মা খুশি হয়ে যাবে। মা কে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম,"মা কি আনব বল?কি আনলে তোমার সব থেকে বেশি খুশি লাগবে?"
মা বলেছিল,"আমার ছেলেটা আসলেই আমার সব থেকে বেশি আনন্দ হবে। "
মায়ের সাথে দেখা করলে কি বাবা রাগ করেন?বাবার ভাব ভঙ্গিতে বোঝা যায়না কিছুই,তবে মানুষ তো। মন মনে হয় একটু খারাপ হয়। ছোট বোনটাকে নিয়ে যেতে পারলে ভাল হত,কিন্তু ওর আবার পরিক্ষা চলছে।
বেচারি হয়তো মন খারপা করবে।
জীবন টা কত জটিল। এত অল্পদিনের জীবনে এত জটিলতা কেন?অল্পকটা দিন আমরা কেন হাসিমুখে কাটাতে পারিনা?এর মাঝেও এত কষ্ট,এত ঝামেলা,এত ঝগড়া!ভাললাগা গুলোও সব সময় ধরা দেয়না,কেন?
একি!হঠাৎ বাসটা থেমে গেল কেন?একি এত আগুন এল কোথা থেকে। সামনে আগুন,পিছনে আগুন। যেখানে ঐ লোকটা বসে ছিল নাছোড় বান্দা হয়ে সেখানে আগুন ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছেনা।
ওই মেয়েটা আস্তে আস্তে আগুনের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। সবাই চিৎকার করছে। একি,আমিও চিৎকার করছি। কেন?আমিও কি আগুনের ভিওর হারিয়ে যাচ্ছি?আমার কি মৃত্যু হচ্ছে?পিছনের রাজনৈতিক আলাপ আর শোনা যাচ্ছেনা,দুজনেই চেচাচ্ছে,আগের থেকেও জোড়ে। এটা কি তবে নরক?এটা কি তাহলে শেষ?আমি কি আগুনে হারিয়ে গেছি,না কি এখনো অবশিষ্ট আছি?ওই কন্ডাক্টার কোথায়,ফোনে জোড়ে কথা বলা লোকটা ?কেউ নেই?এটাই কি তাহলে মৃত্যু?আমি মারা যাচ্ছি?জীবনের শেষ সময়ে আমি কি ভাবব?বন্ধু দের কথা?বোনটির সাথে খুনশুটির কথা?ছোট বোনটা চকলেট নিয়ে যেতে বলেছিল,ওর চকলেট খাওয়া হলনা।
কার কথা ভাবছি আমি?ওর কথা। ওকে তো বলা হলনা,আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। নাকি মায়ের কথা ভাবছি?বাবার কথা ভাবছি??
না আমি কারো কথা ভাবতে পারছিনা। আমি কিছুই ভাবতে পারছিনা,এত কিছু ভাবি আমি,এখন আমার ভাবনা গুলো গেল কোথায়?আমার কোন অনুভূতি নেই,আমি হারিয়ে যাচ্ছি,হারিয়ে যাচ্ছি,হারিয়ে যাচ্ছি..............
(একজন মৃত্যু পথযাত্রি মানুষের শেষ মুহুর্তে চিন্তা ভাবনা কেমন হবে সেটা আমাদের পক্ষে কোন ভাবেই জানা সম্ভব না। তার পরও সামান্য একটু চেষ্টা করেছি কল্পনা করতে যদিও আমার কল্পনা খুব একটা বাস্তব হয়নি।
এই ধৃষ্টতা টুকু পাঠক অবশ্যই ক্ষমা করবেন আশা করি। আরেকটি কথা ০ "সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক"০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।