সত্য পথের অনুসন্ধানি
হরতালের তাত্বিক সংজ্ঞা যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যায়: এটি একটি অহিংস আহবান মাত্র। কাজ কর্ম থেকে বিরত থেকে সরকারকে রেড সিগন্যাল জানানোই এর উদ্দ্যেশ্য। এখানে কেউ কাজ থেকে বিরত থাকতেও পারেন আবার কাজ থেকে বিরত না ও থাকতে পারেন। কোন সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে যে কেউ এই রকম আহবান করতে পারে। (যদিও আমাদের দেশের ব্যবহারিক হরতাল ভিন্ন যেখানে পিকেটার নামক একটা প্রজাতি আছে যারা জোর করে, ঢিল ছোড়ে এবং ককটেল উৎসব এবং গাড়িতে অগ্নি উৎসব করে) ।
” আহবান” মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাথে জড়িত। তাই হরতাল আহবান এবং হরতাল শব্দটিতে আইনগত দোষ খুব একটা লক্ষণীয় নয়।
হরতালে স্ব-শরীরে কোন কিছু করতেও হয় না। কিন্তু “অবরোধ” শব্দটার মধ্যেই(itself) সক্রিয় একটা বাঁধার(obstruction) ব্যাপার আছে। অবরোধ ডাকলেই হয় না ।
অবরোধ করতেও হয় সক্রিয় শারিরিক উপস্থির মাধ্যমে- বাঁধা প্রদান করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটার আইন গত ভিত্তি কি আছে? কোন সংগঠনের সেটা ডাকার অধিকার আছে কিনা? একটা চলন্ত ট্রেনের সামনে বাঁধা প্রদান করলে যাত্রীদের মৌলিক অধিকার কি লংঘিত হয় না? কোন মন্ত্রীকে অথবা প্রধানমন্ত্রীকে কাজে যোগদানে বাঁধা বা অবরোধ না করে কেন সরাসরি জনগণকে অবরোধ? দল নিরপেক্ষ জনগণ কেন সেটা ভোগ করবে? অথবা অন্য কি উপায়ে সরকারকে সম্ভাব্য অন্যায় আচরণ থেকে বিরত রাখা যায়? (সর্বশেষ থাইল্যান্ডে দেখলাম মন্ত্রানালয় অবরোধ করেছে মাত্র)এ সব নিয়ে সময় সাপেক্ষ আলোচনা আলোচনা অনেক হলেও সমাধান সে তিমিরেই রয়ে গেছে।
কেন অব্যাহত অবরোধের ডাক ? এর পেছনে মুলত দায়ী কে? সরকারের দোষ কতটুকু ? বিরোধী দলের দায় কতটুকু? সরকারের হাজার হাজার ভুল ত্রুটি নিয়ে টক শোর ঠান্ডা কফি গরম হয়ে ওঠে. দিস্তা দিস্তা রিম রিম কাগজ এ সব সমালোচনায় মুখর আছে। তাই আমি এ দিকটায় না গিয়ে “অবরোধ”কে আইনগত এবং নৈতিকতার জায়গা থেকে দেখবার প্রয়াস চালাবো। এর বাইরেও বিরোধী দলের লক্ষ্যচুত আন্দোলন (কখনো কেবল মাত্র প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চায় আবার কখনো তত্বাবধায়কের পুনর্বহাল চায়; আবার কখনো দল নিরপেক্ষদের নির্বাচিত করিয়ে এনে সরকার গঠনের কথা বলেন।
) সর্বশেষ অবিবেচকের মত রাত্রের দশটায় অবরোধের ডাক দেয়া এবং সংবাদ সম্মলনে দায়সারা কর্মসুচী ঘোষণা করে সাংবাদিকের কোন ধরণের প্রশ্ন করতে না দেয়া এসব নিয়েও বিভিন্ন মিডিয়া/সোস্যাল মিডিয়া সরব আছে।
কি অবরোধ? কোথায় অবরোধ? কি কি অবরোধের আওতায় এসবকে সজ্ঞায়িত না করে শুধু “সর্বাত্মক অবরোধ” বলে জনগণের ইনসিকিউরিটিকে এবং কনফিউশনকে আরো উস্কে দেয়া হচ্ছে নিয়মিত। এই ইনসিকিউরিটিকে সরকার পক্ষ থেকেও লাঘবের কোন উদ্যোগ না নেয়ায় মর্মাহত হচ্ছে সাধারণ জনগণ। এতে ভুলুন্ঠিত হচ্ছে জনগণের অবাধ চলাফেরার সাংবিধানিক অধিকার,ভুলুন্ঠিত হচ্ছে মানবাধিকার, ধবংস হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। দুই প্রধান দলের বিরোধের জের ধরে ফায়দা লুটছে অন্য অনেক সুবিধাবাদী সংগঠন।
লাভবান হচ্ছে এবং পেট্রোলবোমার রেসিপির কার্যকারীতা যাচাই করে নিচ্ছে জঙ্গী সংগঠন গুলো।
মৌলিক অধিকার তথা মানবাধিকারের ঐতিহাসিক পটভুমিকে একটু স্পর্শ করি। মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকার শব্দদয় বেশ ঘনিষ্ট ভাবে জড়িত। অস্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের মানবাধিকার ঘোষণায় এবং আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র ও সংবিধানে কতগুলো মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ হবার পর থেকে বিভিন্ন দেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার সন্নিবেশ করা এক প্রকার প্র্যাকটিসে পরিণত হয়েছে। অতীতকালে ফ্রান্স ও আমেরিকায় দেখা গেছে, নির্বাচনে জয়লাভ করে যে দল ক্ষমতায় যায় সে দলসমষ্টিগত স্বার্থ ও জাতিগত স্বার্থের পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত থাকতো।
তাই ,জনগণের দাবীর প্রেক্ষিতে মৌলিক অধিকার গুলোকে সর্বোচচ সাংবিধানিক আইনে পরিণত করা হয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায় যে 25 টি অধিকার প্রদত্ত হয়েছে তার মধ্য থেকে বাংলাদেশ সংবিধানের 17 টি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছে 26 থেকে অনুচ্ছেদ 47(ক) পর্যন্ত জনগনের মৌলিক অধিকার(fundamental rights) সমুহ লিপবদ্ধ আছে। তার মধ্যে থেকে দু একটি অুনচ্ছেদ তুলে ধরলাম আজকের আলোচ্য শিরোনামকে সামনে রেখে।
জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকাররক্ষণ
অনুচ্ছেদ ৩২: আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
চলাফেরার স্বাধীনতা
অনুচ্ছেদ:৩৬। জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।
আইনের দৃষ্টিতে সমতা
অনুচ্ছেদ ২৭: সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
উপরোক্ত সাংবিধানিক ধারার আলোকে নিশ্চয় একথা স্পস্ট ভাবে বলা যায় যে রাজনৈতিক দল গুলোর “অবরোধ” ডাকা বেআইনি এবং যথেষ্ট অবিবেচকও বটে। বিশেষ করে বর্তমান আর্থ-সামাজিক নিয়মমাফিক জীবনে হরতাল এবং অবরোধ গুলো ডাকাও হচ্ছে জনসাধারণের রুটিনকে রিসিডিওল করার সুযোগ না দিয়ে।
গতকাল রাত দশটায় ঘোষনা করা হলো “অবরোধের শুরু ভোর 6 টা থেকে। ” মাত্র আট ঘন্টার রাত্রিকালীন সময় দিয়ে। অনেকে জানেনও না যে আজকে অবরোধ। যে পঞ্চম শ্রেণীর ছেলেটির আজকে পরীক্ষা ছিল সে নিশ্চয় রাত দশটায় ঘুমিয়ে গেছে সর্বশেষ রিভিশন দিয়ে। ফেমিলিও হয়ত আগে আগেই ঘুমিয়েছে খুব ভোরে জাগতে হবার তাড়না থেকে।
কিন্তু সে ছেলেটি যখন সকালে উঠে শুনবে আজকে পরীক্ষা আর হচ্ছে না! (তালিয়া বাজাও) । এই ভাবে আমরা কোমল মনে কঠোর কর্মসুচীর দিক্ষা দিয়ে চলেছি গত দুই যুগ ধরে। এমনকি আমার পাশের কলিগ সকালে অফিসে যাবার জন্য রেড়ি হয়ে আমাকে ফোন দিয়েছে আমি বের হয়েছি কিনা সেটা জানার জন্য। আঠার দলীয় এই সমর্থকও উস্মা প্রকাশ করলেন সময় জ্ঞান দেখে।
আমার লিখার প্রস্তবনায় উল্লেখ করেছি এর জন্য কেবল মাত্র বিরোধীদল একক ভাবে দায়ী নয়।
সরকারী দলের দায়ের বিষয়টি ব্যাপক ভাবে আলোচিত বিধায় আমি বিরোধীদলের দায়, সময় জ্ঞান এবং জনগণের প্রতি নুন্যতম চিন্তভাবনা না করা কর্মসুচির কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। এই ধরণের কঠোর এবং ব্যাপক কর্মসুচী দেয়ার কিছু নিয়মকানুন অন্তত থাকা আবশ্যক বলে মনে করছি। হয়ত আমার এই লিখার পাল্টা যুক্তি হিসাবে আগের বিরোধীদল তথা বর্তমান সরকারী দলের এহেন বহুত কর্মকান্ড রেফারেন্স হিসাবে আসবে। তাদের প্রতি আমার সবিনয় অনুরোধ :অপরাধ দিয়ে অপরাধ যাষ্টিফাই করলে আমাদের আম জনতার ভাগ্য এমনই থাকবে। আমি আপনি অবরোধের শিকার হবো, বার্ন ইউনিটে আমাদের ভাই বোনেরই আহাজারী শুনা যায়।
সেখানে জয় নেই, তারেক নেই, সালমান বাবুনগরী নেই। “আমাদের নাহিদ , আমাদের সোহাগ আমাদের সিএনজি চালকদের রোদে পোড়া ত্বকে আগুন লেগে আরেকটু পুড়েছে মাত্র” এই শান্ত্বনা নিয়ে আমাদের চলতে হবে যতদিন না আমরা ব্লেইম গেম খেলা বন্ধ না করবো। বর্তমানে যারা বিরোধীদল তারা ও জনগণকে লিড করে এবং সংসদীয় সরকারে সরকার অর্থে বিরোধীদলকেও বুঝিয়ে থাকে এবং যেহেতু সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব এবং বিরোধী দলীয় নেতার পদ এবং সুযোগ সুবিধা এখনো বহাল আছে তাই আমি বিরোধীদলের কাছেও দাবী করতে পারি আইন সংগত এবং বিবেচক কর্মসুচী ঘোষণার। “গাড়ি আমরা পোড়াইনি অমুকে পোড়িয়েছে” এটা বলেই দায়িত্ব শেষ হয়না যদি তারা দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসাবে নিজেদের দাবী করে। আর সরকারী দল কখনোই দাবী করতে পারেনা তারা সফল যদি পাবলিক ইনসিকিউরিটি ব্যাপক মাত্রায় থাকে।
পরিশেষে এটাই বলবো আমরা খুব বেশী মাত্রায় অসহায় । আমাদের সাংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার গুলোকে সম্মান জানান- হে সংবিধান এবং দেশ রক্ষক জনগণের কথিত সেবক রাজনৈতিক দল সমুহ।
মৌলিক অধিকারের আইনগত রক্ষক সর্বোচ্ছ আদালত আপনি দয়া করে “অবরোধ ” ডাকার বিষয়ে রুল দিন। রাজনৈতিক দল গুলো নিজেদের অধিকার গুলা নিজেদের মত করেই ভোগ করবে আর আমাদের অধিকার গুলা কি কেবলই সর্বাত্বক অবরোধের মুখে, পেট্রোল বোমার মুখেই নিভৃতে কাঁদবে?
সাহায্যকারী বই:সাংবিধানিক আইন-অধ্যাপিকা নাজনীন হোসেন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।